English Version
আপডেট : ২৪ মে, ২০১৮ ১১:৪৬

বাজারে এখন 'মোবাইল' আতঙ্ক

অনলাইন ডেস্ক
বাজারে এখন 'মোবাইল' আতঙ্ক

নিত্যপণ্যের বাজারে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা রমজানের শুরু থেকেই নানা ধরনের অভিযান পরিচালনা করছে। এর একটি গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি হচ্ছে ভ্রাম্যমাণ আদালত বা মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা। যার কারনে এখন বাজারে এখন 'মোবাইল' আতঙ্ক বিরাজ করছে।

সরকারের এসব অভিযানের ফলে দামের ক্ষেত্রে তেমন প্রভাব না পড়লেও মানহীন ও মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়া পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এসব অভিযানে ক্রেতারা অনেকটাই খুশি, তবে খুবই মনখারাপ ব্যবসায়ীদের।   কারণ, মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে তারা ব্যবসায়ীদের জেল জরিমানাও করছে। এর ফলে রাজধানীর নিত্যপণ্যের বাজারগুলোয় এখন (মোবাইল কোর্ট) ভ্রাম্যমাণ আদালত আতঙ্ক বিরাজ করছে। ব্যবসায়ীরা একে 'মোবাইল' আতঙ্ক বলে অভিহিত করছেন।

জানা গেছে, রমজান উপলক্ষে বাজারে সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর, ঢাকা মেট্রোপলিটান পুলিশ (ডিএমপি), বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই), নিরাপদ খাদ্য অধিদফতর ও সিটি কর্পোরেশন অভিযান পরিচালনা করছে।

এর বাইরে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) ও দেশব্যাপী জেলা প্রশাসন কর্তৃপক্ষ প্রতিনিয়ত বাজার মনিটর করছে। একই সঙ্গে বাজারে আগে থেকেই কাজ করছে সরকারের চারটি গোয়েন্দা সংস্থা। এসব সংস্থার গঠিত পৃথক পৃথক টিম প্রতিদিনই খোঁজ খবর নিচ্ছে নিত্যপণ্যের মূল্য, সরবরাহ ও মজুদ পরিস্থিতির।   একই সঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) বাজারে মূল্য পরিস্থিতি ঠিক রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ৫টি নিত্যপণ্য (মসুর ডাল, সয়াবিন তেল, চিনি, খেজুর ও ছোলা) বিক্রি করছে অপেক্ষাকৃত কম মূল্যে। 

জানা গেছে, প্রতিদিনই রাজধানীর উল্লেখযোগ্য বাজারগুলোয় সরকারের বিভিন্ন সংস্থা নানা ধরনের অভিযান পরিচালনা করছে। পুরো রমজান মাস জুড়েই সরকারের এ কার্যক্রম চলবে। কিন্তু এখানেই আপত্তি ব্যবসায়ীদের।

ব্যবসায়ীরা মনে করেন, রমজান মাসে এ ধরনের অভিযানের ফলে ব্যবসার গতি ব্যাহত হচ্ছে। এর ফলে ব্যবসায়ীরা এক ধরনের মানসিক চাপ অনুভব করছেন। তারা বলছেন, এতে কাজের কাজ কিছুই হয় না। কিন্তু নিরাপরাধ ব্যবসায়ীরা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। এর অবসান হওয়া প্রয়োজন বলেও মনে করেন ব্যবসায়ীরা।   এ প্রসঙ্গে শ্যামবাজারের মুদি দোকানদার বলেন, আমরা পাইকারি বাজার থেকে পণ্য কিনি। খুচরা দরে বিক্রি করি। কোথায় পণ্যের প্যাকেট হয়, কোথায় পণ্যের দাম লেখা হয়, কে লেখেন, আমরা তা কিছুই জানি না। যা করে কোম্পানি করে।

কোথাও কোনও ত্রুটি হলে তা করছে কোম্পানি বা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। কিন্তু ভ্রাম্যমাণ আদালত জরিমানা করছে আমাদের। এটি এক ধরনের অবিচার, অন্যায়। আমরা কোনও পণ্যে ভেজাল মেশাই না।

যদি কোনও পণ্যে ভেজাল পাওয়া যায় তাহলে তা করেন পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এর দায় নিতে হচ্ছে আমাদের। এটি ঠিক নয়। শাস্তি যদি দিতে হয় তা দিতে হবে পণ্য উৎপাদনকারী কোম্পানিকে, আমাদের নয়।

রাজধানীর কোনাপাড়া বাজারের খুচরা মাংস ব্যবসায়ী, সকাল হলেই সিটি কর্পোরেশনের মোবাইল কোর্ট বাজারে আসে। জানতে চায়, আমরা সিটি কর্পোরেশনের নির্ধারিত দরে মাংস বিক্রি করছি কিনা। হেরফের হলেই জরিমানা করে। কোনও যুক্তি মানতে চায় না।

তারা জানতে চায়, গরুর কলিজা কেনো মাংসের দামে বিক্রি হয় না? তিনি বলেন, একটি গরুতে মাংস হয় কমপক্ষে দুই থেকে আড়াই মণ। এমন একটি গরুর কলিজার ওজন হয় মাত্র ৫ থেকে ৬ কেজি।

মাংসের তুলনায় কলিজার চাহিদা বেশি থাকে বলে আমরা কলিজা ভিন্ন দামে বিক্রি করি। সঙ্গে তিল্লিও বেচি কলিজার দরে। এখন এই অপরাধে মোবাইল কোর্ট আমাদের জরিমানা করে। তিনি ক্ষোভের সঙ্গে আরও বলেন, এটা রীতিমতো অন্যায়। এর সুরাহা হওয়া প্রয়োজন।

জানতে চাইলে রাজধানীর কাওরানবাজারের কিচেন মার্কেটের এক পাইকারি ব্যবসায়ী বলেন, সকাল হলেই আমরা আতঙ্কে থাকি। দোকান খুলি ভয়ে ভয়ে। কখন মোবাইল কোর্ট আসে। আমরা মানসিক চাপের মধ্যে আছি। এ ধরনের অভিযানের ফলে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

এব্যাপারে একজন নিয়মিত ক্রেতা রেজোয়ান আহাম্মেদ বলেন, সংসারের প্রয়োজনে বুধবার এসেছিলেন কেনাকাটা করতে। জানতে চাইলে তিনি বলেন, নিশ্চয়ই এ ধরনের অভিযান পরিচালনা সরকারের ভালো উদ্যোগ, তাতে কোনও সন্দেহ নাই। 

এ ধরনের কর্যক্রম সারা বছর পরিচালিত হলে আমরা ক্রেতারাই উপকৃত হবো। যতদুর জানি, সারাবছরই এ ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করার কথা। কিন্তু সারা বছর খবর নাই। রমজান এলেই এরা মাঠে নামে। এতে অনেকটাই হিতে বিপরীত হয়।   এ অভিযানের ফলে পণ্যের দামের ক্ষেত্রে কোনও সুবিধা ক্রেতারা পাচ্ছেন কিনা জানি না। কারণ কাচা মরিচ ১০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হতে দেখেছি। ৪০ টাকার শসা ৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। একইভাবে বেগুন, ছোলা, খেজুর সব কিছুই তো বেশি দামে বিক্রি হয়েছে। সেখানে তো কোনও অপারেশন দেখছি না।

এদিকে বাজার সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন- রমজান মাসজুড়ে সরকারের যেসব সংস্থা বাজারে নানা ধরনের অভিযান পরিচালনা করছে, প্রকৃতভাবে বাজারের মূল্য পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের কাজ তাদের নয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং টিম প্রতিদিনই বাজারে যায়।

একজন উপসচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তার নেতৃত্বে গঠিত এই মনিটরিং টিম নিত্যপণ্যের বাজার পরিস্থিতি দেখে তা প্রতিদিনই বাণিজ্যমন্ত্রী ও সচিবের কাছে প্রতিবেদনও দেয়। এই মনিটরিং কমিটির কাজ এ পর্যন্তই।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর মোড়কের গায়ে লেখা দামে পণ্য বিক্রি হচ্ছে কিনা, পণ্যের মেয়াদ ঠিক আছে কিনা ও জাল-জালিয়াতি হয় কিনা সেদিকে নজর রাখে। অনিয়ম দেখলে জেল জরিমানা করে।

শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) বিভিন্ন প্যাকেটজাত পণ্যের গায়ে এই দাম লেখা আছে কিনা বা এর বেশি দাম নিচ্ছে কিনা বা উৎপাদন ও ব্যবহারের মেয়াদ ঠিক মতো আছে কিনা বা কেউ কোনও পণ্যে ভেজাল দিচ্ছেন কিনা তা দেখভাল করে।

আর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত র‌্যাব-পুলিশ ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত নিরাপদ খাদ্য অধিদফতর ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে। এছাড়া সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর টিম বাজারের বিভিন্ন প্রকার নিত্যপণ্য আমদানি, সরবরাহ ও মজুদ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে, যাতে কেউ কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করতে না পারে।

তবে ক্রেতাদের অভিযো, এসব সংস্থার নির্দেশ অনেকেই মানে না। কখন কোন সংস্থা কোন নির্দেশ দিচ্ছে তা কে মানছে আর কে মানছে না, তা তদারকির কেউ নাই।   এদিকে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ কয়েক দফায় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকে সহনীয় মাত্রায় মুনাফা করার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, চাহিদার তুলনায় বেশি পণ্য মজুদ আছে। সংকটের কোনও কারণ নাই। দেশে এখন কোনও ধরনের নিত্যপণ্যের ঘাটতি নাই। কেউ কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দাম বাড়ানোর চেষ্টা করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।