আ. লীগে প্রবীণ-নবীনে মনোনয়ন ‘লড়াই’

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে গাইবান্ধা-৫ (সাঘাটা-ফুলছড়ি) আসনটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এই আসন নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে জল্পনা-কল্পনা ক্রমাগত ডালপালা মেলতে শুরু করেছে। বন্যা, অব্যাহত নদীভাঙনকবলিত হয়ে সাঘাটা ও ফুলছড়ি উপজেলায় ছিন্নমূল মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকায় স্থায়ী সমাধানের ব্যাপারে জনপ্রতিনিধিদের ওপর চাপও তৈরি হয়েছে।
তবে সবচেয়ে বড় যে কারণে আসনটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে তা হলো ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী মনোনয়ন। এ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য প্রবীণ পার্লামেন্টারিয়ান জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া। ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি জাতীয় পর্যায়ের সম্ভাবনাময় রাজনীতিবিদ মাহমুদ হাসান রিপনের নির্বাচনী এলাকাও এ আসন। এই দুই গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিবিদ দলীয় মনোনয়নের জন্য প্রার্থী হবেন এটা নিশ্চিত বলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা জানিয়েছে।
জাতীয় সংসদের ৩৩ নম্বর নির্বাচনী এলাকাটিতে আরেক বড় দল বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের প্রার্থী হিসেবেও অনেকের নাম শোনা যাচ্ছে। আসনটি একসময় বর্তমান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির প্রভাববলয়ভুক্ত হওয়ায় দলটির প্রার্থী মনোনয়নের বিষয়টি ভোটারদের আগ্রহের কেন্দ্রে রয়েছে।
আওয়ামী লীগ : দীর্ঘকাল ধরে সেখান থেকে নির্বাচিত হয়ে আসছেন আওয়ামী লীগের বর্তমান সংসদ সদস্য ফজলে রাব্বী মিয়া। জাতীয় পার্টির টিকিটে ১৯৮৬, ১৯৮৮, ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালে তিনি সংসদ সদস্য হন।
তিনি এরশাদের আমলে উপমন্ত্রীর পদপর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব এবং ১৯৯০ সালে আইন ও বিচার প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। ২০০১ সালে ফজলে রাব্বী মিয়া জাতীয় পার্টি থেকে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী না হতে পারলেও পরে নির্বাচনে তিনি মহাজোট প্রার্থী রওশন এরশাদকে পরাজিত করে সংসদ সদস্য হন। নবম জাতীয় সংসদে তিনি আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। ছিলেন ত্রয়োদশ সংবিধান সংশোধন কমিটির অন্যতম সদস্য, পরে তিনি এ কমিটর চেয়ারম্যানও হন। মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে আপসহীন এবং অসাম্প্রদায়িক মানুষ হিসেবে তিনি ভারতের আচার্য দীনেশ চন্দ্র সেন স্বর্ণপদকে ভূষিত হয়েছেন। ডেপুটি স্পিকার হওয়ার কারণে ব্যস্ততা বাড়লেও ফজলে রাব্বী মিয়া অন্তত ১৫ দিন পরপর এলাকায় আসেন। সাঘাটা ও ফুলছড়িতে প্রায় সব রাজনৈতিক কর্মসূচিতে তিনি অংশ নেন। এবার দ্বিতীয় দফা বন্যার সময় হজ পালনের উদ্দেশ্যে সৌদি আরবে যাওয়া পিছিয়ে দিয়ে তিনি টানা তিন দিন নৌকায় করে দুর্গম চরাঞ্চলে ত্রাণ বিতরণ করেন। ফুলছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান বলেন, স্থানীয় মানুষকে বুকে টেনে নিয়ে সুখ-দুঃখের কথা শোনার ও সমাধানের পথ করে দেওয়ার ব্যাপারটি ফজলে রাব্বী মিয়াকে ব্যাপক জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছে। চাঞ্চল্যকর শিশু সিনথিয়া ধর্ষণ ও হত্যার পর শিশুদের নিয়ে তিনি যে সমাবেশ করেছেন এবং হত্যাকারীদের বিচারের মাধ্যমে ফাঁসির দাবির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছেন সেটা মানুষকে স্পর্শ করেছে। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী তাঁর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গাইবান্ধার বালাসী থেকে সাঘাটার গোবিন্দি পর্যন্ত নদীভাঙন প্রতিরোধে ৩০০ কোটি টাকা অনুমোদন দিয়েছেন। গাইবান্ধা থেকে বগুড়ার সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে মেলান্দহ সেতু তাঁর উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের আরেক মাইলফলক। এ ছাড়া নির্মাণাধীন ত্রিমোহনী ঘাট সেতু উদ্বোধনের অপেক্ষায় রয়েছে। সম্প্রতি গাইবান্ধা থেকে সাঘাটা ও ফুলছড়ি সড়ক নির্মাণ ও সংস্কারে ৫৯ কোটি টাকার কাজ শুরু হয়েছে। ফজলে রাব্বী মিয়ার নিরলস প্রচেষ্টার কারণেই সাঘাটা ও ফুলছড়ির চারটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারীকরণের ঘোষণা এসেছে।
ফজলে রাব্বী মিয়া বলেন, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা বিধৌত এই জনপদের দুঃখী মানুষের ভালোবাসা তাঁর শক্তির উৎস। তবে উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর বিচক্ষণ ও দূরদর্শী নির্দেশনায় কাজ করার ফলেই এই ভালোবাসা অর্জিত হয়েছে। ভবিষ্যতে এই আসনে বঙ্গবন্ধুকন্যা তাঁকেই মনোনয়ন দেবেন বলে ফজলে রাব্বীর দৃঢ় বিশ্বাস। মানুষের সমর্থন নিয়ে এ আসনে বিজয়ী হওয়ার ব্যাপারে তিনি শতভাগ আশাবাদী।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের আরেক শক্তিশালী মনোনয়নপ্রার্থী ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মাহমুদ হাসান রিপন। ছাত্রলীগের পর সাঘাটা ও ফুলছড়ি উপজেলায় আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করার কাজেও তিনি সমান সফল। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার মুক্তির দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনে ঝুঁকি নিয়ে সাহসী ভূমিকা রেখে তিনি আলোচিত হন। শুধু তাঁর নির্বাচনী এলাকা নয়, জেলার সর্বস্তরের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কাছে রিপনের আন্তরিকতা ও বিনয়ী ভাবমূর্তি ব্যাপক প্রশংসিত।
ছাত্রলীগের তৃণমূল পর্যায় থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে মাহমুদ হাসান রিপনের উত্থান তাঁর সাংগঠনিক যোগ্যতায়। তিনি ২০০৬ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তিনি আওয়ামী লীগের উপকমিটির সহসম্পাদক হিসেবে কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে যুক্ত হন। বিভিন্ন সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে দুর্যোগ সংকটে সারা দেশে ঘুরে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন।
দীর্ঘদিন ধরে নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে মাহমুদ হাসান রিপন এলাকার উন্নয়নে কাজ করছেন বলে তাঁর সমর্থকরা জানায়। তারা জানায়, তরুণ এ নেতার কারণে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। তিনি মূলধারার নেতাকর্মীদের নিয়ে প্রায়ই সভা-সমাবেশ করে চলেছেন। বর্তমান সরকারের সফলতা এবং ভিশন-২০২১ বাস্তবায়নে আগামী নির্বাচনে নৌকায় ভোট দিয়ে শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করার জন্য ব্যাপক প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, মাহমুদ হাসান রিপনের মতো একজন সৎ ও যোগ্য, এলাকার উন্নয়ন করার মানসিকতাসম্পন্ন নেতার নেতৃত্ব এখানকার সর্বস্তরের মানুষের কাছে সমাদৃত হয়েছে। শুধু দলীয় নেতাকর্মীরাই নয়, অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের কাছেও রিপন একজন যোগ্য নেতা হিসেবে স্বীকৃত। তাঁরাও বিশ্বাস করেন, সাঘাটা-ফুলছড়ির রাজনীতিতে রিপন এক অপরিহার্য নাম। বিভিন্ন সময়ে দুই উপজেলায় রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ সংযোগ প্রদান ও সেতু নির্মাণে তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছেন। সাম্প্রতিক সময়ের বন্যাদুর্গত মানুষের মাঝে ত্রাণসামগ্রী বিতরণের পাশাপাশি দুর্যোগ মোকাবেলায় তিনি সাহস জুগিয়েছেন।
মাহমুদ হাসান রিপন বলেন, ‘ত্যাগী নেতাকর্মীদের যথাযোগ্য মূল্যায়ন করে সাঘাটা ও ফুলছড়ি উপজেলায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বশূন্যতা পূরণে সফল হয়েছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তরুণ নেতৃত্বকে আগামী দিনে সামনের কাতারে এগিয়ে নিয়ে আসার যে আহ্বান জানিয়েছেন তা সময়োপযোগী ও তাৎপর্যপূর্ণ। আমার সামগ্রিক কর্মকাণ্ড মূল্যায়ন করে মনোনয়ন দেওয়া হলে এই আসনটি দলকে উপহার দিতে পারব। ’
জাতীয় পার্টি : পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটলেও এখনো গাইবান্ধা-৫ আসনে জাতীয় পার্টির উল্লেখযোগ্য ভোট রয়েছে। একসময় এখানে বর্তমান সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদ নির্বাচন করে বিজয়ী হন। এবারও তিনি প্রার্থী হবেন—এ রকম প্রচার রয়েছে। তবে দলের চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এই আসনে সাঘাটা উপজেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি, দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির পরিবার পরিকল্পনা ও জনসংখ্যা বিষয়ক সম্পাদক এ এইচ এম গোলাম শহীদ রঞ্জুকে প্রার্থী ঘোষণা করেছেন। তিনি সাঘাটা উপজেলা পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান। পর পর দুইবার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা তাঁকে সামনে রেখে আসনটি পুনরুদ্ধার করার স্বপ্ন দেখছে।
গোলাম শহীদ রঞ্জু বলেন, দলীয় চেয়ারম্যানের নির্দেশনা অনুযায়ী তিনি জনসংযোগের মাধ্যমে জাতীয় পার্টির পক্ষে জনমত গঠন করেছেন। তিনি দাবি করেন, জাতীয় পার্টির শাসনামলেই ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলার মানুষের প্রাণের দাবি নদীভাঙন রোধে ব্যাপক কাজ হয়েছে। রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্টসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজও হয়েছে সমানতালে। এলাকার মানুষ সেই উন্নয়নের কথা আজও স্মরণ করে। কাজেই নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসে এই আসন আবারও জাতীয় পার্টির ঘরে যাবে বলে তাঁর বিশ্বাস।
বিএনপি : এ আসনে একসময় বিএনপির প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন জনপ্রিয় নেতা রোস্তম আলী মোল্লা। অসুস্থতার কারণে তিনি পরে আর নির্বাচন করেননি। দলের নেতৃত্ব সেভাবে বিকশিত না হওয়ায় এবং যোগ্য প্রার্থী না থাকায় সাঘাটা ও ফুলছড়ি উপজেলায় বড় রকমের ভোটব্যাংক থাকা সত্ত্বেও বরাবরই এখানে বিএনপি প্রার্থী পরাজিত হয়েছেন। এবারে তৃণমূল নেতাকর্মীদের পাশে থেকে কাজ করছেন সাঘাটা উপজেলা বিএনপির উপদেষ্টা রাহিদুল ইসলাম রাহী। তিনি আন্দোলন-সংগ্রামের কারণে মামলায় জড়িয়ে যাওয়া নেতাকর্মীদের মামলা পরিচালনায় সহযোগিতাসহ দলীয় বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে চলেছেন। রাহিদুল ইসলাম রাহী বিএনপির মনোনয়ন পেলে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে বলে দলীয় নেতাকর্মীরা মনে করে।
বিএনপির আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে আলোচনায় আছেন দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত নেতা মো. হাসান আলী ও গাইবান্ধা জেলা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি নাজেমুল ইসলাম নয়ন। হাসান আলী এর আগেও দলীয় প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেন। তবে অনেক নেতাকর্মী সাবেক সংসদ সদস্য রোস্তম আলী মোল্লার ছেলে জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মাহামুদুন্নবী টিটুলকে এ আসনে প্রার্থী হিসেবে দেখতে চায়।
এ ব্যাপারে জেলা বিএনপির সভাপতি ডা. মইনুল হাসান সাদিক বলেন, বড় দলে অনেকেই মনোনয়নপ্রত্যাশী হতে পারেন। তবে আগামী দিনে প্রার্থীর যোগ্যতা ও দলের জন্য ভূমিকা বিবেচনায় নিয়েই কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে প্রার্থী নির্বাচিত হবে।
জাসদ : গাইবান্ধা-৫ আসনে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) শক্তিশালী প্রার্থী হিসেবে প্রচারে রয়েছেন দলের কেন্দ্রীয় কমিটির উপদেষ্টা ডা. একরাম হোসেন। চিকিৎসক হিসেবে তিনি এলাকার মানুষের জন্য ব্যাপক সেবামূলক কাজ করেছেন। তাঁরও দলীয় ও নিজস্ব একটি ভোটব্যাংক রয়েছে। এলাকায় তাঁর নিয়মিত উপস্থিতির কারণে নেতাকর্মী ও সমর্থকরা এখন উজ্জীবিত।
ডা. একরাম হোসেন বলেন, দলীয়ভাবে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হলে তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন। তিনি বলেন, ‘সাঘাটা-ফুলছড়িতে জাসদের ব্যাপক গণভিত্তি রয়েছে। সাধারণ মানুষ পরিবর্তন ও নতুন নেতৃত্বকে স্বাগত জানাতে চায়। ’ সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন হলে তিনি বিজয়ের ব্যাপারে আশাবাদী।