English Version
আপডেট : ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৫ ১৫:৩৩

বছর শেষেও ফেরেনি বিনিয়োগে স্বস্তি

নিজস্ব প্রতিবেদক
বছর শেষেও ফেরেনি বিনিয়োগে স্বস্তি

নির্বাচন-পরবর্তী দু-তিন বছর সময়কে বিনিয়োগের জন্য সবচেয়ে আকর্ষণীয় ধরা হয়। গত কয়েক দফা জাতীয় নির্বাচনের পর এ প্রবণতাই দেখা গেছে দেশে। এ হিসাবে নির্বাচন-পরবর্তী বছর ২০১৫তে বিনিয়োগে বড় ধরনের উল্লম্ফন আশা করেছিলেন অনেকেই। কিন্তু বছরের শুরুতেই রাজনৈতিক অস্থিরতায় সে আশা অনেকটা ক্ষীণ হয়ে আসে। তিন মাস পর পরিস্থিতি শান্ত হলেও অস্বস্তি পুরোপুরি কাটেনি বিনিয়োগকারীদের। বছরজুড়ে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নেই স্বস্তিদায়ক কোনো সুখবর।

গত জুনে শেষ হওয়া ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বিনিয়োগের লক্ষ্য ধরা হয়েছিল জিডিপির ৩২ দশমিক ৫ শতাংশ। সেই লক্ষ্য থেকে বেশ দূরে আছে বাংলাদেশ। বছর শেষ হতে চললেও এখন পর্যন্ত বিনিয়োগ এসেছে জিডিপির ২৯ শতাংশ। বিনিয়োগ পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় এর প্রভাব পড়েছে সামগ্রিক অর্থনীতিতেও।

২০১৫ সালে বিনিয়োগে যেখানে উল্লম্ফনের কথা ছিল, সেখানে এই হতাশার পেছনের কারণ শুধু রাজনৈতিক নয়। অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ বেশকিছু প্রতিবন্ধকতাও ছিল এক্ষেত্রে। বিনিয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় জমি, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকট কাটেনি। এখনো শেষ করা যায়নি ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন। প্রতিষ্ঠান পরিচালনার প্রক্রিয়াগত জটিলতাসহ সার্বিক বিনিয়োগ পরিবেশও ছিল আগের মতোই প্রতিকূল।

বিদ্যমান শিল্পনীতি অনুযায়ী বিনিয়োগের জন্য অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত খাতগুলোর মধ্যে প্রথমেই আছে কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প। এছাড়া আছে জাহাজ নির্মাণ, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, তথ্য ও প্রযুক্তি, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, পর্যটন, প্লাস্টিক, হাসপাতাল, আসবাব ও হালকা প্রকৌশল পণ্যের মতো খাতগুলো। তবে দেশী-বিদেশী উভয় ক্ষেত্রেই এ খাতগুলোয় বিনিয়োগে ঘাটতি রয়ে গেছে। এমনকি বিনিয়োগ করেও উৎপাদনে আসতে পারছে না এমন খাতও রয়েছে।

দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্প খাত হলো বস্ত্র। এ খাতে মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি। পরে যুক্ত হয়েছে আরো প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা। ২৮টি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এ বিনিয়োগ আসে। কিন্তু গ্যাস সংযোগ না থাকায় এগোতে পারছে না প্রকল্পগুলো। একইভাবে বিনিয়োগ করেও উৎপাদনে আসতে পারছে না শতভাগ রফতানিমুখী প্রায় ৩০০ পোশাক কারখানা।

বিনিয়োগ-খরা চলছে পোলট্রি খাতেও। এ খাতে চাহিদার শতভাগ ডিম, মুরগি, বাচ্চা এবং ফিড এখন দেশীয়ভাবেই উৎপাদন হচ্ছে। আগামী দিনে এ খাতের মাধ্যমে ডিম ও মাংসের চাহিদা মেটাতে বর্তমানের বিনিয়োগ ২৫ হাজার কোটি থেকে বাড়িয়ে ২০২১ সালের মধ্যে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত করতে হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। যদিও প্রত্যাশার তুলনায় এখন পর্যন্ত অর্জন অতি সামান্যই।

অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য বছরে ৯-১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রয়োজন বলে মনে করে বিশ্বব্যাংক। কিন্তু শেষ হতে চলা বছরে এর অর্ধেকও বিনিয়োগ করা হয়নি।

বিনিয়োগের জন্য ২০১৫ কেমন ছিল— জানতে চাইলে বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রির (বিসিআই) সভাপতি এ কে আজাদ বলেন, সার্বিকভাবে এ বছরটি দেশী-বিদেশী বিনিয়োগের জন্য স্বস্তির ছিল না। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রান্তিক হিসাবে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে ঋণপত্র খোলা বেড়েছে, যা বিনিয়োগ বৃদ্ধির ইঙ্গিত দিচ্ছে। আবার একই সময়ে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহেও কিছুটা প্রবৃদ্ধি রয়েছে। তবে এ চিত্র শুধুই একটি প্রান্তিকের। পুরো বছর হিসাব করলে বিনিয়োগকে তেমন গতিশীল করা যায়নি। তবে বিদ্যুৎ, জ্বালানিসহ অবকাঠামো ঘাটতি দূর করতে পারলেই এ পরিস্থিতিতে পরিবর্তন আসবে।

শুধু স্থানীয় বিনিয়োগকারীরাই নন, গ্যাস-বিদ্যুৎ-জ্বালানিসহ সার্বিক ভৌত অবকাঠামো অপ্রতুলতা বিনিয়োগের বড় বাধা বলে মনে করছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনও। বাংলাদেশের বৃহৎ বিনিয়োগকারী দেশের মধ্যে অন্যতম যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির ইনভেস্টমেন্ট ক্লাইমেট স্টেটমেন্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশে কাঙ্ক্ষিত হারে বিদেশী বিনিয়োগ না আসার অন্যতম কারণ অপ্রতুল অবকাঠামো, অর্থায়ন বাধা, আমলাতান্ত্রিক বিলম্ব এবং দুর্নীতি। এছাড়া বিরোধ নিষ্পত্তির পন্থা ও আইনি সুশাসন প্রতিষ্ঠায় কালক্ষেপণও বাংলাদেশের প্রতি আন্তর্জাতিক ব্যবসায়িক সম্প্রদায়ের আগ্রহে ঘাটতি তৈরি করে দিচ্ছে।

অবকাঠামো ঘাটতিতে বাস্তবায়ন না হলেও চলতি বছর বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ অব্যাহত ছিল। বিনিয়োগ বোর্ডের (বিওআই) নিবন্ধন পরিসংখ্যানে এ আগ্রহের প্রতিফলন দেখা গেছে। বছরের প্রথম প্রান্তিকে স্থানীয় ও বিদেশী মিলিয়ে সর্বোচ্চ বিনিয়োগ নিবন্ধন হয়েছে কৃষিভিত্তিক সেবা শিল্প খাতে। দ্বিতীয় প্রান্তিকে সর্বোচ্চ বিনিয়োগ নিবন্ধন হয়েছে রসায়ন শিল্প খাতে। আর তৃতীয় প্রান্তিকে সর্বোচ্চ বিনিয়োগ নিবন্ধন হয়েছে বস্ত্র শিল্প খাতে। জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বরে নিবন্ধিত মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৭৩ হাজার ২৮৭ কোটি টাকা। তবে নিবন্ধিত এসব বিনিয়োগের বাস্তবায়নের হার ৫০ শতাংশেরও কম বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

বিওআই নির্বাহী সদস্য নাভাস চন্দ্র মণ্ডল বলেন, সার্বিকভাবে বিনিয়োগের জন্য চলতি বছরটি ছিল অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেক ভালো। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হারসহ বিভিন্ন সূচক সেই ইঙ্গিতই বহন করছে। শুধু বিওআইয়ের নিয়মিত কার্যক্রম বিবেচনায়ও তারই প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছি। অনেক প্রকল্প নিবন্ধন হয়েছে। অর্থাৎ স্থানীয় ও বিদেশী সব বিনিয়োগকারী তাদের আগ্রহ ধরে রেখেছেন। শুধু বিদেশী বিনিয়োগের পরিসংখ্যানেও দেখা যায়, গত বছরের একই সময়ের তুলনায় বিদেশী বিনিয়োগ বেড়েছে।

বিওআইয়ের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর নয় মাসে স্থানীয় বিনিয়োগ নিবন্ধন হয়েছে ৭০ হাজার কোটি টাকার। ১ হাজার ৩২টি প্রকল্পে এ নিবন্ধন হয়েছে। আর শতভাগ বিদেশী ও যৌথভাবে ১০৩টি প্রকল্পে নিবন্ধিত বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৩ হাজার কোটি টাকা।

চলতি বছর নিবন্ধন নিয়েছে এমন কিছু প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আছে— দারাজ বাংলাদেশ, লিজেন্ড অ্যাকসেসরিজ, বিসি চারকোল, ইন্ডা ইনকরপোরেশন, গেলি ইন্ডাস্ট্রিজ কো. লিমিটেড, জাপান অ্যাকুয়া এন্টারপ্রাইজ ও কিং পাওয়ার।

সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগপ্রবাহ পরিসংখ্যান প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাদের হালনাগাদ পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছর প্রথমার্ধে বিদেশী বিনিয়োগপ্রবাহ ছিল ১০৯ কোটি ৬৮ লাখ ৬০ হাজার ডলার, যার মধ্যে ইকুইটি ক্যাপিটাল (নতুন বিনিয়োগ) ৩২ দশমিক ৬২ শতাংশ। পুনর্বিনিয়োগ ছিল ৫৪ দশমিক ৩১ শতাংশ এবং আন্তঃকোম্পানির ঋণ ছিল ১৩ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। অর্থাৎ নতুন বিনিয়োগের হার সবচেয়ে কম আর বিদ্যমান বিনিয়োগকারীদের পুনর্বিনিয়োগই বেশি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ বিরূপাক্ষ পাল এ প্রসঙ্গে বলেন, বেসরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধি, বিনিয়োগ-জিডিপি আনুপাতিক হার, দায়-জিডিপির আনুপাতিক হার, মূল্যস্ফীতি, ঋণের সুদের হার— এগুলো বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ। বিনিয়োগ-জিডিপি আনুপাতিক হার ২৯ শতাংশ। এটি বিচিত্র নয়, কারণ দক্ষভাবে কাজে লাগাতে পারলে এত কম হার নিয়েও ফল ভালো পাওয়া যেতে পারে। আর অবকাঠামোর চাহিদা শেষ হবে না। যেমন আমেরিকায় এখনো অবকাঠামোর চাহিদা আছে। তাই এখানে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে অবকাঠামো ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে করা। এজন্য বিনিয়োগ দরকার। শুধু ঢাকা ও চট্টগ্রামকে যদি যানজটমুক্ত করা যায়, তবে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ১ শতাংশ বাড়বে।