ইসলামী ব্যাংক ছাড়ছে জামায়াতপন্থীরা

দেশি ব্যবসায়ীদের মালিকানা বাড়ছে ইসলামী ব্যাংকে। পাশাপাশি বিদেশিদের অংশীদারিত্ব কমছে। মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক উদ্যোক্তাদের একটা অংশ ইসলামী ব্যাংক থেকে নিজেদের শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছে। প্রতিষ্ঠার সময়ে ইসলামী ব্যাংকে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক দেশগুলোর বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে বিনিয়োগ ছিল ৭০ শতাংশ। বর্তমানে তা ৫২ শতাংশে নেমেছে। এসব কিনে নিয়েছেন দেশি ব্যবসায়ীরা।
এ ছাড়া শেয়ারবাজারে গত বছরের শেষে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের পোর্টফোলিও বিনিয়োগ ছিল ১১ দশমিক ১১ শতাংশ। গত ডিসেম্বর শেষে তা ৬ দশমিক ৩৯ শতাংশে নেমে এসেছে। ব্যাংকটির শেয়ার ধারণ বিষয়ক সর্বশেষ তথ্য বিশ্লেষণ করে এ তথ্য পাওয়া গেছে। গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর একটি হোটেলে অনুষ্ঠিত পরিচালনা পর্ষদের সভায় ইসলামী ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ে ব্যাপক রদবদল করা হয়। পুনর্গঠন করা হয় পরিচালনা পর্ষদ। পর্ষদের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মোস্তফা আনোয়ারকে সরিয়ে নতুন চেয়ারম্যান করা হয় সাবেক সচিব আরাস্তু খানকে। পদত্যাগ করেন ব্যাংকের এমডি মোহাম্মদ আবদুল মান্নান। নতুন এমডির দায়িত্ব দেওয়া হয় ইউনিয়ন ব্যাংকের এমডি মো. আবদুল হামিদ মিঞাকে।
ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮৩ সালে। শুরু থেকেই এই ব্যাংকটির ওপর জামায়াতের প্রভাব ব্যাপক। বিভিন্ন সময় গুরুতর অভিযোগ ওঠে এ ব্যাংকটির বিরুদ্ধে। জামায়াতের পাশাপাশি জঙ্গিবাদে অর্থায়নের অভিযোগ সবচেয়ে আলোচিত।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, ব্যাংকটির শীর্ষ পদে পরিবর্তনের মাধ্যমে এ প্রতিষ্ঠানটি জামায়াতের প্রভাবমুক্ত হবে। জামায়াত নেতাদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ইবনে সিনার প্রতিনিধি হিসেবে ব্যাংকটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন মুস্তাফা আনোয়ার। এ ছাড়া পরিচালনা পর্ষদে যারা জামায়াত-ঘনিষ্ঠ ছিলেন, তারাও কেউ স্বেচ্ছায় সরে গেছেন, কেউ পদত্যাগ করেছেন।
ইসলামী ব্যাংকের মালিকানায় বড় পরিবর্তনকে একটি বেসরকারি ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ বড় সংস্কার হিসেবে দেখছেন বিশিষ্ট ব্যাংকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ।
তিনি বলেন, এতদিন ব্যাংকটি জামায়াতে ইসলামীর একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত ছিল। এ পরিচয় থেকে বের হয়ে আসার একটা প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে। এতে জামায়াতপন্থি নন এমন মানুষদের কাছে ইসলামী ব্যাংকের গ্রহণযোগ্যতা ও আস্থা আরও বাড়বে।
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ আরও বলেন, মালিকানায় পরিবর্তন হলেও ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনায় বড় পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। কারণ এর এমডি পদে পরিবর্তন হলেও বিপুল সংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সরানো সম্ভব নয়। এক সময় জামায়াতপন্থি না হলে এ ব্যাংকে চাকরি পাওয়া সম্ভব ছিল না- এটা অনেকটাই সত্য। এটাও সত্য- এমন নিয়োগপ্রাপ্ত অনেকেই স্বাভাবিক পেশাদারিত্ব হিসেবেই নিয়েছেন এবং সেভাবে কাজ করছেন। বাকিদের কেউ কেউ হয়তো দলীয় মনোবৃত্তি থেকে বের হতে পারেনি। এ অবস্থায় ব্যবস্থাপনায় আমূল পরিবর্তন আনা হবে নতুন নেতৃত্বের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এটা ভালোভাবে করতে পারলে ব্যাংকটি ভালোভাবেই চলবে বলে তিনি নিশ্চিত করেন।
ব্যাংকটির শীর্ষ পর্যায়ে পরিবর্তনের পর ব্যাংকটির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম সমকালকে বলেন, ব্যাংকিং রীতিনীতি অনুসরণ করা হলে ব্যাংকটির পরিচালনায় ও ব্যবসায়িক কার্যক্রমে তেমন কোনো সমস্যা হবে না। ব্যাংকটির মালিকানা থেকে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্রমাগত সরে যাওয়ার প্রভাব সম্পর্কে জানতে চাইলে মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, 'এতেও তেমন কোনো পরিবর্তন হবে না। দেশে ৫৬টি ব্যাংক হওয়ার পরও এখনও ব্যাংকে বিনিয়োগে আগ্রহী লোকের অভাব নেই। ফলে বিদেশি শেয়ার বিক্রি করতে সমস্যা হবে না। শেয়ারবাজারের মাধ্যমে বিক্রি করলেও তা বিক্রি হয়ে যাবে।
তিনি বলেন, বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিনিধিরা ব্যাংকটির পর্ষদে ছিলেন। তারা ব্যবসাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। এ কারণে দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে ব্যাংকিং করেছেন। এখন ব্যবসায়িক দিক এবং ব্যাংকিংয়ের নীতি-নৈতিকতা মেনে ব্যাংকটি পরিচালিত হলে কোনো সমস্যা হবে না।
দেশি উদ্যোক্তা যারা ইতিমধ্যে ইসলামী ব্যাংকের শেয়ার কিনেছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো প্লাটিনাম এনডেভার্স, প্যারাডাইস ইন্টারন্যাশনাল, ব্লু ইন্টারন্যাশনাল, এবিসি ভেঞ্চার, গ্রান্ড বিজনেস, এক্সেল ডায়িং অ্যান্ড প্রিন্টিং, হযরত শাহজালাল (র.) ইন্ডাস্ট্রিয়াল সিটি।
এ প্রতিষ্ঠানগুলো গত বছরের মে থেকে পরবর্তী ৭-৮ মাসের মধ্যে শেয়ারবাজার থেকে শেয়ার কিনেছে। অবশ্য হযরত শাহজালাল (র.) ইন্ডাস্ট্রিয়াল সিটি এরই মধ্যে পুরো শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছে বলে জানা গেছে।
ইসলামী ব্যাংকের ওয়েবসাইট থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, জর্ডান ইসলামিক ব্যাংক, কাতারের ইসলামিক ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ করপোরেশন, দুবাই ইসলামিক ব্যাংক এবং বাহরাইন ইসলামিক ব্যাংক উদ্যোক্তা হিসেবে ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠাকালে বিনিয়োগ করেছিল। তবে এখন ইসলামী ব্যাংকে এ প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো শেয়ার নেই। এর মধ্যে দুবাই ইসলামিক ব্যাংক এবং বাহরাইন ইসলামিক ব্যাংক ২০১৪ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে শেয়ারবাজারের মাধ্যমে নিজেদের পুরো শেয়ার বিক্রি করেছে। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ার বিক্রির তথ্য পাওয়া যায়নি।
এদিকে কুয়েতের সরকারি ব্যাংক কুয়েত ফাইন্যান্স হাউসও নিজের প্রায় সাড়ে ৮ কোটি ৪৫ লাখ ৬৩ হাজার ৭৮২টি শেয়ার বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে, যা ইসলামী ব্যাংকের মোট শেয়ারের সোয়া ৫ শতাংশেরও বেশি। চট্টগ্রামভিত্তিক ব্যবসায়িক গ্রুপ এস আলম বা এর মালিকদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠান এ শেয়ার কিনতে পারে বলে জানা গেছে।
শেয়ার বিক্রি করে নিজ দেশে টাকা ফেরত নেওয়ার প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করতে সম্প্রতি কুয়েত ফাইন্যান্স হাউসের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন বলে বিশেষ সূত্রে জানা গেছে।
শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সালেই কুয়েতের প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের বিনিয়োগ প্রত্যাহারের উদ্যোগ নিয়েছিল। তবে নথিপত্রের ঘাটতি থাকায় ওই সময়ে শেয়ার বিক্রির অনুমতি দেয়নি বিএসইসি।
ইসলামী ব্যাংকে কুয়েত সরকারের আরও তিন প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ রয়েছে। এর মধ্যে দ্য পাবলিক ইনস্টিটিউট ফর সোশ্যাল সিকিউরিটির নামে ১০ কোটি ৪০ লাখ ৪৪ হাজার ৯৪১টি শেয়ার, দ্য পাবলিক অথরিটি ফর মাইরস অ্যাফেয়ার্স কুয়েতের ১ কোটি ৪৪ লাখ ৪৮ হাজার ৫৫২টি শেয়ার এবং কুয়েত ওয়াক্ফ পাবলিক ফাউন্ডেশনের ৬ কোটি ৯৩ লাখ ৪৮ হাজার ৮৩৬টি শেয়ার রয়েছে। কুয়েতের এই চার প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের পরিমাণ ইসলামী ব্যাংকের মোট শেয়ারের প্রায় ১৭ শতাংশ।
ইসলামী ব্যাংকে এখনও সৌদি আরবভিত্তিক ছয় ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে রয়েছে ৫৬ কোটি ৫৯ লাখ ৭৯ হাজার ৩৯৯টি শেয়ার, যা ব্যাংকটির মোট শেয়ারের ৩৫ শতাংশের কিছুটা বেশি। এর বাজারমূল্য (প্রতি শেয়ার ৩০ টাকা) প্রায় ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা।
জামায়াতে ইসলামীর ঘনিষ্ঠদের দ্বারা ১৯৮৩ সালে ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠার পর নিজেদের বিভিন্ন ব্যবসায়িক ও ইসলামিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের নামে শেয়ার নেন তারা। এ ছাড়া জামায়াত ঘনিষ্ঠদের প্রস্তাবে সৌদি আরব, কুয়েত, বাহরাইনের বেশ কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান প্রধান উদ্যোক্তা হিসেবে বিনিয়োগ করে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) সূত্রে জানা গেছে, দুবাই ইসলামিক ব্যাংক ২০১৪ সালের আগস্ট থেকে ২০১৫ সালের অক্টোবরের মধ্যে ধারণকৃত ইসলামী ব্যাংকের ১ কোটি ৩৭ লাখ ৩ হাজার ৫৪০টি শেয়ারের পুরোটা পাঁচ দফায় বিক্রি করেছে।
২০১৪ সালের জুন পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংকে বাহরাইনভিত্তিক বাহরাইন ইসলামিক ব্যাংকের শেয়ার ছিল ৪ লাখ ৬৫ হাজার ৮৪৪টি। দুই দফায় পুরো শেয়ার বিক্রি করে ওই বছরের অক্টোবরের মধ্যে নিজেদের বিনিয়োগের পুরোটা তুলে নিয়েছে ব্যাংকটি।সমকাল।