গণবদলির কারণে কর্ণফুলী পেপার মিলে উৎপাদন বন্ধের আশঙ্কা

গণবদলির কারণে উৎপাদন বন্ধের শঙ্কায় পড়েছে দেশের সর্ববৃহৎ কাগজকল কর্ণফুলী পেপার মিলস লিমিটেড (কেপিএম)। আলোচনা ছাড়াই গোপনে বদলি আদেশের ফলে টানা বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করছেন শ্রমিক-কর্মচারীরা। পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রতিষ্ঠানটিতে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। জানা গেছে, পূর্বঘোষণা ছাড়াই ৬ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠানটির ৩০২ জন শ্রমিক-কর্মচারী ও কর্মকর্তাকে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) নিয়ন্ত্রণাধীন টিএসপি, সিআইএফএল, ডিএপি ও ইউজিএস সার কারখানায় বদলি করা হয়। কেপিএমের আর্থিক অবস্থা বিবেচনায় এ বদলি করা হয় বলে জানানো হয়। বদলিকৃতদের ২৮২ জন শ্রমিক। এর মধ্যে ট্রেড ইউনিয়নের কার্যকরী কমিটির দায়িত্বে থাকা বেশক’জন শ্রমিক-কর্মচারী রয়েছেন। ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় গত বৃহস্পতিবার রাতে কেপিএমের সামনে কয়েকশ শ্রমিক বিক্ষোভ করেছেন। পরে প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠকের আশ্বাসে বিক্ষোভ কর্মসূচি স্থগিত করা হয়।
শ্রম আইন, ২০০৬-এর ১৮৭ ধারা অনুযায়ী ‘কোনো ট্রেড ইউনিয়নের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদক ও অর্থ সম্পাদককে সম্মতি ব্যতিরেকে এক জেলা থেকে অন্য জেলায় বদলি করা যাবে না।’ অথচ কেপিএম ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন লিমিটেডের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক, কেপিএম শ্রমিক-কর্মচারী পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান সাংগঠনিক সম্পাদককে আইনের বদলি করা হয়েছে। শ্রমিক-কর্মচারীরা গণবদলির বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। দাবি মানা না হলে কঠোর কর্মসূচির পাশাপাশি আইনি লড়াইয়ের ঘোষণা আসতে পারে বলে জানিয়েছেন শ্রমিক নেতারা।
কেপিএমের সিবিএ সভাপতি তৌহিদ আল মাহবুব চৌধুরী এ বিষয়ে বলেন, কেপিএমের রুগ্ণ দশা থেকে উত্তরণে শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে ১১ জানুয়ারি বৈঠকের কথা ছিল। এর আগেই কর্তৃপক্ষ প্রায় ৩০০ শ্রমিক-কর্মচারীকে আইন লঙ্ঘন করে বদলির আদেশ দিয়েছে। আমরা এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে চিঠির পাশাপাশি যুগ্ম শ্রম আদালতেও চিঠি দিয়েছি। আগামীকাল (আজ সোমবার) ঢাকায় বিসিআইসি শ্রমিক ফেডারেশনের বৈঠক রয়েছে। বিসিআইসি দাবি না মানলে পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আইনি প্রক্রিয়ায় তা সমাধান করা হবে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, কেপিএমের বার্ষিক উৎপাদনক্ষমতা প্রায় ৩০ হাজার টন হলেও বর্তমানে ১০ হাজার টনের বেশি উৎপাদন হয় না।ফলে পুঞ্জীভূত ঋণের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সর্ববৃহৎ কাগজ কলটি। বর্তমানে এর ঋণের পরিমাণ ৫০০ কোটি টাকা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, এক মাস আগেও মিলটির দৈনিক কাগজ উৎপাদন ২৫-৩০ টনের মধ্যে থাকলেও বর্তমানে তা নেমে এসেছে ৬-১৪ টনে। সর্বশেষ ৮ জানুয়ারি ১৪ টন কাগজ উৎপাদন হয়েছে। শনিবারও উৎপাদন পরিস্থিতি সন্তোষজনক ছিল না। এ অবস্থায় দৈনিক ৭০ টন কাগজ উৎপাদন হলে প্রতিষ্ঠানটির লোকসান এড়ানো সম্ভব। কিন্তু কাঁচামাল সংকটের পাশাপাশি ১৮১ কোটি টাকা ব্যয়ে ব্যালান্সিং মডার্নাইজেশন রেনোভেশন অ্যান্ড এক্সপানশন (বিএমআরই) করায় প্রতিষ্ঠানটি কার্যত বন্ধের উপক্রম। বিএমআরইয়ের পর অবকাঠামো উন্নয়নের নামে লুটপাটের মাধ্যমে মিলটি বন্ধের অংশ হিসেবে প্রশাসন নতুন এ কার্যক্রম হাতে নিয়েছে বলে দাবি করেছেন শ্রমিক নেতারা।
এ বিষয়ে কেপিএমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. মোছাব্বেরুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাকে পাওয়া যায়নি। তবে মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, দীর্ঘদিন ধরে অর্থসংকটের কারণে মিলের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সংগ্রহ করা যাচ্ছে না। ফলে সক্ষমতা সত্ত্বেও কাঙ্ক্ষিত উৎপাদনে নেই কেপিএম। সম্প্রতি মজুরি বৃদ্ধির কারণে সংকট আরো বেড়েছে। গণবদলি সম্পর্কে তিনি বলেন, এ বিষয়ে শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে বিসিআইসি চেয়ারম্যানের আগামীকাল (আজ) বৈঠক হবে। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান তিনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, তিন পার্বত্য জেলায় সর্বমোট ১ লাখ ১২ একর জমিতে কাঁচামাল তৈরির মূল উপাদান বাঁশবাগান থাকলেও কৌশলে কাঁচামাল সরবরাহ কমিয়ে উৎপাদন সংকট দেখানো হয় প্রতিদিন। মূলত কাগজ উৎপাদনের বিকল্প পাল্প ক্রয় করে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের জন্যই কেপিএমের প্রশাসন মিলটিকে ধ্বংস করছে বলে অভিযোগ তুলেছেন প্রতিষ্ঠানটির শ্রমিক-কর্মচারীরা।
প্রসঙ্গত, ১৯৫৩ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দেশে কাগজ সরবরাহের অন্যতম ভরসা ছিল কেপিএম। আশি ও নব্বইয়ের দশকে প্রতিদিন ১১০-১৩০ টন কাগজ উৎপাদন হতো এ কারখানায়। উৎপাদন কমতে থাকায় ১৯৯৭ সালে কারখানাটি সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হলেও তা এগোয়নি। ফলে ২০০৫-০৬ সালে কেপিএমের দৈনিক উৎপাদন ৩০-৩৫ টনে নেমে আসে। এ অবস্থায় ২০০৮ সালে কারখানাটির বিএমআরই শুরু হয়। ১৮১ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে বিএমআরই প্রকল্পটি ২০১২ সালে শেষ হয়।