English Version
আপডেট : ৩ নভেম্বর, ২০১৮ ১২:৫৮
সূত্র:

নতুন ফর্মুলা দেবেন ড. কামাল, তফসিলে চোখ বিএনপির

নতুন ফর্মুলা দেবেন ড. কামাল, তফসিলে চোখ বিএনপির

সংলাপ থেকে কিছুই অর্জন হয়নি, আবার কিছুটা সফল হয়েছে—এমন দুই ধরনের আলোচনাই আছে বিএনপিসহ জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্তর্ভুক্ত দলগুলোর মধ্যে। পুরোপুরি ‘ব্যর্থ’—এ কথা দলগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে বলতে রাজি নয়। কারণ সংলাপ চালিয়ে নেওয়া উচিত, এমন কথা আবার সংলাপে আলোচনা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ নেতারা বলেছেন, তারা চাইলে আরো সংলাপ হতে পারে।

যদিও বিএনপি ওই ‘পরবর্তী’ সংলাপে যোগ দেওয়ার ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত নেয়নি। জানা গেছে, দলটি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার জন্য অপেক্ষা করবে। দলটির নেতাদের মতে, তফসিল পেছানোর অর্থ হলো, সরকার আলোচনার ব্যাপারে আন্তরিক। পেছানো না হলে বিএনপিকে আন্দোলনের পথেই হাঁটতে হবে বলে দলের নেতারা মনে করেন। তাই পাশাপাশি আন্দোলনের প্রস্তুতিও অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি।

এদিকে ছোট একটি কমিটি গঠন করে দ্বিতীয় দফা সংলাপে আগ্রহের কথা জানিয়েছে ঐক্যফ্রন্টের দুই দল জেএসডি ও গণফোরাম। তবে শেষ পর্যন্ত ওই আলোচনা না হলে সংবিধানের মধ্যে থেকেই সমস্যা সমাধানে নির্বাচনকালীন সরকারের একটি প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠাবেন গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন।

গত বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত সংলাপে প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘আপনি সংবিধানসম্মত সমাধানে আগ্রহ ব্যক্ত করেছেন, তাকে আমরা স্বাগত জানাই। কিন্তু এটাও আপনার অজানা নয় যে কোনো বিষয়ে সংবিধান সংশোধনের দরকার পড়লে তা নিয়ে আলোচনা করাও সংবিধানসম্মত। কারণ সংবিধান সংশোধনের বিধান সংবিধানেরই অংশ। তবে বিরাজমান পরিস্থিতিতে সংকট থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করতে সংবিধানসম্মত একাধিক পথ খোলা আছে বলে আমরা মনে করি।’ ড. কামাল বলেন, ‘আমাদের সাত দফার পাশাপাশি ১৩তম সংশোধনী মামলায় সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া রায়ের আলোকে, বিশেষ করে দশম ও একাদশ নির্বাচন নির্দলীয় সরকারের অধীনে করা, নির্বাচনের ৪২ দিন আগে সংসদ ভেঙে দিয়ে একটি ছোট মন্ত্রিসভা গঠনসহ বিভিন্ন নির্দেশনা, ২০১৩ সালে বিরোধী দলকে নির্বাচনী মন্ত্রিসভায় স্বরাষ্ট্র ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়সহ একাধিক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রদানে আপনার প্রস্তাবের প্রতি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।’

লিখিত বক্তব্যে ড. কামাল বলেন, সংবিধানের ১২৩ (৩) অনুচ্ছেদের খ উপদফায় সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচন করার বিধান রয়েছে। সুতরাং সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচন করা সংবিধানসম্মত এবং তা ওয়েস্টমিনস্টার মডেলের সংসদীয় রীতি মেনে চলা বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের অনুশীলনের সঙ্গেও সংগতিপূর্ণ। বাংলাদেশেও ২০১৪ সালের নির্বাচনটি ছাড়া এর আগের ৯টি সংসদ নির্বাচন সংসদ ভেঙে দেওয়া অবস্থায় অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৭৩ সালে গণপরিষদ ভেঙে দিয়েই প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়।

জানতে চাইলে গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, সরকারের সঙ্গে দ্বিতীয় দফা সংলাপ না হলে স্যার (ড. কামাল হোসেন) নিজেই প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি প্রস্তাব পাঠাবেন, যাতে সংবিধানসম্মতভাবেই নির্বাচনকালীন সরকার কিভাবে করা যায় তার রূপরেখা থাকবে।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী মনে করেন, দ্বিতীয় দফা আলোচনায় না যাওয়ার তো কোনো কারণ নেই। তাঁর মতে, ‘সংলাপে প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত ভদ্রতার পরিচয় দিয়েছেন। আমি মনে করি, অর্জন কিছু হোক বা না হোক বরফ গলেছে। তা ছাড়া কিছু তো অর্জন হয়েছেই।’ তিনি বলেন, ‘তফসিল ঘোষণার পরেও আলোচনা হতে পারে। শেখ হাসিনা থাকলে কিছু হবে না, আমি এতটা নিরাশাবাদী নই। জনগণকে মাঠে নামাতে পারলে অনেক কিছুই হতে পারে।’  

তবে ওই সংলাপে আবারও ঐক্যফ্রন্ট যোগ দেবে কি না তা নির্ভর করছে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার ওপর। দু-এক দিনের মধ্যে তফসিল ঘোষণা হয়ে গেলে দ্বিতীয়বার আলোচনার সুযোগ কম। পাশাপাশি বিএনপির দলীয় ফোরাম তথা ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির সিদ্ধান্তের ওপরও অনেক কিছু নির্ভর করছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আজ শনিবার বিএনপির যৌথ সভা ডাকা হয়েছে। দু-এক দিনের মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে স্টিয়ারিং কমিটির এবং বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির একটি সভাও। পরবর্তী করণীয় নির্ধারণে কেন্দ্রীয় কমিটির নেতাদের মতামতের গুরুত্ব দেওয়া হবে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ কালের কণ্ঠকে জানান, দ্বিতীয় দফা সংলাপে যাওয়ার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তিনি বলেন, সাত দফার প্রথম দাবির বিষয়ে সংবিধানসম্মতভাবে সমাধান খুঁজে বের করার বিষয়ে ড. কামাল হোসেনের একটি প্রস্তাব ছিল। কিন্তু এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

গতকাল সন্ধ্যায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক শেষে ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বড় ধরনের বৈঠক ছাড়া দু-তিনজন করে সদস্য নিয়ে পরবর্তী আলোচনা করা যায় কি না, তা নিয়ে আমরা কথা বলেছি, তবে সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি।’ সংলাপের মূল্যায়ন সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মূল্যায়ন কী? ওই সভা-সমাবেশ করা যাবে, ওইটুকুই।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমরা এখন আন্দোলন ও নির্বাচন দুটি নিয়েই থাকব।’   

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গতকাল বলেছেন, তারা (ঐক্যফ্রন্ট) যদি চায় ছোট পরিসরে আবারও আলোচনা হতে পারে। এ ব্যাপারটি তাদের সিদ্ধান্তের ওপর শেখ হাসিনা ছেড়ে দিয়েছেন। ওবায়দুল কাদের বলেন, “তারা যদি চায় তাহলে আমাদের জানাতে পারেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমার দরজা খোলা।’”

জানতে চাইলে ১৪ দলের মুখপাত্র ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের সঙ্গে খুবই সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে আমাদের আলোচনা হয়েছে। এটি কিন্তু আমাদের রাজনীতিতে একটি বিরল ঘটনা যে প্রধানমন্ত্রী নিজে বিরোধীদের সব কথা শুনছেন ও জবাব দিচ্ছেন। তিনি সংলাপের সময় ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিয়েছেন। এর পরও যদি তাঁরা মনে করেন আবারও কোনো বিষয় নিয়ে বসার দরকার আছে, তবে আমরা অবশ্যই বসব। প্রধানমন্ত্রী সংলাপের সময়ও তাঁদের এমনটা বলে দিয়েছেন।’

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে চলমান সংলাপে দলটির প্রতিনিধিদলের সদস্য ডা. দীপু মনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সভাপতি বলে দিয়েছেন আলোচনার দরজা সব সময় খোলা থাকবে। সংলাপে ঐক্যফ্রন্টের নেতারা তাঁদের সব দাবিদাওয়া নিয়ে বিস্তারিত আলাপ করেছেন। আমরা আমাদের অবস্থান জানিয়েছি। এর পরও যদি তাঁরা আবার বসতে চান তাহলে আমরা বসতে পারি।’

জানা যায়, বৃহস্পতিবারের দ্বিতীয় দফা সংলাপ প্রসঙ্গে আলোচনায় ‘তফসিল স্থগিত বা পেছানো’র প্রস্তাব দিয়েছিলেন নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না। তবে শেখ হাসিনা তা নাকচ করে দিয়ে বলেছেন, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার এখতিয়ার সম্পূর্ণ নির্বাচন কমিশনের। এমন পরিস্থিতিতে তফসিল ঘোষণা করা হলে বিএনপি আবারও সংলাপে যেতে রাজি হবে কি না তা নিশ্চিত নয়। কারণ সংলাপের অর্জন প্রশ্নে দলটির মধ্যে নেতিবাচক আলোচনাই বেশি। খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ ঐক্যফ্রন্টের সাত দফার মূল দাবিগুলোই প্রধানমন্ত্রী এড়িয়ে গেছেন বলে মূল্যায়ন তাদের। আবার এত দিন নেতিবাচক অবস্থান স্পষ্ট করা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রীর সাড়ে তিন ঘণ্টার আলোচনাকেও এক ধরনের সফলতা হিসেবে দেখছে কেউ কেউ। পরিস্থিতি মূল্যায়নে গত রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে।    

তবে গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টু ও দলটির নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, জেএসডির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন এবং দলটির ভাইস চেয়ারম্যান তানিয়া রব কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন, ছোট একটি কমিটি গঠন করে নাম পাঠানো হলে সরকারের সঙ্গে আলোচনা হতেও পারে। তাঁরা জানান, ঐক্যফ্রন্টের প্রধান দাবি অর্থাৎ নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার, সরকারের পদত্যাগ এবং সংসদ ভেঙে নির্বাচন প্রশ্নে সংবিধানের মধ্য থেকে আলোচনা করে একটি পন্থা বের করাই ওই কমিটির উদ্দেশ্য হবে। সম্ভাব্য এ আলোচনার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীও ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন বলে জানান তাঁরা।

যদিও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আরেক নেতা নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না মনে করেন, আবারও আলোচনায় বসার কোনো কথা হয়নি। তিনি বলেন, ‘আমরা চাইলে যেতে পারি। গেলে ওনারা (সরকার) সময় দেবেন বলেছেন। কিন্তু আমি যাওয়ার কোনো দরকার মনে করছি না।’ ‘তবে সরকার প্রয়োজন বোধ করলে আমরা যাব’, যোগ করেন মান্না। তিনি বলেন, ছোট কমিটি গঠনের প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রী আমলেই নেননি।  

মোস্তফা মহসিন মন্টু কালের কণ্ঠকে বলেন, সংবিধানসম্মতভাবে সমস্যা সমাধানের বিষয়ে ড. কামাল হোসেনের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার জন্য একটি ছোট কমিটি গঠন করা হবে। দ্বিতীয় দফা আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এখন আমরাও চেষ্টা করব। একটি প্রস্তাব আমরা তাঁকে দেব। আলোচনা হবে বলে আশা করছি।’

অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ছোট একটি কমিটি গঠন করে সংবিধানের মধ্য থেকে সমস্যা সমাধানের বিষয়ে আমরা আলোচনা করতে চাই। আলোচনা হতে পারে। স্যারের (ড. কামাল হোসেন) বক্তব্যের মধ্যেও এ প্রস্তাব রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘এখন সরকার কী করে দেখি!’ ‘না হলে আমরাই একটা প্রস্তাব পাঠিয়ে দেব—সংবিধানের মধ্যে সমস্যা সমাধান কী করে করা যায় তার একটা রূপরেখা’, যোগ করেন সুব্রত চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘তফসিল ঘোষণার পরেও এ ধরনের আলোচনা হতে পারে। আগে হয়েছে। নির্বাচন কমিশনকেও আমরা বলতে পারি, আপনি একটু থামেন।’

জেএসডির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন কালের কণ্ঠকে জানান, কমিটি গঠন এবং দ্বিতীয় দফা সংলাপে যোগদানের কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। বৈঠক ডেকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তফসিল ঘোষণার পরেও আলোচনা করা যায়। কিন্তু এর ইফেক্ট কী হবে, সেটা হলো কথা।

দলটির ভাইস চেয়ারম্যান তানিয়া রব বলেন, সংবিধানসম্মত প্রস্তাব এবং দ্বিতীয় দফা সংলাপ দুটিরই সম্ভাবনা আছে। তিনি জানান, ঐক্যফ্রন্টের তরফ থেকে যত দ্রুত সম্ভব আইনজীবী নেতাদের সমন্বয়ে ছোট একটি কমিটি গঠন করে পাঠানোর কথা রয়েছে। সরকারের তরফ থেকেও সমানসংখ্যক সদস্য দেওয়ার পর সংবিধানের মধ্য থেকে একটি সমাধান খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হবে।