English Version
আপডেট : ২৯ জানুয়ারি, ২০১৬ ১৪:১৩

শীতের সবজি : কৃষকের শ্রমে লাভ যায় মধ্যস্বত্বভোগীর ঘরে

নিজস্ব প্রতিবেদক
শীতের সবজি : কৃষকের শ্রমে লাভ যায় মধ্যস্বত্বভোগীর ঘরে

 

ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরের তালিনা গ্রামের কৃষক মো. শহিদুল ইসলাম। চলতি বছর এক বিঘা জমিতে শিম চাষে তার খরচ হয় প্রায় ১৫ হাজার টাকা। কিন্তু বর্তমান বাজারে সবজির যে দাম, তাতে হয়তো চার মাস পর ৩০ শতাংশ মুনাফা ঘরে তুলতে পারবেন তিনি। অন্যদিকে একই এলাকার মধ্যস্বত্বভোগী ছালাম কৃষকের উৎপাদন করা সবজি প্রতি কেজি ৮ টাকায় কিনে পাইকারের কাছে ৯ টাকায় বিক্রি করছেন। এতে একদিনেই তার মুনাফা হয় ১২ শতাংশের বেশি।

এ সবজি ভোক্তা পর্যন্ত যেতে প্রতি কেজির দাম পড়বে প্রায় ৩০ টাকা, যা কৃষকের পাওয়া দামের তিন গুণেরও বেশি। এ বাড়তি দামের সবই যাচ্ছে বিপণনকারীর পকেটে। সবজিতে কৃষক ও মধ্যস্বত্বভোগীর মুনাফার এ পার্থক্যের চিত্র উঠে এসেছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায়ও।

ওই গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, বিদ্যমান ব্যবস্থায় সবজি উত্পাদনকারী তিন-চার মাসের জন্য ১০০ টাকা বিনিয়োগ করে ৩০-৪০ টাকা মুনাফা করতে পারে। অথচ আড়তদার ও বেপারিরা অতি অল্প সময়ের (এক থেকে দুদিন) ব্যবধানে ১০০ টাকা বিনিয়োগ করে ১৪-১৭ টাকা মুনাফা করতে সক্ষম হয়। গবেষণায় ১০টির অধিক সবজির উৎপাদন ব্যয়, বিপণন খরচ এবং বাজার তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

গবেষণায় বলা হয়েছে, সবজি বিপণনের আধুনিক বাজারজাতকরণ ব্যবস্থা না থাকা এবং বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধা কার্যকরভাবে ব্যবহার না করতে পারার কারণে ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না কৃষক। এছাড়া যথাযথ সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াকরণ ও রফতানি করতে না পারার কারণে তেমন লাভবান হতে পারছেন না তারা।

অন্যদিকে উৎপাদিত পণ্য মজুদে কৃষকের অক্ষমতার সুযোগ নিচ্ছেন মধ্যস্বত্ব্বভোগীরা। তাদের কাছে কম দামে সবজি বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন কৃষকরা। এ বিষয়ে কৃষক শহিদুল ইসলাম বলেন, পরিপক্ব হয়ে যাওয়ায় প্রায় দু-একদিন পর পর ক্ষেত থেকে সবজি তুলতে হয়। কিন্তু মজুদের ব্যবস্থা না থাকায় কম দামে হলেও পাইকারদের কাছে বেচে দিতে হয় তা। এ অবস্থায় পাইকাররা যে দাম দেন তা মেনে নিতে কষ্ট হয় আমাদের। অনেক সময় উৎপাদন খরচ ওঠানো মুশকিল হয়ে পড়ে।

‘পুষ্টি নিরাপত্তা ও দারিদ্র্য দূরীকরণে বছরব্যাপী হরেক রকম সবজি চাষ’ শীর্ষক ওই গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশের আবাদি জমির পরিমাণ ৮৫ লাখ হেক্টর। এর মধ্যে সবজি আবাদে ব্যবহূত হচ্ছে প্রায় ৮ লাখ হেক্টর জমি, যা মোট জমির মাত্র ৯.৩৮ শতাংশ। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সবজি উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৪২ লাখ ৩০ হাজার টন। এর আগে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে শীত ও গ্রীষ্ম মিলে ১ কোটি ৩৫ লাখ, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ১ কোটি ২৬ লাখ ও ২০১১-১২ অর্থবছরে ১ কোটি ২৫ লাখ টন সবজি উত্পাদন হয়।

সবজি উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান এখন তৃতীয়। তা সত্ত্বেও দেশে মাথাপিছু সবজি সরবরাহ এখনো অনেক কম। একজন সুস্থ-সবল মানুষের প্রতিদিন ২২০ গ্রাম সবজি গ্রহণের প্রয়োজন হলেও এর বিপরীতে সরবরাহ হচ্ছে মাত্র ৭০ গ্রাম।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ বিশাল ঘাটতি পূরণ করতে হলে সবজির চাষ বাড়াতে হবে এবং বছরব্যাপী কী কী ধরনের সবজি কখন লাগানো যায়, সেটি কৃষকদের জানাতে হবে। জমির পাশাপাশি বাড়ির আঙিনা, বাড়ির ছাদ, পানিতে মাচা করে, ঘরের চালায়, চরাঞ্চলে, উপকূলীয় অঞ্চলে, ভাসমান এবং হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে সবজি চাষ করা যেতে পারে। তবে আবাদ উত্সাহিত করতে হলে সবজিচাষীর ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার বিষয়টিও ভাবতে হবে।

এ বিষয়ে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোভাইস চ্যান্সেলর ও ওই গবেষণার সংশ্লিষ্ট গবেষক ড. মো. শহীদুর রশীদ ভূঁইয়া বলেন, কৃষকের উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনার পাশাপাশি বিপণন ব্যবস্থার দুর্বলতাগুলোকে অতি দ্রুত নিরসন করতে হবে। তা না হলে সবজি উত্পাদনে বিশ্বে তৃতীয় অবস্থান ধরে রাখা সম্ভব হবে না। এজন্য দেশের অভ্যন্তরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সবজির জাত সংগ্রহ ও মূল্যায়ন করে তা নতুন জাত হিসেবে অবমুক্ত করতে হবে। এছাড়া বিদেশ থেকে ব্রিডিং লাইন প্র্রবর্তন করে তা থেকে জাত অবমুক্ত করতে হবে। সবজি জার্মপ্লাজমকে কাজে লাগিয়ে সংকরীকরণ করা এবং তা থেকে উত্তম জাত বাছাই করতে হবে। এছাড়া সবজিতে মিউটেশন ঘটিয়ে জাত উন্নয়ন ও  ট্রান্সজেনিক সবজির জাত অবমুক্ত করতে হবে।

বর্তমানে দেশে প্রায় ৮০ রকমের সবজি রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান সবজি ২৫টি ও অপ্রধান ৩৫টি। বাকিগুলো স্বল্প পরিচিত সবজি। আর ২০১৫ সাল পর্যন্ত এ দেশে সরকারি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক অবমুক্ত সবজি জাতের সংখ্যা ১১৮টি। এর মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান অবমুক্ত করেছে ১০০টি জাত, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় অবমুক্ত করেছে আটটি সবজি জাত আর বিআইএনএ ১০টি টমেটোর জাত অবমুক্ত করেছে।