English Version
আপডেট : ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০৮:৫৬

চালের দাম কমানোর ঘোষণা ব্যবসায়ীদের

অনলাইন ডেস্ক
চালের দাম কমানোর ঘোষণা ব্যবসায়ীদের

সরকারের তিন মন্ত্রী পলিব্যাগে আমদানিসহ কয়েকটি তাত্ক্ষণিক সিদ্ধান্ত দেওয়ায় ব্যবসায়ীরাও চালের দাম কমানোর ঘোষণা দিয়েছেন। গতকাল মঙ্গলবার সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে চালকল মালিক ও ব্যবসায়ীরা নিজেরা হৈচৈ করেন, বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন মন্ত্রীদের সঙ্গেও। তবে শেষ পর্যন্ত দাম কমানোর ঘোষণার মধ্য দিয়ে বৈঠকটি সফলভাবেই শেষ হয়। ধারাবাহিক অভিযান চালানোর মধ্যে এ বৈঠকে চালকল মালিক সমিতির নেতাদের উপস্থিতি নিয়ে সংশয় ছিল। কিন্তু সরকারের তরফ থেকে তাঁদের আসতে বলা হয়। বৈঠকে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ও খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন।

সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে সোয়া দুই ঘণ্টা আলোচনার পর চাল ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘আপনাদের সব বাধা দূর করতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে সঙ্গে নিয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করব। ’ চাল আমদানি, উৎপাদন ও সরবরাহে আগামী তিন মাস চটের বস্তার পরিবর্তে প্লাস্টিকের বস্তা ব্যবহারের অনুমোদন দিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, যে যেভাবে আনতে পারেন আনবেন। কেউ বাধা দেবে না। এ ছাড়া ভারত থেকে ট্রেনে করে রোহনপুর দিয়ে চাল আনার পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে জানান বাণিজ্যমন্ত্রী।

চালকলগুলোতে অভিযান চালাতে জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ দেওয়া প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী ব্যবসায়ীদের বলেন, ‘এখন যেহেতু আপনাদের সঙ্গে বৈঠক হলো, তাই আমি সংশ্লিষ্টদের বলছি, আর যাতে কেউ হয়রানির শিকার না হন।

’ পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরে চাল পরিবহনে বিভিন্ন সমস্যা দূর করতেও সরকার পদক্ষেপ নেবে বলে আশ্বাস দেন বাণিজ্যমন্ত্রী। বৈঠকে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম কোনো সংকট নেই এবং সারা দেশে প্রায় এক কোটি টন চাল আছে—এ মন্তব্য করে ব্যবসায়ীরা কৃত্রিমভাবে দাম বাড়াচ্ছেন বলে অভিযোগ তোলেন। সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসায়ীরা এর প্রতিবাদ জানিয়ে উল্টো নানা নীতির সমস্যা ও সরকারের বিরুদ্ধে সময়মতো সিদ্ধান্ত না নেওয়ার অভিযোগ আনেন।

ব্যবসায়ীরা চালের দাম বাড়ার কারণ ব্যাখ্যা করার পাশাপাশি বিভিন্ন অসুবিধার কথা তুলে ধরেন। ভারত থেকে চাল আমদানিকারক চিত্ত মজুমদার বলেন, আমদানি শুল্ক তুলে দেওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পরও সাত দিন লেগেছে এসংক্রান্ত গেজেট জারি করতে। এই সাত দিনে বিভিন্ন স্থলবন্দরে হাজার হাজার ট্রাক আটকে ছিল। ওই সময় যদি তাত্ক্ষণিকভাবে গেজেট জারি করা হতো, তাহলে প্রতি কেজিতে সাত টাকা করে চালের দাম কমে যেত।

চালকল মালিক আমিনুল কবীর বলেন, বিশ্বের আর কোনো দেশে চটের বস্তায় চালের ব্যবসা হয় না। ভারত, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম—সব দেশই পলিথিনের বস্তায় চাল রপ্তানি করে। কেবল বাংলাদেশে রপ্তানি করতে গেলেই তাদের চটের বস্তা খুঁজতে হয়। ব্যবসায়ীরা বহুবার চটের বস্তার এ বাধ্যবাধকতা চাল আমদানির ক্ষেত্রে তুলে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। কিন্তু কাজ হয়নি।

অটো, মেজর, হাসকিং মিল মালিক সমিতির সভাপতি আবদুর রশিদ বলেন, বৈঠকটি আরো আগে হলে ভালো হতো। এ সময় বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ তাঁকে উদ্দেশ করে বলেন, দেশে কোনো খাদ্যঘাটতি আছে? সরাসরি এর জবাব না দিয়ে রশিদ বলেন, আহামরি কোনো সুযোগ নেই। এই পর্যায়ে তোফায়েল আহমেদ জানতে চান, ‘দেশের বিভিন্ন স্থানে আপনার চালের মিল রয়েছে। আপনি চালকল মালিক সমিতির প্রেসিডেন্টও। আপনার চালকলকে গত সপ্তাহে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। আপনাকেই যদি জরিমানা করতে হয় তাহলে আর কিছু অবশিষ্ট থাকে? আপনার মিলে গিয়ে ডিসি-এসপি ডেকেছে। সাড়া দেননি। ’ এই পর্যায়ে রশিদ বলেন, ‘আমাকে চাল মজুদের জন্য জরিমানা করা হয়নি। আমাকে জরিমানা করা হয়েছে দ্রব্যমূল্যের তালিকা না টানানোর জন্য। বিষয়টি আমার জানা ছিল না। ’

চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক লায়েক আলী বৈঠকে জানান, পলিব্যাগ ব্যবহার করতে দিলে কাল থেকে চালের দাম কেজিতে দুই থেকে তিন টাকা করে কমে যাবে।

এই পর্যায়ে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা ভারতের সঙ্গে জিটুজি করার জন্য বহু চেষ্টা করেছি। তারা প্রতি টন চালের দাম ৫১৬ ডলার চেয়েছে, যা আন্তর্জাতিক বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক বেশি। এ কারণে আমাদের পক্ষে ভারত থেকে আমদানি সম্ভব হয়নি। তবে আমাদের দেশে এক কোটি টন চালের মজুদ রয়েছে। ’ এই পর্যায়ে ব্যবসায়ীরা প্রতিবাদ করেন। তাঁরা বলতে থাকেন, দেশে এক কোটি টন চাল মজুদ নেই। তাই আগামী আমন ফসল ওঠার আগে দাম কমার সম্ভাবনা নেই। এ পর্যায়ে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, মিল মালিক ছাড়াও কৃষকদের কাছেও কিছু চাল মজুদ থাকে। তারা  পরবর্তী ফসল সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে সেই চাল বাজারে বিক্রি করে না।

এ পর্যায়ে মিনিকেট চাল তৈরির প্রসঙ্গ তোলেন কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী। তিনি বলেন, চাল কেটে মিনিকেট তৈরির খবর পত্রিকায় প্রায়ই ছাপা হয়। তবে চালকল মালিক সমিতির সভাপতি রশিদ বলেন, ‘আমরা চাল কেটে মিনিকেট করি না। ’ এই বক্তব্য সমর্থন করে সমিতির সাধারণ সম্পাদক লায়েক আলী বলেন, এমন কোনো মেশিন আবিষ্কার হয়নি, যা দিয়ে চাল কেটে মিনিকেট বানানো যায়। জবাবে কৃষিমন্ত্রী বলেন, মিডিয়ায় যখন খবর ছাপা হয় তখন কেন প্রতিবাদ করেন না। লায়েক আলী বলেন, ‘আমরা এ ব্যাপারে প্রচারণা চালাব। ’ এ সময় বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, খাদ্য মন্ত্রণালয়ও এ ব্যাপারে প্রচার চালাতে পারে।

আলোচনার এ পর্যায়ে সাবেক খাদ্যমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘চাল কেটে মিনিকেট বানানোর বিষয়টি সত্য নয়। একজন কৃষিবিদ হিসেবে আমি বলছি, মিনিকেট একটি ভ্যারাইটি, যা আমাদের দেশের নওগাঁ অঞ্চলে চাষ হয়। ভারতেও মিনিকেট চাল আছে। ’

দিনাজপুরের ব্যবসায়ী হান্নান বলেন, ‘সরকারি গুদামে লোকসান দিয়ে চাল সরবরাহ করেছি। প্রথম দফায় প্রতি কেজিতে চার টাকা, পরে আট টাকা করে লোকসান হয়েছে। ’ এ কারণে আমন সংগ্রহের দর যৌক্তিক করার দাবি জানান তিনি। তিনি অভিযোগ করেন, সেতুতে যা টোল, তার চেয়ে বেশি আদায় করা হয় ট্রাকচালকদের কাছ থেকে। এ সময় চালকল মালিক সমিতির সভাপতি বলেন, মানিকগঞ্জে প্রতিটি ট্রাক থেকে দুই হাজার টাকা চাঁদা নেয় পুলিশ।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের ব্যবসায়ী আকবর হোসেন জানান, স্থানীয় স্থলসীমান্তে ট্রেন দিয়ে সব কিছু এলেও চাল আসে না। তোফায়েল আহমেদ তাত্ক্ষণিকভাবে এসব সমস্যা সমাধানের নির্দেশ দেন।

সভার শেষ পর্যায়ে এসে খাদ্যমন্ত্রী ঘোষণা দেন আগামীকাল (আজ বুধবার) থেকে উপজেলা পর্যায়ে খোলাবাজারে চাল বিক্রি শুরু হবে। ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রির খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি শুরু হওয়ার কথা থাকলেও তা আপাতত হচ্ছে না বলে তিনি জানান।

চাল ব্যবসায়ীদের কথা-কাটাকাটি

বৈঠক চলাকালে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু করেন চাল ব্যবসায়ীরা। একপর্যায়ে বক্তব্য দিতে উঠে দাঁড়ান বাংলাদেশ অটো রাইস মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সরকার সমর্থিত পক্ষের সভাপতি খোরশদ আলম। এ সময় অপর পক্ষের নেতা আব্দুর রশিদ ও লায়েক আলী তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, তিনি সরকারকে বিভ্রান্ত করছেন। এ পর্যন্ত এক ছটাক চাল সংগ্রহে তিনি সরকারকে সাহায্য করেননি। ফলে তাঁর এখানে সরকারকে সহযোগিতা করার কোনো সুযোগ নেই।

বৈঠকে মেঘনা গ্রুপের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল, সিটি গ্রুপের চেয়ারম্যান ফজলুর রহমানসহ বিভিন্ন চাল আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।