যে অর্ধশত ব্যবসায়ী আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চাচ্ছেন
প্রতিটি জাতীয় সংসদেই বাড়ছে ব্যবসায়ী সাংসদের সংখ্যা। আগামী নির্বাচনেও প্রথমবারের মতো অংশ নিতে আটঘাট বেঁধে নেমেছেন নতুন অন্তত অর্ধশত ব্যবসায়ী। তারা সরকারি দল আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চান। জনসংযোগ এবং জনসেবায় মাঠে সক্রিয় রয়েছেন তারা। দলীয় কার্যালয়েও যাচ্ছেন নিয়মিত; যোগাযোগ রাখছেন নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে।
বর্তমান সংসদে ব্যবসায়ী সাংসদের সংখ্যা ৫৯ শতাংশ, অর্থাৎ দশম সংসদের মোট ১৭৭ এমপি কোনো না কোনো ব্যবসায় সম্পৃক্ত।
চলতি দশম সংসদে বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর সদস্য মোট ৩৭ সাংসদ রয়েছেন। তাদের মধ্যে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী রয়েছেন চারজন। আগামী নির্বাচনে তারাও মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন। তাদের একজন শাশা গার্মেন্টের একসময়ের চেয়ারম্যান, পানিসম্পদমন্ত্রী ও চট্টগ্রাম-৪ আসন থেকে জাতীয় পার্টির মনোনয়নে নির্বাচিত এমপি ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। আরেকজন হচ্ছেন সানোয়ারা গার্মেন্টের এমডি চট্টগ্রাম-৮ আসনে আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত এমপি এবং প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি।
এ ছাড়া রয়েছেন হামিদ ফ্যাশনের এমডি ঢাকা-৩ থেকে নির্বাচিত এমপি, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু এবং ইন্টারস্টপ অ্যাপারেলসের এমডি রাজশাহী-৬ থেকে নির্বাচিত এমপি ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম।
মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর বাইরেও বর্তমান সংসদে এমন অনেক আলোচিত-সমালোচিত সাংসদ রয়েছেন, যারা বিজিএমইএর সদস্য এবং একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে চলেছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন আওয়ামী লীগের সাংসদ সিপাল গার্মেন্টের এমডি ও বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি টিপু মুনশি। রংপুর-৪ আসন থেকে এবারও নির্বাচন করতে চাইছেন তিনি। রয়েছেন ঢাকা-১৪ আসনের এমপি ও অরবিট সোয়েটার্সের পরিচালক আসলামুল হক, ঢাকা-১৫-এর এমপি ও বেস্ট ডেনিম অ্যাপারেলের এমডি কামাল আহমেদ মজুমদার, সিরাজগঞ্জ-৫-এর সাংসদ ও মনট্রিনস গ্রুপের এমডি আবদুল মজিদ মণ্ডল, কুমিল্লা-৯-এর এমপি ও ফাবিয়ান গ্রুপের এমডি তাজুল ইসলাম চৌধুরী, বাগেরহাট-৩-এর সাংসদ, সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও মুনস্টার পলিমারের এমডি তালুকদার আবদুল খালেক।
দোহার-নবাবগঞ্জ নিয়ে গঠিত ঢাকা-১ আসনে আগামী নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি খাতবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। ২০০১ সালের নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ধানের শীষের প্রার্থী নাজমুল হুদার কাছে পরাজিত হন তিনি। আগামী নির্বাচন উপলক্ষে তিনি এলাকায় নিয়মিত গণসংযোগ করছেন। এবার তার জনসমর্থনও বেশি।
পোশাক খাতের উদ্যোক্তাদের মধ্য থেকেও বেশ কয়েকটি নতুন মুখ দেখা যাবে একাদশ সংসদ নির্বাচনে। প্রথমবারের মতো জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে মাঠে রয়েছেন বিজিএমইএর সহসভাপতি এবং চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক মোহাম্মদ নাছির। চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া) থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে লড়তে চান তিনি। সমকালকে নাছির বলেন, ছাত্রজীবন থেকে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে তিনি জড়িত আছেন। নেত্রী তাকে মনোনয়নের জন্য বিবেচনা করলে জয়ের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী তিনি।
বিজিএমইএর সহসভাপতি এস এম মান্নান কচি নির্বাচন করতে চাইছেন আওয়ামী লীগের মনোনয়নে ঢাকা-১৬ আসন থেকে। একসময় ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকসহ মহানগর আওয়ামী লীগের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। সমকালকে তিনি বলেন, জাতির পিতার হত্যার বিচার দাবি ছাড়া অন্য কোনো চাওয়া-পাওয়া ছিল না তার। এখন বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়তে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে কাজ করতে চান তিনি।
বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ও তারকা ফুটবলার আবদুস সালাম মুর্শেদী খুলনা-২ থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নির্বাচন করার প্রত্যাশা করছেন। সমকালকে তিনি সরকারের শীর্ষমহল থেকে সবুজসংকেত পাওয়ার কথা জানিয়ে বলেন, প্রথমে খেলোয়াড় ও পরে নেতৃত্বশীল ব্যবসায়ী হিসেবে মানুষ তাকে ভালোবাসে। এলাকায় তিনি সামাজিক কার্যক্রমের সঙ্গেও সম্পর্কিত। তাই জয়ের ব্যাপারে দৃঢ় আশা রয়েছে তার।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর আটজন পরিচালকও প্রথমবারের মতো এবার প্রার্থী হতে চলেছেন। সংগঠনের পরিচালনা পর্ষদের সহসভাপতি মুনতাকিম আশরাফ চাইছেন কুমিল্লার চান্দিনা থেকে প্রার্থী হতে। এ আসনের বর্তমান সাংসদ আলী আশরাফ। মুনতাকিম আশরাফ বলেন, আগামী নির্বাচনেও তার বাবা আলী আশরাফের নির্বাচন করার সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি নির্বাচন না করলে সে ক্ষেত্রে তিনি প্রার্থী হতে পারেন।
এফবিসিসিআইর সাবেক সহসভাপতি হেলাল উদ্দিন আগামী নির্বাচনে নরসিংদী-৪ আসনের মনোহরদী-বেলাব এলাকা থেকে প্রথমবারের মতো ভোটে দাঁড়াতে চাইছেন। তিনি হাবীবুল্লাহ বাহার বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। হেলাল উদ্দিন বলেন, আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নির্বাচন করে এলাকার এমপি হলে তিনি কৃষিনির্ভর ওই এলাকার কৃষকদের নিয়ে সমবায় সমিতি করে কৃষিপণ্য বিপণনের পদক্ষেপ নেবেন। তা ছাড়া মনোহরদী-বেলাবকে মাদকমুক্ত করবেন।
এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি মাতলুব আহমাদের সহধর্মিণী এবং নিটল-নিলয় গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের ভাইস চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ উইমেন্স চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি সেলিমা আহমাদ। তিনি কুমিল্লা-২ আসনে (হোমনা-তিতাস) আগামী নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে নৌকার মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন। মাতলুব আহমাদ জানান, তিনি আগামী নির্বাচনে অংশ নেবেন না। তবে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে তার স্ত্রী কুমিল্লা থেকে নির্বাচন করবেন। এ জন্য তিনি নিয়মিত ওই এলাকায় জনসংযোগ করছেন। তিনি নির্বাচিত হলে হোমনা- তিতাস এলাকার উন্নয়ন ও শিল্পায়নের জন্য কাজ করবেন।
এফবিসিসিআইর পরিচালক মোহাম্মদ বজলুর রহমান নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ এলাকা থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন। সমকালকে তিনি বলেন, স্থানীয়দের সমর্থন তার পক্ষে থাকায় নির্বাচন করতে আগ্রহ বোধ করছেন। তার ভাই অধ্যাপক রেজাউল করিম ওই আসনে চারবার বিএনপি থেকে সংসদ সদস্য হয়েছেন। এবার তার ভাই নির্বাচন করবেন না। পারিবারিক ঐতিহ্য অনুসারে জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে নির্বাচন করতে চাইছেন তিনি।
চুয়াডাঙ্গা থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন আশা করছেন এফবিসিসিআইর পরিচালক দিলীপ কুমার আগারওয়ালা। তিনি চুয়াডাঙ্গা চেম্বারের সভাপতি ও বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির সাধারণ সম্পাদক। সমকালকে তিনি বলেন, সবার সমর্থন নিয়েই আগামী নির্বাচনে প্রার্থী হতে চান। চুয়াডাঙ্গায় কোনো শিল্পনগরী হয়নি। তিনি সংসদ সদস্য হলে শিল্পোন্নয়ন ঘটাবেন।
টাঙ্গাইলের কালিহাতী থেকে নির্বাচন করতে চান এফবিসিসিআইর পরিচালক আবু নাসের। কুরিয়ার সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এই নেতা সমকালকে বলেন, গত দুই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েও পাননি। টাঙ্গাইলের শিল্পোন্নয়নের লক্ষ্যে এবার মনোনয়নের আশা করছেন তিনি।
এফবিসিআইর পরিচালক বিশিষ্ট অভিনেত্রী শমী কায়সার প্রার্থী হতে চান নোয়াখালী-১ আসন থেকে।
নরসিংদী-৪ (বেলাব ও মনোহরদী) থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চাইবেন নিট পোশাক ব্যবসায়ীদের সংগঠন বিকেএমইএর সাবেক প্রথম সহসভাপতি আসলাম সানি। সমকালকে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর কাছে মনোনয়ন চাইবেন তিনি। নেত্রী বিবেচনা করলে নির্বাচন করবেন। ছাত্রজীবন থেকেই জাতির পিতার আদর্শের রাজনীতি করে আসছেন। দলের দুর্দিনে ঝুঁকি নিয়ে নরসিংদীতে নেতৃত্ব দিয়েছেন। কারা মনে-প্রাণে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেন- সেটা নেত্রী ভালো করেই জানেন। ফলে দলীয় মনোনয়নের বিষয়ে আশাবাদী তিনি।
মানিকগঞ্জ চেম্বারের সভাপতি ও এফবিসিসিআইর পরিচালক তাবারুকুল তোসাদ্দেক হোসেন খান টিটু। মানিকগঞ্জ থেকে নির্বাচন করতে আগ্রহী এই নেতা বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমর্থনে নির্বাচন করতে চাইছেন তিনি। আওয়ামী লীগ সভাপতির সমর্থন পেলে জয়ের ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী তিনি।
ময়মনসিংহ সদর আসন থেকে নির্বাচন করতে চান এফবিসিসিআইর পরিচালক আমিনুল হক শামীম। আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচন করার লক্ষ্যে এলাকায় জনসংযোগ অব্যাহত রেখেছেন তিনি। স্থানীয়দের কাছ থেকে যেমন সাড়া পাচ্ছেন, তাতে জয়ের ব্যাপারে তিনি আশাবাদী হয়ে উঠেছেন। শিল্পোন্নয়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্য নিয়ে নির্বাচিত প্রতিনিধি হতে চাইছেন তিনি। মাদক ও সন্ত্রাসমুক্ত এলাকা গড়ে তোলার লক্ষ্যও রয়েছে তার।
জামালপুর থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করতে চান এফবিসিসিআইর আরেক পরিচালক রেজাউল করিম রেজনু। বর্তমানে তিনি জামালপুর চেম্বারের সভাপতি। রেজনু ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক। ইতিমধ্যে তিনি ব্যাপক জনসংযোগ শুরু করেছেন। রেজনু সমকালকে বলেন, ১৭ বছর ছাত্র রাজনীতি করেছি। ১৪ বছর ধরে জামালপুর জেলা আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত আছি। আশা করি- আসছে নির্বাচনে দল থেকে মনোনয়ন পাব ও তৃণমূলের সমর্থনে জয়ী হবো।