English Version
আপডেট : ১৮ নভেম্বর, ২০১৭ ১১:১৯

ঝুঁকির মুখে ব্যাংক খাত

অনলাইন ডেস্ক
ঝুঁকির মুখে ব্যাংক খাত

গত বছরের জানুয়ারি থেকেই ব্যাংক খাতে একধরনের অস্থিরতা চলছিল। সে সময় থেকে এ পর্যন্ত অন্তত তিনটি বেসরকারি ব্যাংকের মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় হঠাৎ পরিবর্তন আনা হয়। এতে উদ্বেগ দেখা দেয় গ্রাহকদের মধ্যে। একই সঙ্গে সঞ্চয়পত্রের উচ্চ সুদের কারণে কিছুটা হলেও সার্বিকভাবে আর্থিক খাত ও বন্ড বাজারে উন্নয়ন ব্যাহত হতে থাকে। আলোচিত হতে থাকে ব্যাংকিং খাতে দুর্নীতি আর ঋণ অনিয়মের বিষয়টি। ব্যাংকের পর্ষদ সদস্যদের স্বেচ্ছাচারিতা, অব্যবস্থাপনা আর অদক্ষতাও সামনে চলে আসে।

সংকটের আগাম বার্তা ও সমাধানে বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়সহ সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোতে এ নিয়ে চিঠি চালাচালি চলেছে। প্রয়োজনীয় নির্দেশনাও এসেছে। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকের এ-সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকিং খাতে অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতায় বিস্ময় প্রকাশ করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি। কমিটি ডিসেম্বরের মধ্যে ব্যবস্থা নিতে সুপারিশও করেছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। উল্টো নিয়মবহির্ভূত কিছু সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে ব্যাংকিং খাত ঝুঁকির মুখে পড়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। এ মুহূর্তে খেলাপিঋণ দাঁড়িয়েছে ৭৪ হাজার ১৪৮ কোটি টাকায়। এর মধ্যে সরকারি আটটি ব্যাংকের ৪০ হাজার ৯৯ কোটি টাকা খেলাপি। শতাংশের হিসাবে যা ২৫ শতাংশ। অর্থাৎ সরকারি ব্যাংকগুলো ৪ টাকা ঋণ বিতরণ করলে ১ টাকা খেলাপি হচ্ছে। বাকি ৩৪ হাজার কোটি টাকা খেলাপিঋণ বেসরকারি ব্যাংকে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে, ৪৮টি ব্যাংকের মধ্যে ১৩টির আর্থিক অবস্থা বেশ খারাপ। এই ১৩ ব্যাংকের মধ্যে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ও বিশেষায়িত ব্যাংক আটটি। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ কমার্স, ন্যাশনাল, ফারমার্স ও এনআরবি কমার্শিয়ালে পরিস্থিতি কয়েক বছর ধরে খারাপ হচ্ছে। এ ছাড়া ইতোমধ্যেই বিলুপ্ত হওয়া ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের দুর্নীতির বোঝা এখনো টেনে চলেছে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক। বাকি বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে সুশাসনের অভাবে খেলাপি ঋণের পাশাপাশি ঋণ অনিয়ম বেড়েছে। সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি ব্যবস্থা আগের চেয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছে। এমনকি দুই বছর ধরে এই ১৩ ব্যাংকে পর্যবেক্ষক বসিয়েও পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না।

যদিও এমন পরিস্থিতির জন্য ব্যাংক কর্মকর্তারা দায় চাপাচ্ছেন পরিচালকদের ওপর। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, অনেক ক্ষেত্রেই তাদের কিছু করার ছিল না। তবে সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গণমাধ্যমে বলেছেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুর্বল তদারকির কারণেই খেলাপিঋণের এ অবস্থা।’ একইভাবে অর্থনীতিবিদরাও বলছেন, পরিস্থিতি উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য কোনো উদ্যোগ না নিয়ে উল্টো পরিদর্শন ও পর্যবেক্ষণ কমিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে আর্থিক খাতে ঝুঁকি বাড়ছে।

ব্যাংক খাতের এমন পরিস্থিতিতে সরকারকে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ। তিনি প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতে অব্যবস্থাপনা চলছে। অনিয়ম-দুর্নীতি চলছে। এটি ব্যাংক খাত তো বটেই, সার্বিক অর্থনীতির জন্য অশনিসংকেত। এমন অবস্থা চলতে থাকলে কেবল আমানতকারী বা ব্যবসায়ীরাই ব্যাংকবিমুখ হবেন না, উৎপাদন, বিদেশি বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এখনই সরকারকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। শক্ত হাতে পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে। নতুবা ২০০৮ সালের মতো দেশের সার্বিক আর্থিক খাত ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে। যদি শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তা হলে সমস্যা হয়ে যাবে।

ব্যাংকিং খাতে অস্থিরতার কারণ হিসেবে পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় হঠাৎ পরিবর্তনকেই দায়ী করা হচ্ছে। গত বছরের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত তিন ব্যাংকের মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় হঠাৎ পরিবর্তন আসে। ২০১৬ সালের শুরুতে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ইসলামী ব্যাংক এবং সবশেষ গত ৩০ অক্টোবর রাতে সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের (এসআইবিএল) চেয়ারম্যান, পরিচালক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে তড়িঘড়ি পরিবর্তন আনা হয়।

অবশ্য আইসিবিএলে পরিবর্তন প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা বলেন, কোম্পানি আইন অনুযায়ী যেকোনো প্রতিষ্ঠানের পর্ষদে পরিবর্তন আসতেই পারে। তবে এসআইবিএলের পরিবর্তনে নিয়ম মানা হয়নি-উল্লেখ করে ব্যাংক সূত্র জানায়, চাপ দিয়ে পদত্যাগ রোধ করতে ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে নীতিমালা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাতে বলা হয়, চুক্তির মেয়াদপূর্তির আগেই কোনো কর্মকর্তা পদত্যাগ করতে চাইলে এক মাস আগে চেয়ারম্যানের কাছে আবেদন করতে হবে এবং বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া কাউকে পদত্যাগে বাধ্য করা যাবে না। অথচ এই ব্যাংকে পরিবর্তনে সে নিয়ম মানা হয়নি। একই প্রক্রিয়ায় গত জানুয়ারিতে ইসলামী ব্যাংকেও পরিবর্তন আসে।

এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, যে পদ্ধতিতে ব্যাংকের পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনা হচ্ছে, তা ব্যাংক খাতের সুশাসনের জন্য অন্তরায়। তাতে গ্রাহকদের আস্থা হারিয়ে যাবে। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে ব্যাংকের মালিকপক্ষও। এর প্রভাব পড়বে পুরো আর্থিক খাতে।

সঞ্চয়পত্রের উচ্চ সুদহার ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা নষ্ট করছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রমতে, সম্প্রতি সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমানোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এ-সংক্রান্ত একটি চিঠি অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, সঞ্চয়পত্রের উচ্চ সুদের কারণে সার্বিকভাবে আর্থিক খাত ও বন্ড বাজারের উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে। সঞ্চয়পত্রের সুদহার অর্থবাজারে বিদ্যমান সুদহারের চেয়ে বেশি হওয়ায় সরকারের দায় বেড়ে যাচ্ছে বলেও উল্লেখ করা হয়।

জানা গেছে, সঞ্চয়পত্রের দিকে মানুষের আগ্রহের বড় কারণ ব্যাংক আমানতের নিম্ন সুদহার। ব্যাংকে বর্তমানে আমানতে সুদের হার এখন চার থেকে ছয় শতাংশের মধ্যে। বিপরীতে বিভিন্ন সঞ্চয় প্রকল্পের সুদ হার ১১ থেকে ১২ শতাংশের কাছাকাছি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০১৬-১৭ অর্থবছর শেষে সুদাসলে সঞ্চয়পত্রে সরকারের ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে প্রায় দুই লাখ ৯ হাজার ৮২৬ কোটি টাকা। এর আগে ২০১২-১৩ অর্থবছর শেষে সঞ্চয়পত্র খাতে সরকারের দেনা দাঁড়ায় ৬৪ হাজার ১০৮ কোটি টাকা। তবে পরের পাঁচ বছরে এ খাত থেকে সরকারের ঋণ বেড়েছে তিন গুণেরও বেশি। গত নভেম্বরের শুরুতে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ স্থিতি ৮৭ হাজার ৪০ কোটি টাকা। গত জুনের তুলনায় যা দুই হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা এবং আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৮ হাজার ৯১৯ কোটি টাকা কম। বর্তমানে ব্যাংক খাতে এক লাখ ১৭ হাজার কোটি টাকা উদ্বৃত্ত তারল্য রয়েছে। এর মধ্যে অলস পড়ে আছে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা।

সম্প্রতি বেসরকারি খাতের ফারমার্স এবং এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের অনিয়ম ও দুর্নীতির ঘটনায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। ২০১৩ সালে অনুমোদন পাওয়া বেসরকারি ৯ ব্যাংকের মধ্যে খেলাপি ঋণের শীর্ষে আছে ফারমার্স ব্যাংক। ওই বছরের জুনে যাত্রা শুরু করা ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ গত জুন শেষে হয়েছে ৩০৬ কোটি টাকা। ২০১৩ সালের এপ্রিলে যাত্রা করা এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১৯১ কোটি টাকা। বিভিন্ন ঋণ অনিয়মের কারণে ফারমার্স ও এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক ছাড়াও রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, বেসিক, রূপালী, কৃষি, বিডিবিএল এবং রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকে খেলাপি ঋণের ছড়াছড়ি অবস্থা। যার পরিমাণ ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত উন্নীত হয়েছে।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, বেসরকারি খাতের যেসব ব্যাংকের মালিক রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী, তাদের বিরুদ্ধেই নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠছে। এসব দুর্নীতি-অনিয়মের দায় পরিচালনা পর্ষদসহ সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে নিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ও দায় এড়াতে পারবে না। এই চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে না পারলে লুটপাট বন্ধ হবে না।

দেশে বর্তমানে ব্যাংকের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, এতে ব্যাংকিং খাতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বেড়েছে। গত ৫ বছরে খাতটি অনেক পেছনে চলে গেছে। ব্যাংকগুলো এখন মুদি দোকানে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ৫৭টি ব্যাংক যথেষ্ট। নতুন করে আরো ব্যাংক দিলে এ খাতে অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে। এ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে কঠোর হতে হবে।