খেলাপি ঋণ বাড়ল আরও চার হাজার কোটি টাকা

বাংলাদেশ ব্যাংক ও ব্যাংকগুলোর নানা উদ্যোগের পরও খেলাপি ঋণ না কমে ধারাবাহিকভাবে বেড়েই চলেছে। গত তিন মাসে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ আরও চার হাজার কোটি টাকা বেড়ে জুনে এসে হয়েছে ৬৩ হাজার ৩৬৫ কোটি টাকা। আগের তিন মাসে বেড়েছিল ৮ হাজার ৪০ কোটি টাকা। একটানা বাড়তে থাকায় জুনে এসে খেলাপি ঋণের হার দুই অঙ্ক ছাড়িয়েছে। অর্থাৎ ব্যাংকগুলোর মোট ঋণের ১০ ভাগের বেশি এখন খেলাপি ঋণ।
আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং রীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ২০১৩ সাল থেকে নতুন পদ্ধতিতে ঋণ শ্রেণিকরণ করছে ব্যাংকগুলো। নতুন নিয়মে ব্যাপক পরিবর্তনের ফলে ওই সময় খেলাপি ঋণ হু-হু করে বাড়ছিল। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ওই বছরের বেশিরভাগ সময়জুড়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকায় ব্যবসা-বাণিজ্য ভালো যাচ্ছিল না। এসব কারণে খেলাপি ঋণ ২০১৩ সাল শেষে ৮ দশমিক ৯৩ শতাংশ থেকে বেড়ে পরের বছরের মার্চে গিয়ে ১০ দশমিক ৪৫ শতাংশে ঠেকে। দুই অঙ্ক ছাড়ানোর পর বিভিন্ন পক্ষের সমালোচনা শুরু হয়। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত নিজেও খেলাপি ঋণ এক অঙ্কে সীমিত না রাখতে পারায় সমালোচনা করেন। নানা সমালোচনার মুখে খেলাপি ঋণ কমানোর উদ্যোগ নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
খেলাপি হয়ে পড়া ঋণ নিয়মিত করতে ওই সময়ে শিথিল শর্তে ঋণ পুনঃতফসিল করার সুযোগ দেওয়া হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেওয়া বিশেষ সুযোগ নিয়ে ২০১৪ ও ২০১৫ সালে শিথিল শর্তে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিল করে ব্যাংকগুলো। এ ছাড়া ব্যাংক খাতে ৫০০ কোটি টাকার বেশি ঋণ রয়েছে এমন ১১টি প্রতিষ্ঠান বিশেষ সুবিধা নিয়ে ১৫ হাজার ২১৮ কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠন করে। বিপুল অঙ্কের এ খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার ফলে খেলাপি ঋণ স্বাভাবিকভাবে কমার কথা। তবে তা না কমে গত ৬ মাসে বেড়েছে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা। মূলত যেনতেনভাবে পুনঃতফসিল করা ওইসব ঋণের বড় অংশ আবার খেলাপি হয়ে পড়ায় এমন হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি আনিস এ খান বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্য এখন স্থিতিশীল রয়েছে। এতে করে নতুন ঋণ খুব একটা আর খেলাপি হচ্ছে না। তবে এর আগে বিশেষ বিবেচনায় পুনঃতফসিল করা ঋণ আদায় না হওয়ায় খেলাপি ঋণ বাড়ছে।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, জুন পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ছয় লাখ ৩০ হাজার ১৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হওয়া ৬৩ হাজার ৩৬৫ কোটি টাকা যা মোট ঋণের ১০ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। আগের প্রান্তিক পর্যন্ত বিতরণ করা পাঁচ লাখ ৯৮ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকার মধ্যে খেলাপি হয়েছিল ৫৯ হাজার ৪১১ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। এর আগের প্রান্তিক ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ৫১ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা, যা ৮ দশমিক ৭৯ শতাংশ।
প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, গত প্রান্তিকে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ দুই হাজার ৭৮৮ কোটি টাকা বেড়ে ৩০ হাজার ৭৭ কোটি টাকা হয়েছে। হার দাঁড়িয়েছে ২৫ দশমিক ৭৪ শতাংশ। আগের প্রান্তিকে এসব ব্যাংকের তিন হাজার ৫৪৪ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ বেড়ে ২৭ হাজার ২৮৯ কোটি টাকা হয়। বিশেষায়িত দুই ব্যাংকে খেলাপি ঋণ আগের প্রান্তিকের তুলনায় ৮৪৮ কোটি টাকা বেড়ে হয়েছে ৫ হাজার ৮১৭ কোটি টাকা। হার দাঁড়িয়েছে ২৬ দশমিক ১৪ শতাংশ।
আশার বিষয় হলো, সামগ্রিক ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বাড়লেও বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে ১৬ কোটি টাকা কমেছে। আগের প্রান্তিকে অবশ্য এসব ব্যাংকে খেলাপি ঋণ চার হাজার ৫৭১ কোটি টাকা বেড়ে হয়েছিল ২৫ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা। এতে করে আগে যেখানে মোট ঋণের ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ খেলাপি ছিল, এখন কমে ৫ দশমিক ৪৪ শতাংশে নেমেছে। আর বিদেশি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ আগের প্রান্তিকের এক হাজার ৮২২ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে দুই হাজার ১৫৭ কোটি টাকা।