আ’লীগ-বিএনপিতে থাকতে পারে চমক

পুরান ঢাকার লালবাগ-চকবাজার-বংশাল থানার ১৩টি ওয়ার্ড নিয়ে ঢাকা-৭ আসনে ভোটের প্রচার শুরু হয়ে গেছে। এ আসনে ২০১৪ সালের একতরফা অথচ তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ভোটে নৌকার হেভিওয়েট প্রার্থী হেরে যান। ওই নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী এখন অসুস্থ। ফলে আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন চমকের অপেক্ষায় স্থানীয় নেতাকর্মীরা।
আরেক বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপির সাবেক এমপি প্রয়াত নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টুর মৃত্যুর পর ধানের শীষেও নতুন মুখের আশায় স্থানীয় নেতাকর্মীরা। এরই মধ্যে বড় দুই দলের মনোনয়ন পেতে ৩ লাখ ভোটারের এ আসনে ডজনখানেক নেতা মাঠে সক্রিয়।
এলাকা ঘুরে দেখা যায়, এখানকার মূল সমস্যা যানজট। রাস্তা সরু হওয়ায় প্রতিদিনই ভয়াবহ যানজটের কবলে পড়ছে স্থানীয়রা। সারা দেশ থেকে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা চকবাজারে পাইকারী মালামাল কিনতে আসায় যানজট ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে।
তবে সড়ক চওড়া করার একটা চেষ্টা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ ছাড়াও মাদকের ভয়াবহতা বাড়ছে। নদী ও বেড়িবাঁধসংলগ্ন হওয়ায় সহজেই এলাকায় ঢুকছে মাদক। চামড়া শিল্পের কারণে পরিবেশে মারাত্মক প্রভাব পড়লেও তা অনেকটা কমে আসছে।
এ আসনের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, বিশেষ করে নব্বইয়ের পটপরিবর্তনের পর ১৯৯১ সালে ৫ম সংসদ নির্বাচনসহ ১৯৯৬ সালের বিতর্কিত ১৫ ফেব্র“য়ারি ভোটে তৎকালীন ঢাকা-৮ (বর্তমানে ঢাকা-৭) আসনে জয়লাভ করেন বিএনপির প্রয়াত লে. জে. মীর শওকত আলী।
১৯৯৬ সালের নির্বাচনে এমপি হন হাজী মোহাম্মদ সেলিম। ২০০১ সালে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা হাজী সেলিমকে হারিয়ে এমপি হন বিএনপির প্রয়াত নাসির উদ্দিন আহম্মেদ পিন্টু। ২০০৮ সালে নাসির উদ্দিন আহম্মেদ পিন্টুকে হারিয়ে জয়ী হন আওয়ামী লীগের মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন। সবশেষ ২০১৪ সালের ভোটে মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনকে হারিয়ে এমপি হন হাজী মোহাম্মদ সেলিম।
বেশ কিছু দিন ধরে ভীষণ জনপ্রিয় আওয়ামী লীগ নেতা হাজী সেলিম অসুস্থ। সেভাবে কথা বলতে না পারায় জনগণের সঙ্গে একটা দূরত্বও তৈরি হয়েছে। এ সুযোগে শাসক দলের মনোনয়নের আশায় দলের একাধিক প্রার্থী দৌড়ঝাঁপ করছেন।
অন্যদিকে বিডিআর বিদ্রোহ মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত সাবেক এমপি ও ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি নাসির উদ্দিন পিন্টু জেলে থাকা অবস্থায়ই ২০১৫ সালের ৩ মে রাজশাহী মেডিকেলে মারা যান।
তার মৃত্যুর পর এ আসনে ধানের শীষের প্রতীক পেতে একাধিক নেতা দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন।
চকবাজার মোড়ে চায়ের দোকানি আবদুল খালেক বলেন, আবারও নৌকা ও ধানের শীষের লড়াই দেখার অপেক্ষায় আমরা। বড় দল ভোটে না এলে আনন্দ পাই না। দুই দল এলে কে জিতবে বলা কঠিন। নির্বাচন সামনে রেখে প্রার্থীদের অনেকেই এলাকার নানা অনুষ্ঠানে হাজির হচ্ছেন।
আওয়ামী লীগ : ঢাকা-৭ আসনের এমপি আওয়ামী লীগ নেতা হাজী সেলিম অসুস্থ হলেও আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন চাইবেন, হাল ছাড়েননি ডা. মোস্তফা জালালও। তাদের পাশাপাশি এ আসনে দলের টিকিট পেতে মাঠে নেমেছেন আরও দু’জন।
তারা হলেন- ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি এবং বৃহত্তর লালবাগ থানার সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও ২৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হুমায়ুন কবীর এবং ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আকতার হোসেন।
তৎপরতা ও গ্রহণযোগ্যতায় এ দু’জন অনেক দূর এগিয়েছেন। তবে মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হাসনাতের তৎপরতা না থাকলেও তিনি মনোনয়ন চাইবেন।
এলাকায় ব্যাপক জনপ্রিয়তা থাকার পরও কথা বলতে সমস্যা হওয়ায় এমপি হাজী সেলিমের মনোনয়ন নিয়ে সংশয় রয়েছে। এদিকে ডা. মোস্তফা জালালের সঙ্গে নেতাকর্মীদের একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে বলে জানা গেছে। ১/১১-এর পর দু’বার মনোনয়ন পেলেও দলে এখন তিনি অনেকটাই কোণঠাসা।
২০১৪ সালের ভোটে হারার পর আগামী নির্বাচনে তার মনোনয়ন নিয়েও আছে সংশয়। অবস্থা বুঝে অন্য প্রার্থীরা এলাকায় সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। তবে আগামী নির্বাচনে মনোনয়নের বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন যুগান্তরকে বলেছেন, নিয়মিত গণসংযোগ, উঠান বৈঠক করছি। মনোনয়নের পর মূল নির্বাচনী কাজ শুরু হবে।
এ আসনে পুরান ঢাকার প্রার্থীর প্রতি ব্যাপক সহানুভূতি রয়েছে ভোটারদের। এ কারণেই গত নির্বাচনে হাজী সেলিম স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নৌকার প্রার্থীকে হারিয়ে বিজয়ী হন। অসুস্থতার পরও পুরোদমে মাঠে রয়েছেন হাজী সেলিম। যোগ দিচ্ছেন কর্মিসভাসহ দলীয় সব কর্মসূচিতে।
তার মূল সমস্যা- কথায় অস্পষ্টতা। এই ফাঁকে সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে মাঠে এসেছেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি হুমায়ন কবীর। আদি ঢাকাইয়া ও শিক্ষিত প্রার্থী হিসেবে এলাকায় তার গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে।
এছাড়া বৃহত্তর লালবাগ (লালবাগ-হাজারীবাগ-কামরাঙ্গীরচর) থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ২৪ বছর। আর ১৯৯৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত টানা তিনবারের ওয়ার্ড কমিশনার তিনি। হুমায়ন কবীর বলেন, দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়মিত আলোচনা, গণসংযোগ করছি।
আমি দীর্ঘদিন বৃহত্তর লালবাগে সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছি। আসনের সবাই আমাকে চেনেন। যদি দল মনোনয়ন দেয় তাহলে পুরান ঢাকার মানুষ হিসেবে ভোটে জয়লাভ করতে আমার বেগ পেতে হবে না।
এদিকে উদীয়মান প্রার্থী হিসেবে জায়গা করে নিয়েছেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক আকতার হোসেন। বৃহত্তর ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপ-কমিটির সহ-সম্পাদক ছিলেন গতবার।
দল তরুণ প্রার্থী বাছাই করলে আকতার হোসেনের মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন থেকে আমি রাজনীতি করছি। ছাত্রজীবন থেকে নানা ত্যাগ, জেল-জুলুম সহ্য করে আন্দোলন করে দলকে ক্ষমতায় এনেছি।
এক-এগারোর সময় নেত্রীর মুক্তির দাবিতে রাজপথে সক্রিয় ছিলাম। এখন আমার নেত্রী শেখ হাসিনা যদি মনোনয়ন দেন নির্বাচন করব। আমাকে না দিলে যাকে দেবেন তার পক্ষে নিবেদিতভাবে কাজ করব।
বিএনপি : প্রয়াত নাসির উদ্দিন পিন্টু এ আসনে বিএনপির রাজনীতি এক হাতে নিয়ন্ত্রণ করতেন। তার মৃত্যুর পর একাধিক প্রার্থী মনোনয়নের জন্য দৌড়ঝাঁপ করছেন।
দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা হচ্ছেন- পিন্টুর স্ত্রী বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও ঢাকা দক্ষিণ বিএনপির সহ-সভাপতি নাসিমা আক্তার কল্পনা, বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-যুববিষয়ক সম্পাদক মীর নেওয়াজ আলী নেওয়াজ, মহানগর (দক্ষিণ) বিএনপির সহ-সভাপতি আবু মোতালেব, সহ-সভাপতি মোশাররফ হোসেন খোকন, পিন্টুর ভাই জাসদ ছাত্রলীগের ঢাকা মহানগরের সাবেক সভাপতি নসিম আহমেদ রিন্টু ও অবিভক্ত ঢাকা মহানগর ছাত্রদল কমিটি সহ-সভাপতি আবদুল মোনায়েম লিলি।
এদের মধ্যে এগিয়ে রয়েছেন নাসিমা আক্তার কল্পনা। ২০০২ সালে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সংরক্ষিত ১৯ নম্বর মহিলা ওয়ার্ড কমিশনার নির্বাচিত হলেও পিন্টুর মৃত্যুর পর তিনি আলোচনায় আসেন। স্বামীর রাজত্ব ধরে রাখতে সচেষ্ট হন তিনি। তবে স্থানীয় নেতাকর্মীদের অভিযোগ, এখনও পিন্টুর বিকল্প হতে পারেননি তিনি। সংগঠনকে সেভাবে সময় দিতে না পারায় স্থানীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে তার দূরত্ব রয়েই গেছে।
এ বিষয়ে নাসিমা আক্তার কল্পনা বলেন, দলের দুর্দিনে রাজপথে থাকার পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে কাজ করে যেতে সর্বাÍক চেষ্টা করছি। স্বামীর মৃত্যুর পর পরিবার, রাজনীতিসহ সব দিকই একা সামলাতে হচ্ছে, ফলে নেতাকর্মীর সব প্রত্যাশা পূরণ করা অনেক সময় সম্ভব হচ্ছে না।
আলোচনায় রয়েছেন বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী ব্যবসায়ী নেতা আবু মোতালেব। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির এ সহ-সভাপতি ১৯৮৩-৮৪ সালে তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ শাখার ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ’৯২-৯৬ মেয়াদে বৃহত্তর লালবাগ থানার যুগ্ম-সম্পাদক ও পরে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ছিলেন।
তিনি একাধিকবার এফবিসিসিআই’র পরিচালক নির্বাচিত হন। বর্তমান পরিচালনা পর্ষদে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে পরিচালক হন। নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়নে সরকার যখন মরিয়া হয়ে ওঠে তখন ‘ব্যবসায়ী ঐক্য ফোরাম’ গঠন করে পুরান ঢাকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ঐক্যবদ্ধ করে মাঠে নামেন। পরে সরকার বাধ্য হয়ে নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন থেকে সরে আসে। চকবাজার ও লালবাগের নেতাকর্মীদের এক রাখতেও তার ভূমিকা রয়েছে।
জানতে চাইলে আবু মোতালেব বলেন, ভয়ভীতি উপেক্ষা করে দলের পক্ষে কাজ করছি। তিনি বলেন, নাসিরউদ্দিন পিন্টু জীবিত থাকলে আমরাও তার পক্ষে কাজ করতাম। কিন্তু পিন্টুর অনুপস্থিতিতে আসনটি কার পক্ষে পুনরুদ্ধার করা সম্ভব সে ব্যাপারে ভোটারদের সঙ্গে কথা বললেই বোঝা যাবে। আশা করি নীতিনির্ধারকরা সবদিক বিবেচনায় আমাকেই মনোনয়ন দেবে।
এলাকায় কাজ করে যাচ্ছেন মীর নেওয়াজ আলী নেওয়াজ। ছাত্রদলের সহ-সভাপতি, ঢাকা কলেজের ভিপি, যুবদলের ঢাকা মহানগরের সাধারণ সম্পাদক, যুবদল কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করা এ নেতা বর্তমানে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সহ-যুববিষয়ক সম্পাদক।
তার বড় ভাই মীর আশরাফ আলী আজম ঢাকা মহানগর বিএনপির নেতা, আরেক ভাই মীর শরাফত আলী সফু বিএনপির কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবকবিষয়ক সম্পাদক।
নেওয়াজ যুগান্তরকে বলেন, বিএনপি ভোটে অংশ নিলে মনোনয়ন চাইব। ১/১১’র সময় থেকে রাজপথে আছি এবং কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় রাজনীতিতে ভূমিকার জন্য হাইকমান্ড আমাকে বিবেচনা করবেন বলে আশাবাদী।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক রফিকুল ইসলাম রাসেলও এলাকায় বেশ জনপ্রিয়। বিগত সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন বিএনপি বর্জন করলেও ৩১নং ওয়ার্ড থেকে কাউন্সিলর পদে জয়লাভ করেন তিনি।
সম্প্রতি রাসেলসহ মহানগরের প্রভাবশালী ১৬ নেতাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক ইসহাক সরকার মনোনয়ন চাইবেন বলে জানা গেছে।
জাতীয় পার্টি : ঢাকা-৭ আসনে জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য সাইফুদ্দিন আহমেদ মিলন প্রার্থী হচ্ছেন। কয়েক বছর ধরে রাজধানীতে ব্যানার, পোস্টার ও ফেস্টুনের মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার চালান তিনি।
দলেও তার ভালো প্রভাব রয়েছে। মিলন যুগান্তরকে বলেন, আগামী নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিয়ে তিনি মাঠে রয়েছেন। মহাজোটগতভাবে নির্বাচন হলে মনোনয়ন পাবেন বলেও আশাবাদী তিনি।
এছাড়া ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নেতা আবদুর রহমান আগামী জাতীয় নির্বাচনে মনোনয়ন পেতে চাইছেন।