বিএনপির জনসভার পর ঘুরবে রাজনীতির মোড়?

বিএনপির জনসভায় কর্মসূচি বা কর্মপন্থা ঘোষণার পরই দেশের রাজনীতি নতুন মোড় নিতে পারে। কারণ ওই ঘোষণায় যা থাকছে তার অন্তত পাঁচ-ছয়টি দফার সঙ্গে ঐক্যপ্রক্রিয়া ও যুক্তফ্রন্টের ঘোষিত কর্মসূচির মিল রয়েছে। শুধু তা-ই নয়, বেশ কয়েকটি ইস্যুতে মিল রয়েছে বাম গণতান্ত্রিক জোটের ঘোষিত কর্মসূচির সঙ্গেও। এদিকে জামায়াত নিয়ে ‘সমস্যা’ও আপাতত সামাল দিতে পেরেছে বিএনপি।
গত ২৮ আগস্ট ঘোষিত দাবি অনুযায়ী বাম দলগুলোও সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দেওয়া এবং সরকারের পদত্যাগ চাইছে। তাদের দাবির মধ্যে আছে সব দল ও মতের ভিত্তিতে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ তদারকি সরকার গঠন, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন এবং ইভিএম বাতিল। প্রায় একই রকম পাঁচ দফা দাবি ঘোষণা করে গত ২২ সেপ্টেম্বর যুক্তফ্রন্টের তিনটি দল ও গণফোরামের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যপ্রক্রিয়া। সংসদ ভেঙে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠন তাদেরও দাবি।
দু-এক দিনের মধ্যে বিএনপির যে জনসভা করার কথা রয়েছে, সেখানেও সাত দফা দাবি এবং ১২ দফা লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ঘোষণা থাকছে। তাদের মূল দাবি হলো সংসদ ভেঙে নির্বাচন, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠন এবং নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন। এর সঙ্গে যদিও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি ও মামলা প্রত্যাহারসহ আরো কিছু দাবি থাকছে। কিন্তু এসব দাবির বিষয়েও আপত্তি নেই যুক্তফ্রন্ট ও গণফোরামের।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের ধারণা, বিএনপির জনসভা ও কর্মসূচি ঘোষণার পর রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ হতে পারে। বিশেষ করে বৃহত্তর ঐক্যপ্রক্রিয়ার ব্যানারে বিএনপির নেতৃত্বে দলগুলো একসঙ্গে অথবা যুগপৎ কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামবে। বিএনপির ওই জনসভার পর বৃহত্তর ঐক্যপ্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে লিয়াজোঁ কমিটি গঠন করা হবে। ফলে সংশ্লিষ্ট দলগুলো ওই জনসভার দিকে তাকিয়ে আছে। ‘কমন’ দাবি নিয়ে বাম দলগুলো শেষ পর্যন্ত কী করে তা-ও স্পষ্ট হবে ওই ঘোষণার পর।
বাম গণতান্ত্রিক জোটভুক্ত গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি গত ২২ সেপ্টেম্বর জাতীয় ঐক্যপ্রক্রিয়া আয়োজিত নাগরিক সমাবেশের মঞ্চে গিয়েছিলেন। যদিও এ নিয়ে ওই জোটের মধ্যে কথা উঠেছে। তবে একই ইস্যুতে আলাদাভাবে হলেও বাম দলগুলোকে আন্দোলনে নামানোর জন্য কাজ করছে বিএনপি। পাশাপাশি বাম জোটের দু-একটি দলের মধ্যে থাকা সরকারবিরোধী তীব্র অসন্তোষ কাজে লাগাতে চায় বিএনপি। সরকারবিরোধী আন্দোলন গতি পেলে ওই জোটের দু-একটি দলও বিএনপির সঙ্গে আন্দোলনে শামিল হতে পারে বলে আলোচনা আছে বিএনপিতে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘জনসভার মধ্য দিয়ে আগামী দিনের কর্মপন্থা আমরা দেশের জনগণকে জানাব।’ তিনি আরো বলেন, ‘সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যাপারে আমরা যেসব দাবি করছি তার সঙ্গে এর আগে বাম গণতান্ত্রিক জোট, ঐক্যপ্রক্রিয়া ও যুক্তফ্রন্ট ঘোষিত দাবির মধ্যে অনেক কমন (অভিন্ন) আছে। অর্থাৎ সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে আমাদের মধ্যে অঘোষিত ঐক্য হয়ে গেছে। ফলে সময়ে আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ হলে আশ্চর্যের কিছু নেই।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, উদারপন্থী দলগুলোর সঙ্গে যুগপৎ নাকি একসঙ্গে আন্দোলন হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে এ প্রশ্নে আলোচনা চলছে।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মতে, বাম জোটের ঘোষণার পর ঐক্যপ্রক্রিয়া এবং যুক্তফ্রন্ট তাদের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। এখন বিএনপি তাদের দাবি বা কর্মসূচি ঘোষণা করলেই রাজনীতি নতুন দিকে মোড় নেবে। কারণ তাদের মূল দাবিদাওয়া প্রায় একই রকম। এক প্রশ্নের জবাবে ঐক্যপ্রক্রিয়ায় মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালনকারী এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘বিএনপি এককভাবে জনসভা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ভালো করেছে। কেননা জামায়াত থাকলে বিতর্ক তৈরি হতো। এখন বিএনপির কর্মসূচি বা দাবি ঘোষণার পর সব দল সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।’
দলীয় সূত্রে জানা যায়, গত বৃহস্পতিবার রাতে ২০ দলীয় জোটের বৈঠকে শরিক দলগুলোকে রাজি করিয়ে এককভাবে জনসভা করার সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি। বিশেষ করে জামায়াতকে তারা বোঝায় যে বৃহত্তর স্বার্থে বিএনপিকে জাতীয় ঐক্য করতে হবে। এ জন্য কৌশলগতভাবেই জামায়াতকে আপাতত দূরে থাকতে হবে। জবাবে জামায়াতের নির্বাহী পরিষদ সদস্য আবদুল হালিম তাঁর দলের পক্ষে ‘ছাড়’ দেওয়ার কথা জানান। হালিম বলেন, এ সরকারকে বিদায় করতে জামায়াত সব ধরনের ত্যাগ স্বীকার করতে রাজি আছে। ২০ দলীয় জোটের উপস্থিত অন্য নেতারাও বৃহত্তর স্বার্থে জাতীয় ঐক্য গড়ার ওপর জোর দেন।
নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিএনপির রাজনৈতিক কর্মপন্থা ঘোষণার পর স্পষ্ট হয়ে যাবে সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলো কে কী চায়। সুতরাং একসঙ্গে আন্দোলন না হলেও কমন দাবিতে সবাই সোচ্চার থাকবে, এটি স্বাভাবিক।’ তিনি বলেন, ‘কমন ইস্যুতে বিএনপির সঙ্গে আন্দোলন প্রথমে যুগপৎ হলেও পরে একসঙ্গে হবে, এটিই স্বাভাবিক।’
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে বাম গণতান্ত্রিক জোট আন্দোলন করছে। অন্য রাজনৈতিক দলকেও আমরা আন্দোলনে আহ্বান জানাই। আর আন্দোলন হলে রাজপথে দেখা হবে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিএনপির সঙ্গে দেখা হবে কি না তা এখনই বলা যাচ্ছে না।
প্রথমে গত বৃহস্পতিবার এবং পরে আজ শনিবার জনসভার জন্য অনুমতি চেয়েছিল বিএনপি। কিন্তু ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে ৩০ সেপ্টেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভার জন্য আবেদন করা হয়েছে। তবে গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত অনুমতি পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন বিএনপির মহাসচিব। দলটির প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি কালের কণ্ঠকে বলেন, আজ সকালে তাঁরা এ নিয়ে আলোচনা করতে ডিএমপি কার্যালয়ে যাবেন। দলের সহসাংগঠনিক সম্পাদক আবদুস সালাম আজাদ বলেন, পুলিশ কর্মকর্তাদের আলাপ-আলোচনায় মনে হয়েছে, জনসভার অনুমতি পাওয়া যাবে।
এদিকে বৃহত্তর ঐক্যপ্রক্রিয়ায় জড়িত চারটি দলের মধ্যে গণফোরাম, জেএসডি ও নাগরিক ঐক্য একরকম মেনে নিয়েছে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের ঐক্যের বাস্তবতা। তারা এ নিয়ে বিএনপিকে আর কোনো বাড়তি চাপ দেবে না বলে জানা যায়। আবার জামায়াতসহ ২০ দলীয় জোটের শরিকরাও বৃহত্তর ঐক্যপ্রক্রিয়ার বাস্তবতা মেনে নিতে রাজি হয়েছে। একমাত্র বিকল্পধারা জামায়াত নিয়ে এখনো সোচ্চার থাকলেও বিষয়টি আস্তে আস্তে গুরুত্ব হারাচ্ছে। জানা গেছে, বিকল্পধারার মতামতকে এখন থেকে আর গুরুত্ব না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। তারা গণফোরাম, জেএসডি ও নাগরিক ঐক্যকে নিয়েই সামনে এগোবে।
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘ঐক্যপ্রক্রিয়ার সংশ্লিষ্ট দল এবং ২০ দলীয় জোটের শরিক সব দলকে বিএনপি বেশ ভালোভাবে হ্যান্ডল করতে পেরেছে।’
জনসভায় বিএনপি যে সাত দফা দাবি ঘোষণা করবে সেগুলো হচ্ছে খালেদা জিয়ার মুক্তি ও সাজা বাতিল এবং দলটির সব নেতাকর্মীর নামে সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার এবং নতুন মিথ্যা মামলা না দেওয়া, সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচন, আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, নির্বাচন পর্যবেক্ষণে দেশি ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ না করা, ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে সেনাবাহিনী মোতায়েন এবং ইভিএম ব্যবহার না করা।
রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি দেশের জনগণকেও বিএনপি এই জনসভা থেকে নতুন কিছু বার্তা দিতে চায়। বিশেষ করে ক্ষমতায় গেলে তারা কী করবে এ জন্য ১২টি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য জনসভায় তুলে ধরবে দলটি। সেগুলো হলো—রাষ্ট্রের সর্বস্তরে সুশাসন নিশ্চিত করা, প্রতিহিংসার রাজনীতির অবসান, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি দলীয়করণের বদলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিচারপতি নিয়োগ এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, সশস্ত্র বাহিনীকে আরো আধুনিক ও শক্তিশালী করা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, দুর্নীতি প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ, সব নাগরিকের মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত করা, স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ, কোনো ধরনের সন্ত্রাসবাদকে মদদ না দেওয়া, কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদীকে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে না দেওয়া এবং আয়ের বৈষম্য অবসানকল্পে জাতীয় ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ।