দ্বিগুণ সক্ষমতা নিয়ে উৎপাদন শুরু করেছে ট্যানারি কারখানা

ঈদুল আজহায় কোরবানি হওয়া পশুর চামড়া নিয়ে কোনো সংকট তৈরি হবে না। কারণ সাভারের হেমায়েতপুরে চামড়া শিল্প নগরের সব কারখানা চালু না হলেও যে ৬৭টি ট্যানারি চামড়া প্রক্রিয়াকরণ শুরু করেছে, সেগুলোর উৎপাদনক্ষমতা হাজারীবাগের সময়ের চেয়ে দ্বিগুণ বলে জানা যায়।
ট্যানারি মালিকরা জানান, নতুন করে শুরু করার সময় তাঁরা কারখানার উৎপাদনক্ষমতা বাড়ানোর ফলে এবার চামড়া নষ্টের ঘটনা আর ঘটবে না। তবে বর্জ্য নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছে। তারা বলেন, কোরবানির চামড়া প্রকিয়ার সময় ট্যানারিতে যে পরিমাণ বর্জ্য উৎপাদন হবে, তার যথাযথ ব্যবস্থাপনার জন্য চামড়াশিল্প নগর মোটেও প্রস্তুত নয়।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাবে, গত বছর কোরবানিতে জবাইযোগ্য পশু ছিল প্রায় ১ কোটি ৪ লাখ। এর মধ্যে গরু ও মহিষ ছিল প্রায় ৩৩ লাখ। বাকিটা ছাগল, খাসি, ভেড়াসহ অন্যান্য পশু।
গত এপ্রিল মাসে সর্বোচ্চ আদালত হাজারীবাগের ট্যানারির সেবাসংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে তাদের সাভারের চামড়া শিল্প নগরে স্থানান্তরে করার জন্য বাধ্য করেন।
হাজারীবাগের ২০৫টি ট্যানারির মধ্যে ১৫৫টি ট্যানারি সাভারের হেমায়েতপুরে জমি পেয়েছে। তবে বরাদ্দ বাতিল ও দেউলিয়া ঘোষিত হওয়ায় সাভারে স্থানান্তর হওয়ার কথা মূলত ১৫১টি ট্যানারির। এর মধ্যে ৬৭টি ট্যানারি ইতিমধ্যে উৎপাদন শুরু করেছে। এসব ট্যানারির উৎপাদনক্ষমতা আগের চেয়ে অনেক বেশি। আসছে ঈদের আগে আরও কয়েকটি ট্যানারি উৎপাদনে যাওয়ার চেষ্টা করছে।
তবে উৎপাদন শুরু করলেও বেশির ভাগ ট্যানারি শুধু কারখানার ওয়েট ব্লু (পরিশোধনের প্রাথমিক পর্ব) অংশ চালু করতে পেরেছে। চূড়ান্ত প্রক্রিয়াকরণ পর্যন্ত যেতে কারখানায় আরও কয়েকটি ধাপ চালু করতে হবে।
রিলায়েন্স ট্যানারি দৈনিক ২০ হাজার বর্গফুট কাঁচা চামড়ার ওয়েট ব্লু (প্রক্রিয়াকরণের প্রথম ধাপ) করতে পারে বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির টেকনিশিয়ান রফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, আমাদের দুটি ইউনিটের মধ্যে একটি চালু হওয়াতেই হাজারীবাগের চেয়ে আমাদের সক্ষমতা ৫০ শতাংশ বেড়েছে। ফলে কোরবানির চামড়া ওয়েট ব্লু করা নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না।
কোরবানির পর হেমায়েতপুরে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হবে বলে একাধিক ট্যানারির মালিক অভিযোগ করে বলেন, শিল্প নগরে বিসিকের তত্ত্বাবধানে কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) চালু হলেও প্রায়ই ট্যানারিগুলোর তরল বর্জ্য নির্দিষ্ট পাইপলাইনের ঢাকনা উপচে সড়কে এসে পড়ছে। এখন ট্যানারিগুলো সক্ষমতার পুরোটা ব্যবহার করছে না। তাতেই বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ভজকট লেগে যাচ্ছে। এ অবস্থায় পরিবেশ বিপর্যয় ঘটবে এবং কুরবানির পর হেমায়েতপুরে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হবে।
সম্প্রতি চামড়াশিল্প নগরে গিয়ে দেখা গেল, মদিনা লেদার কমপ্লেক্সের সামনের অবস্থা ভয়াবহ। সেখানে বর্জ্য সড়কের অর্ধেক জায়গা দখল করে ফেলেছে। ট্যানারির সীমানাপ্রাচীর লাগোয়া নালায় গিয়েও পড়েছে বর্জ্য। এ ট্যানারির নিচতলায় কাঁচা চামড়ার ওয়েট ব্লু হয়। দ্বিতীয় তলায় বিজিবির জন্য জুতা তৈরির কাজ করেন শ্রমিকেরা। হাজারীবাগে তাদের তিনটি ড্রামে দিনে ৩০০ চামড়ার ওয়েট ব্লু করা যেত। আর এখানে আটটি ড্রামে দিনে ৭০০ চামড়া প্রক্রিয়াকরণ সম্ভব।
নবারুন ট্যানারির ব্যবস্থাপক আবুল কালাম বলেন, এবার ঈদে কোরবানির চামড়া সামাল দেওয়া যাবে। প্রতিটি ট্যানারির সক্ষমতা দুই-তিন গুণ বেড়েছে। তবে কোরবানির চামড়া প্রক্রিয়াকরণ শুরু হলে বিপুল পরিমাণ তরল বর্জ্য ছাড়বে ট্যানারিগুলো। তখন সিইটিপি বর্জ্য না টানলে রাস্তাঘাট ভরে যাবে।
তিনি বলেন ফেন্সি লেদারের চামড়া প্রক্রিয়াকরণের সক্ষমতা তিন গুণ বেড়েছে। হাজারীবাগে দিনে ৪০০-৫০০ চামড়া ওয়েট ব্লু করতে পারত, সাভারে তারা করতে পারবে দেড় হাজার চামড়ার।
প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী মো. শামসুল হুদা বলেন, হেমায়েতপুরে সব ট্যানারি নতুন যন্ত্র বসিয়েছে। ফলে সক্ষমতা ও বেড়েছে। তাই কোরবানির চামড়া প্রক্রিয়াকরণ করতে কোনো সমস্যা হবে না। বর্জ্য পরিশোধন যথাযথভাবে হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিসিকের কর্মকর্তারা বলেছেন চালু করেন। বর্জ্য পরিশোধনের দায়িত্ব তো তাঁদের। চামড়াশিল্প নগরের প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ জিয়াউল হক বলেন, বর্জ্য পরিশোধনাগারের দুটি মডিউল চলছে। আরও দুটি চালুর জন্য কাজ চলছে। বর্জ্য নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না বলে আশা করেন তিনি।
যে ভাবে প্রক্রিয়া করণ করা হয় * গরু জবাইয়ের পর চামড়া ছাড়িয়ে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তাতে লবণ দিতে হয় * লবণযুক্ত চামড়া ট্যানারিতে কেটে একটি আকার দেওয়া হয়। এ পর্যায়ে লেজ, মাথা ও পায়ের অংশ কেটে ফেলা হয়। * এরপর প্রায় ৩০ ধরনের রাসায়নিক দিয়ে ট্যানিং ড্রামে চামড়ার প্রক্রিয়া করা হয়। এতে পশম দূর হয়ে যায়। ড্রাম থেকে চামড়া বের করে ঝিল্লি ও চর্বি অপসারণ করে ওয়েট ব্লু চামড়া উৎপাদিত হয়। * এরপর ক্রাস্ট লেদার উৎপাদনে প্রায় ৫০ রকম রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়। এ পর্যায়ে চামড়া রং করা হয়। * সর্বশেষ চামড়ার সাজসজ্জা করা হয়। এতেও ১৫ ধরনের রাসায়নিক লাগে। একে বলে ফিনিশড পর্যায়। এই চামড়া দিয়ে বিভিন্ন পণ্য তৈরি হয়।