‘বেসিক ব্যাংক কর্মীদের অর্ধেক ছাঁটাই করা প্রয়োজন’

২০১৫ সালে বেসিক ব্যাংকের নিট লোকসান ছিল ৩১৪ কোটি টাকা। আর চলতি বছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) ব্যাংকটির পরিচালন লোকসান দাঁড়িয়েছে ২৯ কোটি টাকার মতো। খেলাপি ঋণের বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) সংরক্ষণের পর নিট লোকসান আরো বাড়বে বলে মনে করছেন ব্যাংক-সংশ্লিষ্টরা।
২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর শেষে বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৩৯২ কোটি টাকায়, যা ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ৫৩ শতাংশ। খেলাপি ঋণের এ পরিমাণ ব্যাংকটির মূলধনের তিন গুণ। ২০১৫ সাল পর্যন্ত বেসিক ব্যাংকের মূলধন (পরিশোধিত মূলধন, বিধিবদ্ধ ও অন্যান্য রিজার্ভ) ছিল ২ হাজার ৫৯৪ কোটি টাকা। গত দুই বছরে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা জোগান দেয়ার পরও চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ২ হাজার ৪২৩ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতিতে রয়েছে ব্যাংকটি। একই সময়ে প্রভিশন ঘাটতি ছাড়িয়েছে ৩ হাজার ৭৮৯ কোটি টাকা।
এ অবস্থায় বেসিক ব্যাংক চালু রাখা মানেই লোকসান বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ এ ধরনের আর্থিক বিপর্যয় থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর নজির দেশের ব্যাংকিং খাতে নেই। এর আগে ২০০৬ সালে ৬৫০ কোটি টাকার আর্থিক জালিয়াতির শিকার হয় ওরিয়েন্টাল ব্যাংক।
আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক লিমিটেডে রূপান্তর হওয়ার পরও ৭৭ শতাংশ খেলাপি ঋণ নিয়ে ধুঁকছে ব্যাংকটি। অর্ধেকের বেশি ঋণ খেলাপি হয়ে যাওয়ায় শিগগিরই বেসিক ব্যাংকের মুনাফায় ফেরার সুযোগ দেখছেন না বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমদ চৌধূরী।
তিনি বলেন, ব্যাংক যদি সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়, তাহলে এ বিপর্যয় ভবিষ্যতে আরো বড় ক্ষতের সৃষ্টি করবে। পরিস্থিতি বিবেচনায় মূলধন ঘাটতির পুরো অংশই হয়তো সরকারকে নিতে হবে। অথবা ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করে সরকার এক ব্যাংককে অন্য ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করে দেয়ার নীতি গ্রহণ করতে পারে। তবে এক্ষেত্রে সরকারের নীতিটি অবশ্যই বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ও দীর্ঘমেয়াদি হতে হবে। শুধু বেসিক ব্যাংককে অন্য ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করে দিলে এ সমস্যার সমাধান নাও হতে পারে।
বড় অংকের খেলাপি ঋণের কারণে ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে ব্যাংকটির সুদ বাবদ আয়। বেসিক ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৫ সালে ব্যাংকটির সুদ বাবদ আয় ছিল ৮২১ কোটি টাকা। একই সময়ে আমানতের বিপরীতে সুদ বাবদ ব্যয় ছিল ১ হাজার ১৩৫ কোটি টাকা। ফলে সুদ বাবদ ওই বছর বেসিক ব্যাংকের লোকসান দাঁড়িয়েছে ৩১৪ কোটি টাকা। আগের বছর এ খাতে লোকসানের পরিমাণ ছিল ১৩৯ কোটি টাকা।
ইকুইটির বিপরীতে মুনাফার হারও ধারাবাহিকভাবে কমছে ব্যাংকটির। ২০০৯ সালে বেসিক ব্যাংকের ইকুইটির বিপরীতে মুনাফার হার ছিল ১৮ দশমিক ৭৯ শতাংশ। ২০১৫ সালে তা নেমে আসে ঋণাত্মক ১২ দশমিক ১০ শতাংশে।
বিগত সময়ের অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে সৃষ্ট এ বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে আরো সময় প্রয়োজন বলে জানান বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন এ মজিদ। তিনি বলেন, বেসিক ব্যাংকে আমানতের সংকট নেই। সরকার যে টাকা দিচ্ছে, তা সরকারি বন্ডেই বিনিয়োগ করা হয়েছে। ব্যাংক যদি পরিচালন মুনাফায় আসতে পারে, তাহলে নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতি পূরণ করা যাবে। সঞ্চিতির ঘাটতি পূরণ হওয়ার পর ব্যাংক নিট মুনাফার দেখা পাবে। খেলাপি ঋণ কিছু আদায় হচ্ছে। কিছু গ্রাহক ব্যাংকে এসে ঋণ পুনর্গঠনের মাধ্যমে নিয়মিত করছেন।
ব্যাংক-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেসিক ব্যাংকের বিপর্যয়ের শুরু ২০০৯ সালে ব্যাংকটির তত্কালীন চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুর যোগদানের পর থেকে। ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৪ সালের ৬ জুলাই পর্যন্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। ওই সময়েই ঘটে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা। সে সময় বেসিক ব্যাংকের এমডির দায়িত্বে ছিলেন কাজী ফখরুল ইসলাম।
বেসিক ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, আবদুল হাই বাচ্চু চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেয়ার সময় ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল মাত্র ১৪১ কোটি টাকা, যা সে সময় পর্যন্ত বিতরণকৃত ঋণের ৪ শতাংশ। এর পর থেকেই বাড়তে থাকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। ২০১০ সালে বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ২২৪ কোটি টাকায়, যা সে সময় পর্যন্ত বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ৫ শতাংশ। ২০১১ সালে খেলাপি ঋণের হার সহনীয় পর্যায়ে থাকলেও ২০১২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় বিতরণকৃত ঋণের ৮ দশমিক ২২ শতাংশ। ২০১৩ সাল পর্যন্ত বেসিক ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের মধ্যে ১ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকাই খেলাপি হয়ে পড়ে। আবদুল হাই বাচ্চু দায়িত্ব ছাড়ার বছর ২০১৪ সালে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ৬ হাজার ৩১০ কোটি টাকায়। গত বছর তা ৬ হাজার ৩৯২ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। মন্দ মানে খেলাপি হওয়ায় এসব ঋণ আদায়ের সম্ভাবনা কম।
ব্যাংকটির মুনাফায় বিপর্যয়ও শুরু হয় ২০০৯ সালের পর থেকে। বেসিক ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০০৯ সালেও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটি প্রায় ৬৫ কোটি টাকা নিট মুনাফা করে। ২০১২ সালে তা কমে দাঁড়ায় ২ কোটি ৭৮ লাখ টাকায়। পরের বছর অর্থাত্ ২০১৩ সালে প্রথমবারের মতো লোকসানে পড়ে ব্যাংকটি। সে বছর নিট লোকসান হয় ৫৩ কোটি টাকা। ২০১৪ সালে লোকসানের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ১১০ কোটি টাকা। আর ২০১৫ সালে তা ৩০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়।
বাড়তি জনবল নিয়েও বিপত্তিতে আছে ব্যাংকটি। নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে কর্মী নিয়োগ দেয়ায় ব্যাংকটির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জনবলই এখন অতিরিক্ত। বেসিক ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৯ সালে ব্যাংকটিতে কর্মরত ছিলেন ৭৭৬ জন। আবদুল হাই বাচ্চু চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দেয়ার পর ২০১০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৯৬৪ জনে। ২০১১ সালে জনবল আরো বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ১৩২, ২০১২ সালে ১ হাজার ৬৫৭, ২০১৩ সালে ২ হাজার ১৪৫ ও ২০১৪ সালে ২ হাজার ২৩৭ জনে। অর্থাত্ আবদুল হাই বাচ্চু দায়িত্ব নেয়ার পাঁচ বছরে ব্যাংকের জনবল বেড়ে হয়েছে তিন গুণ।
বাড়তি এ জনবলের বিষয়ে আলাউদ্দিন এ মজিদ বলেন, এ ধরনের একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যয় কমানোর জন্য কর্মীদের অর্ধেক ছাঁটাই করা প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে সেটি সম্ভব নয়। অনেক কর্মকর্তার বেতন কমিয়ে দেয়া হয়েছে।
তবে এখনো যতটুকু সুযোগ আছে, তার সবটুকু কাজে লাগাতে পারলে দীর্ঘমেয়াদে বেসিক ব্যাংকের ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা দেখছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা।
তিনি বলেন, মানসম্পন্ন নতুন ঋণ বিতরণ, আমানত বৃদ্ধি, খেলাপি ঋণ আদায়ে ব্যাংক যদি কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারে, তবেই সেটা সম্ভব হবে। এ মুহূর্তে বেসিক ব্যাংক ভালো কিছু করার চেষ্টা করছে বলেই আমার ধারণা। কিন্তু কার্যকর ভালো কিছু করতে হলে বেসিক ব্যাংককে দৌড়াতে হবে। স্বাভাবিক গতিতে চললে সেটা সম্ভব নয়।সূত্র: বণিকবার্তা।