English Version
আপডেট : ১৩ জানুয়ারি, ২০১৬ ১৩:৩৯

সমীক্ষা বলছে, পোশাক শিল্পে অধিকাংশ শ্রমিক অদক্ষ

নিজস্ব প্রতিবেদক
সমীক্ষা বলছে, পোশাক শিল্পে অধিকাংশ শ্রমিক অদক্ষ
ফাইল ছবি

কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে স্বাধীনতা-পরবর্তী অবস্থায় শিল্প বলতে ছিল শুধু পাট। আশির দশকে পোশাক শিল্প আবির্ভূত হয় নতুন খাত হিসেবে। ক্রমেই অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে শিল্পটি। দেশের রফতানি আয়, মূল্যসংযোজন ও কর্মসংস্থানের মতো ক্ষেত্রগুলোয় এর ভূমিকা ধীরে ধীরে বাড়ছে। বর্তমানে প্রায় ৫ হাজার ৬০০ পোশাক কারখানায় নারী-পুরুষ মিলে ৪০ লাখ শ্রমিক কর্মরত। প্রায় ২ হাজার ৬০০ কোটি ডলার উপার্জনের কারিগর এ শ্রমিকদের অধিকাংশই অদক্ষ। সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা যায়, পোশাক শিল্পে থাকা সাতটি গ্রেডের চারটিতেই কাজ করছেন আধা ও অদক্ষ শ্রমিক।

২০১৪ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি দেশের ১৭৩টি পোশাক কারখানার ১ হাজার ২০৪ জন শ্রমিকের ওপর জরিপ চালায় বেসরকারি গবেষণা সংস্থা এশিয়ান সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট (এসিডি)। সম্প্রতি জরিপের ফলাফল প্রতিবেদন আকারে প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। ‘গার্মেন্ট ওয়ার্কার্স ইন বাংলাদেশ: সোস্যাল ইম্প্যাক্ট অব দ্য গার্মেন্ট ইন্ডাস্ট্রি’ শীর্ষক এ প্রতিবেদনে পোশাক শিল্পে ১ থেকে ৭ গ্রেডের চারটিতে অদক্ষ শ্রমিকের আধিপত্য প্রকাশ পেয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিল্পে নিয়োজিত শ্রমিকদের জন্য একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক গবেষণার লক্ষ্যে জরিপ পরিচালনা করা হয়। এর মাধ্যমে শ্রমিক ও তাদের পরিবারের জীবন এবং সমাজে তাদের জীবনযাপনের প্রভাব মূল্যায়ন করা হয়েছে। সুনির্দিষ্টভাবে পোশাক শিল্পের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন, শ্রমিক ও তাদের পরিবারের স্বাস্থ্য-শিক্ষা উন্নয়ন এবং পরিবারে নারী শ্রমিকের ক্ষমতায়নের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতেই সমীক্ষাটি করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে শ্রমিক ও কর্মক্ষেত্র বিভাগে বলা হয়েছে, পোশাক কারখানার সাতটি গ্রেডের মধ্যে ১ ও ২ বাদে বাকি সব ক’টিতেই নারী শ্রমিকের অংশগ্রহণ বেশি। এছাড়া দক্ষ ও অদক্ষ মিলিয়ে সব শ্রমিকের মধ্যেও নারীর অংশগ্রহণ বেশি।

সমীক্ষায় দেখা গেছে, গ্রেড ৭ ও ৬-এ অদক্ষ শ্রমিকের হার সবচেয়ে বেশি। গ্রেড ৭-এ নারী-পুরুষ মিলিয়ে অদক্ষ শ্রমিকের হার ১৯ দশমিক ৭৭ শতাংশ। গ্রেড ৬-এ ১৪ দশমিক ৮৬ শতাংশ শ্রমিক অদক্ষ। গ্রেড ৪ ও ৫-এ রয়েছে আধা দক্ষ নারী-পুরুষ শ্রমিক। এর মধ্যে গ্রেড ৪-এ ২১ দশমিক ৯২ শতাংশ শ্রমিক আধা দক্ষ। আর গ্রেড ৫-এ ১৯ দশমিক ২৬ শতাংশ শ্রমিক আধা দক্ষ। গ্রেড ১ থেকে ৩-এ অদক্ষ নারী-পুরুষ শ্রমিকের হার সবচেয়ে কম।

এ প্রসঙ্গে এসিডির নির্বাহী পরিচালক ড. এ কে এনামুল হক বলেন, পোশাক শিল্প শ্রমিকদের প্রকৃত চিত্র তুলে আনতেই সমীক্ষাটি করা হয়েছে। খাতটি সামনের দিকে আরো এগিয়ে নিতে অদক্ষ শ্রমিকের দিকে মনোযোগ দেয়া খুবই জরুরি।

পোশাক শিল্পে নিম্নতম মজুরি-সংক্রান্ত শ্রম মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, গ্রেড ১-এ কর্মরত শ্রমিকরা হলেন প্যাটার্ন মাস্টার, চিফ কোয়ালিটি কন্ট্রোলার, চিফ কাটিং মাস্টার/কাটিং চিফ ও চিফ মেকানিক। মেকানিক/ইলেকট্রিশিয়ান ও কাটিং মাস্টার গ্রেড ২-এর অন্তর্ভুক্ত। গ্রেড ৩-এর শ্রমিকরা হলেন স্যাম্পল মেশিনিস্ট, মেকানিক, সিনিয়র সেলাই মেশিন অপারেটর, সিনিয়র উইন্ডিং মেশিন অপারেটর, সিনিয়র নিটিং মেশিন অপারেটর, সিনিয়র লিংকিং মেশিন অপারেটর, সিনিয়র কাটার, সিনিয়র কোয়ালিটি ইন্সপেক্টর, সিনিয়র মার্কার, সিনিয়র লাইন লিডার, সিনিয়র ওভারলক মেশিন অপারেটর, সিনিয়র বাটন মেশিন অপারেটর ও সিনিয়র কাঞ্চাই মেশিন অপারেটর। এ তিন গ্রেডের শ্রমিকদের মজুরি ন্যূনতম ৬ হাজার ৮০৫ থেকে ১৩ হাজার টাকা পর্যন্ত।

গ্রেড ৪ ও ৫-এ অন্তর্ভুক্ত শ্রমিকদের মধ্যে আছেন সিনিয়র ও জুনিয়র সেলাই মেশিন অপারেটর, উইন্ডিং মেশিন অপারেটর, নিটিং মেশিন অপারেটর ও লিংকিং মেশিন অপারেটর। এ শ্রমিকদের মজুরি ন্যূনতম ৬ হাজার ৪২ থেকে ৬ হাজার ৪২০ টাকা পর্যন্ত। এ শ্রমিকরা মূলত আধা দক্ষ। গ্রেড ৬ ও ৭-এ নিয়োজিত শ্রমিকরা কাজ করেন সাধারণ ও সহকারী সেলাই মেশিন অপারেটর, উইন্ডিং মেশিন অপারেটর, নিটিং মেশিন অপারেটর, লিংকিং মেশিন অপারেটর ও মেন্ডিং অপারেটর হিসেবে। এ শ্রমিকদের মজুরি ৫ হাজার ৩০০ থেকে ৫ হাজার ৯৭৮ টাকা পর্যন্ত।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খাতসংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো শ্রমিকের দক্ষতা বৃদ্ধিতে কাজ করছে। প্রশিক্ষণের মাধ্যমেই তারা এ চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। তবে দক্ষ ও আধা দক্ষ শ্রমিকদের প্রশিক্ষণের বিষয়েই তাদের মনোযোগ বেশি। এতে নিম্ন গ্রেডের দক্ষতারও উন্নয়ন তেমন ঘটছে না। আবার এক কারখানা থেকে অন্য কারখানায় মাইগ্রেশনও এ শ্রমিকরাই বেশি করছে।

পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, পোশাক খাতে শ্রমিক সংখ্যা ৪০ লাখেরও বেশি। এদের মধ্যে মূলত ৭ নম্বর গ্রেডের শ্রমিকদের অদক্ষতার হার বেশি। ৩ ও ৪ নম্বর গ্রেডে দক্ষ শ্রমিকের হার বেশি। তবে অদক্ষতা থাকবেই। রাতারাতি এটা দূর করা যাবে না। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। আর সংগঠন ও বেসরকারিভাবে শ্রমিকের দক্ষতা বৃদ্ধিতে প্রশিক্ষণের উদ্যোগ থাকলেও তা পর্যাপ্ত নয়। দক্ষতা বৃদ্ধি প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের মধ্যে সমন্বয় করলে পর্যায়ক্রমে শিল্পে অদক্ষতার হার কমে আসবে।

জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রনি বলেন, শ্রমিকের দক্ষতা বৃদ্ধির প্রয়াস সরকারি-বেসরকারি উভয় পক্ষ থেকেই কাম্য। তবে এ বিষয়ে তেমন কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেই। যাও আছে তাও নামমাত্র শুধু।