মুখোমুখি কেন্দ্রীয় ব্যাংক-ফারমার্স ব্যাংক ও সংসদীয় কমিটি

বিভিন্ন সমীক্ষা প্রতিবেদনে বহুভাবে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর অনিয়ম-অব্যবস্থাপনার চিত্র উঠে আসা নতুন কিছু নয়। কিন্তু হালের নতুন প্রজন্মের ব্যাংকগুলোও এই প্রক্রিয়ায় জড়িয়ে পড়ছে। এরই ধারাবাহিকতায় নতুন প্রজন্মের ব্যাংক ফারমার্স ব্যাংকের ঋণ বিতরণে অনিয়মের কারণে তাদের আর্থিক কর্মকাণ্ড নিরীক্ষা করতে সেখানে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। মূলত এ নিয়ে এক ধরণের অস্বস্তি তৈরি হয় বাংলাদেশ ব্যাংক ও ফারমার্স ব্যাংকের উর্ধ্বতনদের মধ্যে। অন্যদিকে ব্যাংক ব্যবস্থা-অর্থমন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়ে সম্প্রতি কড়া মন্তব্য করেছেন জনপ্রশাসনমন্ত্রী। আবার ফারমার্স ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগের চারদিনের মাথায় সরকারি হিসাব-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক কর্মকাণ্ডের নিরীক্ষা প্রতিবেদন চেয়েছে। যে কমিটির প্রধান ও ফারমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যান হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর । এই বিষয়গুলো দেশের ব্যাংকখাতে নানান জল্পনা-কল্পনার সৃষ্টি করেছে। তারই প্রেক্ষিতে পুরো ঘটনার উপর আলোকপাত করা জরুরি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক কর্মকাণ্ডের নিরীক্ষা প্রতিবেদন চেয়েছে সরকারি হিসাব-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি। ঋণ বিতরণ অনিয়মের কারণে গত বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংক ফারমার্স ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ করেছে। এ পদক্ষেপের ঠিক চারদিন পর গতকাল এ সংসদীয় কমিটি বাংলাদেশ ব্যাংকে বিশেষ নিরীক্ষা পরিচালনার সুপারিশ করল।
ফারমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যান মহীউদ্দীন খান আলমগীর সরকারি হিসাব-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিরও সভাপতি পদে রয়েছেন। এদিকে সংসদের কার্যপ্রণালি বিধিতে বলা আছে, কোনো কমিটিতে সাংসদের ব্যক্তিগত স্বার্থ বিবেচিত হওয়ার সুযোগ থাকলে সেই সাংসদ ওই কমিটির সদস্য বা সভাপতি হতে পারবেন না।
এ প্রসঙ্গে সংসদ-বিষয়ক গবেষক অধ্যাপক নিজাম আহমেদ বলেন, যেকোনো প্রতিষ্ঠানের নিরীক্ষা প্রতিবেদন যাচাই করা সরকারি হিসাব কমিটির দায়িত্ব। কিন্তু কমিটির সভাপতি একটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান এবং অনিয়মের কারণে কয়েক দিন আগে তার ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সুতরাং এই অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংকের নিরীক্ষা প্রতিবেদন তলব করা অনৈতিক।
এ নিয়ে মহীউদ্দীন খান আলমগীর গতকাল রাতে একাধিক গনমাধ্যমকে বলেন, কোনো বিষয়কে ব্যক্তিগতভাবে নেওয়ার সুযোগ সংসদীয় কমিটির নেই। সেটা নেওয়া উচিতও নয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুসন্ধানে ফারমার্স ব্যাংকে বেশ কিছু ঋণ অনিয়মের ঘটনা উদ্ঘাটিত হয়। নামে-বেনামে অস্তিত্বহীন কোম্পানির বিপরীতেও বড় অঙ্কের ঋণ অনুমোদন করা হয়। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক শেষ পর্যন্ত পর্যবেক্ষক নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়। বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয় জন্ডিসে ভুগছে জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের এমন মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতেই কমিটি এই সুপারিশ করেছে। আর বৈঠকে প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেন জাতীয় পার্টির সাংসদ এ কে এম মাইদুল ইসলাম।
গত শনিবার কিশোরগঞ্জ সার্কিট হাউস মিলনায়তনে এক আলোচনায় সৈয়দ আশরাফ বলেছিলেন, অর্থমন্ত্রী, তার মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংক এখন জন্ডিসে আক্রান্ত। বিশ্বে এমন কোনো দেশ নেই, যেখানে ব্যবসায়ীরা ব্যবসায় বিনিয়োগের জন্য ব্যাংক থেকে ১৫-১৮ শতাংশ হারে সুদ দিয়ে ঋণ নেন। একমাত্র বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে এই অরাজক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এ দেশের ব্যবসায়ীরা উচ্চহারে সুদ দিয়ে ব্যবসা করতে বাধ্য হচ্ছেন। এই অতিরিক্ত সুদের হারই বাংলাদেশে বিনিয়োগ কমে যাওয়ার একটি বড় কারণ।
সংসদীয় কমিটির বৈঠক শেষে কমিটির একাধিক সদস্য বলেন, পত্রিকায় খবর এসেছে, জনপ্রশাসনমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থমন্ত্রী জন্ডিসে আক্রান্ত। যেহেতু জনপ্রশাসনমন্ত্রী কথাটি বলেছেন, তাই কমিটি মনে করে, তার কথার কোনো না কোনো ভিত্তি আছে। সে জন্য কমিটি বাংলাদেশ ব্যাংকের নিরীক্ষা প্রতিবেদন নিয়ে পর্যালোচনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এনিয়ে রোববার রাতে গনমাধ্যমে ভিন্ন বক্তব্য দিয়েছেন মহীউদ্দীন খান আলমগীর। তিনি বলেন, সৈয়দ আশরাফ বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটা নিয়ে কমিটিতে আলোচনা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র বলছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) নির্দেশনা অনুযায়ী আন্তর্জাতিক নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান দিয়ে নিরীক্ষা করাতে হয় তাদের। সেই প্রতিবেদন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, যদি মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় থেকে স্বাভাবিক ও সাধারণ নিয়মে বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর নিরীক্ষা হয়ে থাকে, তাহলে তো এখনো সেই একই নিয়মেই সেটি হতে পারে। এজন্য তো সংসদীয় কমিটির সুপারিশের কোনো দরকার পড়ে না।
তিনি আরও বলেন, সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক ফারমার্স ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়েছে। ওই ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও সরকারি হিসাব-সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সভাপতি একই ব্যক্তি। তাই স্বাভাবিকভাবে সংসদীয় কমিটির এ ধরনের সিদ্ধান্তে জনমনে সন্দেহ তৈরি হতে পারে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, ‘ব্যাংকটি শুরু থেকে নানা ধরণের অনিয়মের সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়ে ফেলেছে, বার বার সতর্ক করেও কোন প্রকার লাভ হয়নি। ব্যাংকটি শুরু থেকে এগ্রেসিভ ঋণ বিতরণ করে যাচ্ছে। নানাভাবে গ্রাহকের টাকা জালিয়াতি করে তুলে নিচ্ছে। অভ্যন্তরীন শৃঙ্খলার কোন বালাই নেই। সেখানে আসলে পর্যবেক্ষক না দিয়ে অন্য কোন উপায় ছিল না।’
সর্বশেষ ব্যাংকটির গুলশান, মতিঝিল ও শ্যামপুর শাখায় ব্যপাক অনিয়মের চিত্র উৎঘাটন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পৃথক কয়েকটি তদন্তের মাধ্যমে গুরুতর অনিয়মগুলো বেরিয়ে আসে। অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানে ঋণ, ভুয়া প্রতিষ্ঠানে ঋণ, এক খাতের ঋণ অন্য খাতে ব্যবহারসহ গুরুতর সব অনিয়ম করে ফারমার্স ব্যাংক। গুলশান শাখায় প্রায় ৭০০ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হয়। এর মধ্যে ২০০ কোটি টাকার ঋণ অনিয়মের চিত্র উঠে এসেছে। মতিঝিল শাখায় ৩০০ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হয়। এর মধ্যে ২০০ কোটি টাকার অনিয়ম সংঘটিত হয়। আর শ্যামপুর শাখায় প্রায় ৬৭ কোটি টাকার ঋণ বিতরণের সব ঋণই অনিয়ম হিসেবে চিহ্নিত করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালী ও কৃষি ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয়।
উল্লেখ্য, অভ্যন্তরীন ব্যবস্থাপনা ও ঋণ-শৃঙ্খলা ফেরাতে ফারমার্স ব্যাংকে ১৩ জানুয়ারি পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নতুন প্রজন্মের ৯টি ব্যাংকের মধ্যে এই প্রথম কোনো একটি ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয়া হলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা বিনিয়োগ বিভাগের মহাব্যবস্থাপক আনম আবুল কাশেমকে এ ব্যাংকটিতে পর্যবেক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তিনি ব্যাংকটির ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ, ক্রেডিট ও অডিট কমিটিসহ গুরুত্বপূর্ণ সব বৈঠকে উপস্থিত থাকবেন এবং তাদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করবেন।
গত বুধবার ব্যাংকটির পর্ষদের চেয়ারম্যানের কাছে পর্যবেক্ষক নিয়োগের চিঠি পাঠানো হয়েছে উল্লেখ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র বলেন, ‘ব্যাংকটির অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনায় চরম অবনতি ঘটায় সেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে একজন পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ব্যাংকটির অভ্যন্তরীন ব্যবস্থাপনা ও ঋণ-ঝুঁকি মেকাবেলায় পর্যবেক্ষক কাজ করবেন।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের অফসাইট সুপারভিশন বিভাগ থেকে ব্যাংকগুলোর চেয়ারম্যানের কাছে পাঠানো এ-সংক্রান্ত চিঠিতে বলা হয়েছে, পর্যবেক্ষকরা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ, ক্রেডিট ও অডিট কমিটিসহ গুরুত্বপূর্ণ সব বৈঠকে উপস্থিত থাকবেন। এছাড়া যেকোনো বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার তিন কর্মদিবস আগে সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র পর্যবেক্ষকের কাছে পাঠাতে হবে। ব্যাংকের আর্থিক সূচক উন্নত না হওয়া পর্যন্ত সার্বক্ষণিক মনিটরিংয়ের দায়িত্বে থাকবেন পর্যবেক্ষক। বর্তমানে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্যদের চেয়াম্যান হিসেবে দায়িত্বরত রয়েছে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহিউদ্দীন খান আলমগীর।