English Version
আপডেট : ৯ জুন, ২০১৮ ১৬:১৪

যেসব আসনে নির্বাচনে অংশ নেবে যুদ্ধাপরাধীদের সন্তানরা

অনলাইন ডেস্ক
যেসব আসনে নির্বাচনে অংশ নেবে যুদ্ধাপরাধীদের সন্তানরা

যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত ও দণ্ডপ্রাপ্ত নেতাদের আসনে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে তাদের সন্তানরা। একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত অপরাধে দণ্ডিত অনেকেরই ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে; আমৃত্যু কারাদণ্ডও ভোগ করছেন কয়েকজন। জীবদ্দশায় এসব যুদ্ধাপরাধীর অনেকেই মন্ত্রী-এমপি ছিলেন। এখন তাদের অবর্তমানে পরিবারের সদস্যরা নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন সংশ্লিষ্ট আসনে।

জানা গেছে, পাবনা-১ আসনে দুবারের সংসদ সদস্য জামায়াতের সাবেক আমির মতিউর রহমান নিজামী। পাবনার বেড়া ও সাঁথিয়া এলাকার সন্তান নিজামী নিজ নির্বাচনী এলাকা থেকে জামায়াতে ইসলামীর মনোনয়নে ১৯৯১ ও ২০০১ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। চারদলীয় ঐক্যজোট সরকারের আমলে প্রথমে কৃষি ও পরে শিল্প মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। যুদ্ধাপরাধে ফাঁসির রায়ে দণ্ডিত নিজামীর ছেলে ব্যারিস্টার মোমিন এবার বাবার আসনে রাজনৈতিক ভবিষ্যতের বিষয়ে ভাবছেন। আগামীতে তিনি এই এলাকা থেকে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য যুদ্ধাপরাধী সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী (সাকা চৌধুরী) চট্টগ্রাম-২ আসন থেকে ৬ বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। রাউজানের সন্তান সাকা চৌধুরী ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সংসদ সম্পর্কিত কমিটির উপদেষ্টা ছিলেন। পারিবারিকভাবে রাজনৈতিক বলয়ে বড় হওয়া সাকা চৌধুরীর বাবা ফজলুল কাদের চৌধুরী বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্ববর্তী সময়ে পাকিস্তানের জাতীয় সংসদের স্পিকার এবং কয়েক দফায় পাকিস্তানের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর স্ত্রী ফারহাত কাদের চৌধুরী। তার দুই ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরী ও ফজলুল কাদের চৌধুরী এবং এক মেয়ে ফারজিন কাদের চৌধুরী। সাকা চৌধুরীর দুই ছেলের মধ্যে যে কোনো একজন আগামীতে রাউজান থেকে নির্বাচন করতে পারেন বলে জানা গেছে। সাকাপুত্র হুম্মাম কাদের চৌধুরী ইতোমধ্যে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনীতিতে নাম লিখিয়েছেন।

জামায়াতে ইসলামীর সিনিয়র সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ও দলটির মুখপাত্র দৈনিক সংগ্রামের নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন মোহাম্মদ কামারুজ্জামান। তিনি জামায়াতের সমর্থনে শেরপুর সদর তথা শেরপুর-১ আসন থেকে ১৯৯১, জুন ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮-এ অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন। ছাত্রশিবিরের প্রতিষ্ঠাকালীন এই শীর্ষ নেতার আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তার ছেলে ওয়াসি জামান। তিনি মাঝে মধ্যেই যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসির রায়ে দ-িত বাবার নির্বাচনী এলাকায় জনসংযোগ করছেন বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।

একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে প্রথম ফাঁসির রায় কার্যকর হয় জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার। জামায়াতের মনোনয়নে ১৯৮৬ এবং ১৯৯৬ সালে ফরিদপুর-৪ আসন থেকে দুবার সংসদ নির্বাচন করে পরাজিত হন। তবে কাদের মোল্লার দুই ছেলে এই মুহূর্তে অবস্থান করছেন দেশের বাইরে। তার মেয়ে আমাতুল্লাহ পারভিন ও ভাই মো. মাইনুদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাদের খবর জানা সম্ভব হয়নি। তাই এই পরিবারের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়নি।

ফরিদপুরের আরেক যুদ্ধাপরাধী প্রায় এক দশক ধরে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব পালনকারী আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ। জামায়াতে ইসলামীর মনোনয়নে ১৯৮৬, ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮-এর সংসদ নির্বাচনে ফরিদপুর-৩ আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। কিন্তু ২০০১ সালের নির্বাচন বাদে প্রতিবারই পরাজিত হন। নির্বাচিত হয়ে ২০০১ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত সমাজকল্যাণমন্ত্রীর দায়িত্বেও ছিলেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের বড় ভাই মোহাম্মাদ খালেছ ফরিদপুর জেলা জামায়াতের নায়েবে আমির।

ব্যবসায়ী নেতা যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম আলী জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতা হলেও মানিকগঞ্জে বাড়ি হওয়ায় কখনো মন্ত্রী-এমপি হতে পারেননি। বাংলাদেশের স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে জামায়াতে ইসলামীর প্রধান অর্থের জোগানদাতা মীর কাসেমের ইচ্ছা ছিল মানিকগঞ্জ-১ আসন থেকে নির্বাচন করার। কাসেমের পরিবারের কেউ এখন আর রাজনীতিতে আগ্রহী নয় বলে জানা গেছে।

যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ফাঁসির রায়ের পর আপিল বিভাগে রয়েছে জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত জেনারেল সেক্রেটারি এটিএম আজহারুল ইসলামের মামলা। জাতীয় পার্টির ঘাঁটি বলে খ্যাত রংপুর জেলার বদরগঞ্জ উপজেলার সন্তান আজহারুল ইসলাম ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রংপুর-২ (তারাগঞ্জ ও বদরগঞ্জ) আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। কিন্তু প্রতিবারই তার জামানাত বাজেয়াপ্ত হয় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর কাছে। জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে প্রভাব থাকলেও এলাকায় তেমন জনপ্রিয়তা না থাকায় এই আসনে আজহারের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ বেশি দূর এগোবে না বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতা যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযম আমৃত্যু কারাদণ্ড ভোগ করার সময় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মারা যান। বাংলাদেশে জামায়াতের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এ নেতা কখনো মন্ত্রী-এমপি হননি। তিনি জামায়াতের আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। গোলাম আযমের ছেলেদের মধ্যে সাবেক সেনা কর্মকর্তা আব্দুল্লাহিল আমান আযমী রাজনীতিতে আসতে পারেন বলে জামায়াত সূত্রে জানা গেছে।

সাখাওয়াত হোসেন ছিলেন জামায়াতে ইসলামী নেতা, পরে যোগ দেন বিএনপিতে এরপর জাতীয় পার্টিতে। যশোর-৬ আসন থেকে নির্বাচিত সাবেক সংসদ সদস্য সাখাওয়াতের এখনো বিচারকার্য চলছে। তিনি ১৯৯১ সালের নির্বাচনে যশোর থেকে জামায়াতে ইসলামীর মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এর কয়েক বছর পর তিনি জামায়াত ছেড়ে বিএনপিতে যোগ দেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। আবার ২০০১ সালের নির্বাচনে একই আসন থেকে বিএনপির মনোনয়ন না পেয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে পরাজিত হন। সাখাওয়াতের পরিবারের সদস্যরা রাজনীতিতে সম্পৃক্ত নন বলে জানা গেছে।

সাবেক মন্ত্রী যুদ্ধাপরাধী আব্দুল আলীম ১৯৭৭ সালে দুই দফা জয়পুরহাট পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৭৯, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে দলীয় মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি জিয়াউর রহমানের সরকারে প্রথমে বস্ত্রমন্ত্রী এবং পরে যোগাযোগমন্ত্রী ছিলেন। জয়পুরহাট-১ আসনের এই প্রয়াত সংসদ সদস্যের আসনে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন তার বড় ছেলে ফয়সল আলীম। বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ফয়সল নিয়মিত বাবার নির্বাচনী এলাকায় আসা-যাওয়া করেন। বাবার আসনেই পরবর্তী সময়ে ফয়সলের নির্বাচন করার চিন্তা-ভাবনা রয়েছে বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে।

যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী এখন চূড়ান্ত রায়ের পর আমৃত্যু কারাদণ্ড ভোগ করছেন। জামায়াতে ইসলামীর সাবেক নায়েবে আমির সাঈদী ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে প্রথমবার এবং ২০০১ সালের নির্বাচনে দ্বিতীয়বারের মতো বিজয়ী হয়ে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সাঈদীর সন্তানদের মধ্যে মাসুদ সাঈদী রাজনীতিতে সক্রিয়। ইতোমধ্যে তিনি পিরোজপুরের জিয়ানগর উপজেলায় জামায়াতে ইসলামীর সমর্থনে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজয়ী হয়েছেন। বাবা যুদ্ধাপরাধী সাঈদীর নির্বাচনী এলাকায় বর্তমানে উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। জানা গেছে, ভবিষ্যতে এই আসনে এমপি হওয়ার ইচ্ছা রয়েছে মাসুদ সাঈদীর।