আব্দুল জলিলের ৬ষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী আজ

আজ ৬ মার্চ। মো. আব্দুল জলিলের ৬ষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী। ২০১৩ সালের এই দিনে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন তিনি। মুুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক বাণিজ্য মন্ত্রী আব্দুল জলিল এ দিনে ব্যাংককের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
১৯৩৯ সালে নওগাঁ শহরের চকপ্রাণ মহল্লায় জন্মগ্রহণ করেন মো. আব্দুল জলিল। তাঁর পিতা মরহুম ফয়েজ উদ্দিন আহমেদ ছিলেন নওগাঁ শহরের একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। জলিল ছিলেন তাঁর পিতার একমাত্র ছেলে। ১৯৫৭ সালে নওগাঁ কে ডি স্কুল থেকে এসএসসি, ১৯৬০ সালে বগুড়া আজিজুল হক কলেজ থেকে এইচএসসি, ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ অনার্স (রাষ্ট্র বিজ্ঞান) ও ১৯৬৪ সালে এমএ ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৬৫ সালে ব্যারিষ্টারী (বার এট ল) পড়ার জন্য তিনি বিলেত যান। ১৯৬৯ সাল। তখন দেশে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন চলছে। এ সময় বঙ্গবন্ধু বিলেত যান এবং অধ্যয়নরত প্রাক্তন ছাত্র নেতাদের নিয়ে এক বৈঠক করেন। জলিলের পরিচয় হয় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। বঙ্গবন্ধুর ডাকে ৬৯ সালেই দেশে ফিরে আসেন এবং ঝাঁপিয়ে পড়েন স্বাধীনতা আন্দোলনে। সেই সঙ্গে শেষ হয় তাঁর ব্যারিষ্টারী পড়ার সকল আয়োজন।
১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে নওগাঁ মহকুমার নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব অর্পিত হয় আব্দুল জলিলের ওপর। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করলেও পাক সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তর না করে বিভিন্ন তালবাহানা ও কালক্ষেপণ শুরু করে। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ বা স্বাধীনতার ভাষণে সারাদেশবাসী আন্দোলিত ও উজ্জিবিত হয়ে উঠে, যা স্বাধীনতার দলিল হিসেবে পরিচিত। ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য সমগ্র বাঙ্গালী জাতি প্রতিবাদ, প্রতিরোধের দূর্গ গড়ে তোলে। পাক সামরিক জান্তা পূর্ব পরিকল্পিত নীল নকশার প্রতিফলন ঘটায়। গ্রেফতার করে বাঙ্গালী জাতির অবিসংবাদিত নেতা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। ফুঁসে উঠে সমগ্র বাঙ্গালী জাতি। শুরু হয় স্বাধীনতা যুদ্ধ। আব্দুল জলিল নওগাঁ মহকুমার আপামর জনসাধারণ, কর্মরত ইপিআর পুলিশ আনছার বাহিনীকে সংগঠিত করে জীবন বাজী রেখে স্বাধীনতা যুদ্ধে অবতীর্ণ হন।
১৯৭১ মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে এতদ্বঞ্চলের প্রধান সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর দিকে আব্দুল জলিল নওগাঁ থেকে যাওয়ার সময় ৭৪ জন ছেলে ও তাঁর দলবল নিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে চলে যান। বালুরঘাটে আত্রাই নদীর পূর্ব তীরে শ্মশানকালী মন্দিরের পার্শ্বে একটি গৃহে অবস্থান গ্রহণ করেন। সেখান থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ভর্তি ও বাঙ্গালীপুর, মধুপুর, কামাড়পাড়া, প্যারিলাসহ ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকায় বেশ কয়েকটি ট্রেনিং ক্যাম্প পরিচালনা করেন। ওইসব ক্যাম্প থেকে হায়ার ট্রেনিং এর জন্য শিলিগুড়ির পানিঘাটায় পাঠিয়ে দেওয়ার বিশাল দায়িত্ব গ্রহণ করেন আব্দুল জলিল। আব্দুল জলিল শুধু মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠকই ছিলেন না, ‘বঙ্গবাণী’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার মালিকও ছিলেন। আব্দুল জলিলের সাহায্য, সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতায় বালুরঘাট নিউমার্কেট এলাকার সুনীতি প্রিন্টিং ওয়ার্কস থেকে ‘বঙ্গবাণী’ পত্রিকাটি প্রকাশিত ও প্রচারিত হতো। ওই পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন অধ্যাপক খন্দকার মকবুল হোসেন ও সহ সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন খন্দকার আবু বককর সিদ্দিকী।
১৯৭১ সালে তিনি সর্বপ্রথম বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ থেকে নওগাঁ সদর আসনে এমপি নির্বাচতি হন। দেশ পুনর্গঠনের কাজে পুরো মাত্রায় আত্মনিয়োগ করেন তিনি। কিন্তু স্বাধীনতার বিপক্ষের শত্রুরা মাথাচারা দিয়ে উঠে। মানবতা বিরোধীরা, যুদ্ধাপরাধী, রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী ও দেশী-বিদেশী শত্রুরা ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট অতর্কিত হামলা চালিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তাঁর গোটা পরিবারকে হত্যা করে। জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ করে জারি করা হয় সামরিক শাসন। গণতন্ত্রের মুখ থুবড়ে পড়ে যায়। গণতন্ত্রকে গলাটিপে হত্যা করা হয়। অনেক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে আব্দুল জলিলকেও গ্রেফতার করা হয়। দীর্ঘ ৪ বছর কারাভোগের পর ১৯৭৯ সালে তিনি মুক্তি লাভ করেন।
১৯৮২ সালে পুনরায় সামরিক শাসন জারি করার পর গ্রেফতার করা হয় আব্দুল জলিলকে। ১৫ দিন অজ্ঞাত স্থানে বন্দী রেখে অবর্ণনীয় দৈহিক নির্যাতন চালানো হয় তার ওপর। জেলে থাকা অবস্থায় তাঁর মাতার মৃত্যু হলেও সামরিক জান্তারা মাতৃ মুখখানা এক নজর দেখার জন্য কোন সুযোগ দেয় নাই। ১৯৮৪ ও ১৯৮৮ সালে তিনি পর পর দু’বার নওগাঁ পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৮৬ সালে তিনি জাতীয় সংসদের এমপি নির্বাচিত হন এবং সংসদে বিরোধী দলীয় চীফ হুইপের দায়িত্ব পালন করেন। আব্দুল জলিল আধুনিক নওগাঁর রূপকার। নওগাঁ জেলার সকল উপজেলাতেই তাঁর হাতের স্পর্শে অনেক উন্নতি সাধিত হয়েছে। নওগাঁ শহরকে তিলোত্তমা শহরে পরিণত করা তাঁর লালিত স্বপ্ন। জাতীয় পর্যায়ে তিনি অনেক গুরু দায়িত্ব পালন করেছেন।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক, সাধারণ সম্পাদক পদে থাকাবস্থায় আব্দুল জলিল অনেক সফলতার পরিচয় দেন। তিনি স্বৈরাচারীদের বহু প্রলোভন, জুলুম, ভয়ভীতি উপেক্ষা করে শির উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিলেন। কখনও নীতিভ্রষ্ট হননি, আদর্শচ্যুত হননি কিংবা অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি। নওগাঁবাসীর কল্যাণ ও উন্নয়নে তিনি সদা সর্বদাই স্বচেষ্ট ছিলেন। ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের ও যোদ্ধাদের খরচ মোকাবিলায় আব্দুল জলিল মহান স্বাধীনতার ৯ মাস যুদ্ধে ভারতের প্রত্যেকটি রিসিপশন ক্যাম্পের জন্য নওগাঁ ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান ব্যাংক থেকে ৭১ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা ওই ব্যাংকের ব্যবস্থাপক ও কোষাধ্যক্ষকে ডেকে নিয়ে এনে ব্যাংকের ভোল্ট রেজিষ্টারে এন্ট্রি করে টাকা গ্রহণ করেন। সেই অর্থ দিয়ে ভারতে মুক্তিযুদ্ধের ক্যাম্পগুলো পরিচালিত করেন। দেশ স্বাধীন হলে বঙ্গবন্ধুর নতুন সরকারের নিকট খরচ শেষে ৩৪ লক্ষ ৫২ হাজার টাকা ফেরত দেন।
২০১৩ সালের ৬ মার্চ ব্যাংককের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন মো. আব্দুল জলিল। মহান এ নেতার মৃত্যুতে পুরো দেশে সে দিন শোকের ছায়া নেমে আসে। মহান এ নেতার লাশ ব্যাংকক থেকে যখন ঢাকায় আনা হয় সেখানে হাজারো নেতাকর্মী তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলী নিবেদন করে। পরে লাশ হেলিকপ্টারযোগে নওগাঁ জেলা স্টেডিয়ামে আনা হয়। এখানে গোলাম সামদানীসহ জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার হারুন-অল-রশিদ উপস্থিত হয়ে আব্দুল জলিলের লাশ হেলিকপ্টার থেকে নামানোর মুখ্য ভূমিকা পালন করেন।
এরপর তার লাশ নওগাঁ শহরের চকদেবপাড়ার বাড়িতে নেওয়া হয়। মহান এ নেতার জানাজায় লাখো মানুষের উপস্থিতি প্রমাণ করেছিল আব্দুল জলিল নওগাঁর মানুষের হৃদয়ে কতটা জায়গা করে নিয়েছিলেন।