English Version
আপডেট : ৪ নভেম্বর, ২০১৭ ১২:০৬

জয় পেতে মরিয়া আ.লীগ-বিএনপি

অনলাইন ডেস্ক
জয় পেতে মরিয়া আ.লীগ-বিএনপি

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর মাত্র এক বছর বাকি। নির্বাচন কেন্দ্র করে দেখা দেওয়া নানা বিতর্কে সরগরম নির্বাচনী রাজনীতি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ চাইছে, সংসদের বাইরে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচনে আসুক। বিএনপিও বলছে তারা নির্বাচনে যাবে। অথচ নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতিসহ বেশ কিছু ইস্যুতে এখনো মুখোমুখি অবস্থানে দল দুটি। সরকার যদিও বলছে, এবার নির্বাচন হবে সব দলের অংশগ্রহণে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক; কিন্তু সংকট সমাধানে এখন পর্যন্ত কোনোপক্ষকেই কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যাচ্ছে না। প্রতিদিনই রাজনীতিতে দেখা দিচ্ছে নানা মেরুকরণ। আশা-নিরাশার দোলাচলে দুলছে দেশ।

এরই মধ্যে রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ হয়ে আসছে দেশের গুরুত্বপূর্ণ ছয় সিটি করপোরেশনের নির্বাচন। নির্বাচনী সিটিতে বইছে ভোটের হাওয়া। এর মধ্যে রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে আগামী ২১ ডিসেম্বর। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে আগামীকাল রোববার। এর আগে ২০১২ সালের ২০ ডিসেম্বর হয় রংপুর সিটির নির্বাচন। সিটি করপোরেশন নির্বাচনের বিধিমালা অনুযায়ী, মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের ১৮০ দিনের মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে। ২০১৩ সালের ১৫ জুন রাজশাহী, খুলনা, সিলেট ও বরিশাল এবং ৬ জুলাই গাজীপুর সিটির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সে হিসাবে আগামী বছরের মার্চ মাসে চার সিটি এবং পরের মাসেই এক সিটিতে নির্বাচন হওয়ার কথা।

ইতোমধ্যেই এই নির্বাচন নতুন করে উত্তাপ ছড়াতে শুরু করেছে জাতীয় রাজনীতিতে। তারিখ নির্ধারণ হওয়ায় নির্বাচন ঘিরে রংপুর এখন সরগরম। প্রার্থীও চূড়ান্ত প্রায় রাজনৈতিক দলগুলোর। পাশাপাশি অন্য পাঁচ সিটিতেও বইছে ভোটের হাওয়া। চায়ের দোকান, রাস্তাঘাট, রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশে ঘুরেফিরে আসছে নির্বাচনী আলোচনা। শোভা পাচ্ছে সম্ভাব্য প্রার্থীদের পোস্টার-ব্যানার। শুরু হয়েছে প্রার্থী বাছাইয়ের তোড়জোড়। আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু না হলেও গোপনে জরিপ চালাচ্ছে বড় দলগুলো। সম্ভাব্য প্রার্থীরা মাঠে দৌড়ঝাঁপের পাশাপাশি জোর তদ্বির করছেন কেন্দ্রে।

এর আগে ছয় মহানগরীর মধ্যে রংপুর ছাড়া রাজশাহী, খুলনা, সিলেট, বরিশাল ও গাজীপুরে বিএনপি সমর্থক প্রার্থীরা গত সিটি নির্বাচনে মেয়র পদে জয়ী হয়েছিলেন। ফলে এই নির্বাচন প্রধান দুই রাজনৈতিক দল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও ক্ষমতার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। একদিকে ক্ষমতাসীনরা চাইছে ক্ষমতার পুনরুদ্ধার। আর বিএনপির ইচ্ছে জয় অব্যাহত রাখা। সে জন্য এ নির্বাচন নিয়ে বেশ তোড়জোড় দলের মধ্যে। দল দুটি কষতে শুরু করেছে নির্বাচনী ছক। কেবল জয়ই নয়, এই নির্বাচন মর্যাদার লড়াইও মনে করছেন দলের নেতারা। তাই জয়ের লক্ষ্য নিয়ে দুই দলই যোগ্য প্রার্থী বাছাইয়ে উঠেপড়ে লেগেছে। ভিন্ন ভিন্ন কৌশলে এগোচ্ছে নির্বাচনের দিকে।

নির্বাচন নিয়ে ভাবছেন স্থানীয় মানুষও। যদিও গত নির্বাচনে এসব সিটিতে উল্লেখযোগ্য কোনো সহিংসতার ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু নানা কারণেই বেশ সমালোচিত ছিল মাঝখানে অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন ও উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। সেখানে ভোটকেন্দ্র দখল, ব্যালট ছিনতাইসহ বেশ কিছু সহিংসতার ঘটনা ঘটে। অবশ্য এরপর নতুন নির্বাচন কমিশন এসেছে। সে কমিশন ইতোমধ্যে সুষ্ঠুভাবে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন করেছে। তারপরও সংশয় কাটছে না মানুষের। কারণ এই ছয় সিটিতে মেয়র পদে জয়-পরাজয় জাতীয় রাজনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে। ফলে দুই প্রধান দল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এ নির্বাচনে জয় পেতে কী ধরনের আচরণ করে, সেদিকেই তাকিয়ে সবাই।

এ মুহূর্তে ছয় সিটির নির্বাচনী মাঠের খবর কী? জানতে চাইলে আমাদের প্রতিনিধিরা বলেছেন, রংপুর ছাড়া অন্য পাঁচ সিটিতে এখনো নির্বাচনী হাওয়ায় তেমন গতি নেই। তবে আলোচনা হচ্ছে। স্থানীয় মানুষ শান্তিপূর্ণ সুষ্ঠু নির্বাচন প্রত্যাশা করছেন। এখন পর্যন্ত নির্বাচন ঘিরে সহিংসতা বা জোর খাটিয়ে নির্বাচনে জেতার কোনো ধরনের আভাস নেই। গতবারের নির্বাচনেও কোনো ধরনের সহিংতা ঘটেনি। বরং রাজনৈতিক দলগুলো সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষেই কথা বলছে। তবে ক্ষমতায় থেকেও তেমন উন্নয়ন না হওয়ায় সংশ্লিষ্ট সিটিতে মেয়র পদে পরিবর্তন চাইছেন স্থানীয়রা। পাশাপাশি মামলা-মোকদ্দমার কারণে বিএনপি দলীয় মেয়রদের চলতি মেয়াদে খুব একটা কাছে পাননি স্থানীয়রা। উন্নয়ন তহবিল সংগ্রহেও ব্যর্থ হয়েছেন তারা। তাই এবার সরকারদলীয় মেয়রের পক্ষেই কথা বলছেন অনেকে।

নির্বাচন নিয়ে ভাবনা কী-জানতে চাইলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ বলেন, কাদের মনোনয়ন দেওয়া হবে, সেটা নিয়ে আলোচনা চলছে। এসব সিটিতে যথাসময়ে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে। প্রতিটিতেই আওয়ামী লীগ অংশ নেবে। অতীতের সিটি করপোরেশন নির্বাচনের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানো হবে। আশা করছি, এবার সব নির্বাচনে আমরা জয়ী হব। দেশের মানুষ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড এবং দেশ পরিচালনায় তার সাফল্যে খুশি। আশা করছি নির্বাচনে এর সঠিক মূল্যায়ন করবে।

একইভাবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ছয় সিটিতেই আমাদের প্রস্তুতি আছে। বর্তমান মেয়র আছে। বিকল্প প্রার্থীও আছে। আমাদের মনোনয়ন বোর্ড প্রার্থী চূড়ান্ত করবে। সাংগঠনিক অবস্থান ও জনপ্রিয়তাসহ বিভিন্ন বিষয় বিবেচনায় এনে প্রার্থী চূড়ান্ত করা হবে। ধারাবাহিক মূল্যায়নের পর আসবে চূড়ান্ত মূল্যায়ন।

নির্বাচন বিশ্লেষকরা এই নির্বাচনকে দেখছেন বড় দুই রাজনৈতিক দলের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ হিসেবে। তাদের মতে, এই নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের মধ্য দিয়েই দলগুলোর জনপ্রিয়তা প্রমাণ হবে। এর প্রভাব পড়বে জাতীয় নির্বাচনেও। এই নির্বাচন অনুষ্ঠানের ধরনের ওপর নির্ভর করবে জাতীয় নির্বাচনের পরিবেশ। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার আদৌ অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচন চায় কি না; আর নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে বিএনপিও আদৌ ইতিবাচক কি নাÑএই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তার পরীক্ষাও হবে। এমনকি এই নির্বাচন নির্বাচন কমিশনের (ইসি) জন্যও বড় চ্যালেঞ্জ বলেও মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তারা সব পক্ষকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, এই নির্বাচন অবশ্যই গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক হতে হবে। তা না হলে জাতীয় নির্বাচনের ব্যাপারে ভিন্ন ধরনের সংকেত যাবে মানুষের কাছে।

এই নির্বাচনের দিকে দেশের মানুষ তাকিয়ে আছে-উল্লেখ করে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমদ বলেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে এমনিতেই রাজনীতি সরগরম। নানা ইস্যুতে নানা আলোচনা চলছে। ফলে এ নির্বাচন কেবল ছয় সিটির জন্য নয়, দেশবাসীর জন্য বড় আগ্রহের কারণ হয়ে উঠেছে। নতুন নির্বাচন কমিশন জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে কতটা সক্ষম হবে তা, এসব নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর বোঝা যাবে। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে সরকারের সদিচ্ছাও প্রকাশ পাবে। বেশির ভাগ সিটির বর্তমান মেয়র বিএনপি মনোনীত। তারা নির্বাচিত হওয়ার পর কাজ করতে পারেননি বলে বিএনপি অভিযোগ করছে। এ অবস্থায় নতুন প্রার্থী কে হচ্ছেন এ নিয়ে স্থানীয়ভাবেও কৌতূহল বাড়ছে। পাশাপাশি জয় পেতে ক্ষমতাসীনরা কেমন আচরণ করে, সেদিকেও লক্ষ থাকবে সবার।

তবে সরকারকে বিশেষভাবে সতর্ক করে দিয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফল অবশ্যই জাতীয় নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে। গত মেয়াদে ছয়টির মধ্যে পাঁচটিতেই জিতেছিল বিএনপি। সে সময় সরকারের ধারণা হয়েছিল, সুষ্ঠু নির্বাচন দিলে ক্ষমতাসীনরা হারবে। তাই আর কোনো নির্বাচনই সুষ্ঠু হয়নি। তবে কেবল সুষ্ঠু নির্বাচনই নয়, নির্বাচিতদের কাজ করতে দিতে হবে। যদি সুষ্ঠু নির্বাচন হয়, তা হলে এর মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ও সরকারের মাঠ পর্যায়ের জনপ্রিয়তা প্রমাণ হবে। সে অনুযায়ী তারাও নির্বাচনী রাজনীতির ছক কষতে পারবে। তাই এই নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া অবশ্যক। সে জন্য সরকারকে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে হবে। ইসিকে শক্তিশালী হতে হবে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোরও দায়িত্ব রয়েছে। যদি এই নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও অংশগ্রহণমূলক না হয়, তা হলে জাতীয় নির্বাচনেও সংকট দেখা দিতে পারে।

আর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও নির্বাচন বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ বলেন, এই নির্বাচন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মাঠপর্যায়ে বাস্তব অবস্থা জানার গুরুত্বপূর্ণ ব্যারোমিটার। কারণ তারা দলীয়ভাবে যেসব তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেন, তাতে দলীয় ও ব্যক্তি প্রভাব থাকে। ফলে দলগুলো মাঠের প্রকৃত খবর পায় না। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তাদের কাছে সঠিক বার্তা যাবে। সে অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে হবে। সে জন্য নির্বাচন হতে হবে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ। কোনো ধরনের প্রভাব খাটানো চলবে না। দুই দলকেই (আওয়ামী লীগ ও বিএনপি) দায়িত্ব সচেতন হতে হবে। নির্বাচন অনুষ্ঠান ও অংশগ্রহণের ব্যাপারে ইতিবাচক হতে হবে। একইভাবে ইসিকেও খোলা মন ও আস্থা নিয়ে নির্বাচন পরিচালনা করতে হবে। এটা তাদের জন্যও পরীক্ষা।