সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে : নৃশংসতা দমনে ব্যর্থ

ইউএসএআইডির কর্মী জুলহাজ মান্নানসহ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও ব্লগার হত্যার ঘটনায় আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পড়েছে বাংলাদেশ সরকার। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার মতে নৃশংস হত্যাকাণ্ড দমনে বাংলাদেশ ব্যর্থ হয়েছে। ‘বিচারহীনতার সংস্কৃতি’ এ ধরনের সহিংসতা আরও বাড়াবে বলে আশংকা প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ। বিশ্ব সম্প্রদায় খুনের সঙ্গে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনার দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ডেনমার্ক, জাতিসংঘ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইট্স ওয়াচ ,সিপিজেসহ বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার পক্ষ থেকে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নিন্দা প্রকাশ অব্যাহত রয়েছে।
এ পরিস্থিতির উন্নয়নে বাংলাদেশে সন্ত্রাসের শেকড় চিহ্নিত করার আহ্বান জানিয়েছেন মার্কিন সিনেটর বেন কার্ডিন। জুলহাজ ও তার বন্ধু হত্যার পর ডেমোক্রেট দলের শীর্ষস্থানীয় সিনেটর বাংলাদেশ সরকারের প্রতি এ আহ্বান জানান। জুলহাজ মান্নান হত্যার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে হোয়াইট হাউস। মঙ্গলবার হোয়াইট হাউসের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, মার্কিন দূতাবাসের সাবেক কর্মী জুলহাজ মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং মানবাধিকার ও মর্যাদার পক্ষে কাজ করেছেন। আমরা তার হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানাই।
এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের বিচারে সরকারের কাছে জোরালো দাবি করা হয়েছে বিবৃতিতে। হত্যাকারীদের বিচারের আওতায় আনার দাবি করেছেন যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী হুগো সোয়্যার। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ডে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ডেনমার্ক। ঢাকায় ডেনমার্কের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স জ্যাকব হগার্ড মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশে সম্প্রতি বিভিন্ন ব্যক্তি ও ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর ওপর নৃশংস হামলার ঘটনায় আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। এসব পাশবিকতার তীব্র নিন্দা জানাই আমরা। দায়ীদের বিচারের আওতায় নিতে সরকারকে শক্ত অবস্থান নিতে আমরা আহ্বান জানাই। সেই সঙ্গে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা সুরক্ষায় জোরালো ব্যবস্থা নিতে আমরা বাংলাদেশ সরকারের কাছে জোর দাবি জানাই।
জাতিসংঘ বলেছে, বাংলাদেশে অসহিষ্ণুতার কারণে সহিংসতা বেড়েছে। ঢাকায় ড্যানিস আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, নৃশংস হত্যাকাণ্ড দমনে বাংলাদেশ ব্যর্থ হয়েছে। আন্তর্জাতিক অধিকার সংগঠনগুলো বলছে, ধারাবাহিক খুনের সর্বশেষ শিকার জুলহাজ ও তনয়। এর আগে উদারপন্থী বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক হত্যায় মনে হচ্ছে যে, হামলাকারীরা তাদের টার্গেট বিস্তৃত করছে। অধিকার সংগঠনগুলো হত্যার বিচার এবং সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা দেয়ার জন্যও সরকারের প্রতি আহ্বান জানায়। হিউম্যান রাইটস ওয়াচও জুলহাজ হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানিয়েছে। সংস্থাটি বলেছে, নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঠেকাতে বাংলাদেশ সরকার ব্যর্থ।
সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল মঙ্গলবার রাতে টেলিফোনে বলেন, সারা বিশ্বেই এ ধরনের সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটছে। যারা এসব কথা বলছেন তাদের দেশেই বেশি ঘটছে। আজও (মঙ্গলবার) লসঅ্যাঞ্জেলসে রাব্বি ও মিসেস রাব্বিকে বাসায় ঢুকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের এখানে এ ধরনের ঘটনা কম হচ্ছে। সে তুলনায় আমরা অনেক ভালো আছি। আমাদের ওপর তারা চাপ দেবেন কেন। এ ধরনের কিছু ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। তাদের বিচার চলছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক এএফএম রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে শনিবার সকালে তার বাসার কাছে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এর দু’দিনের মাথায় সোমবার বিকালে কলাবাগানের লেকসার্কাস এলাকায় পার্সেল দেয়ার কথা বলে বাসায় ঢুকে যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য সংস্থা ইউএসএআইডির কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু নাট্যকর্মী মাহবুব রাব্বী তনয়কে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ হত্যার ঘটনা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে নাড়া দিয়েছে। ধারাবাহিকভাবে দেশে ব্লগার খুনের পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র ঝুঁকিতে থাকা বাংলাদেশের ব্লগারদের আশ্রয় দেয়ার আশ্বাস দেয়। ওয়াশিংটনে পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র জন কিরবি বলছেন, সেই সুযোগ এখনও অব্যাহত আছে। জুলহাজ হত্যার প্রেক্ষাপটে এ ধরনের ঘটনাগুলোও যাতে সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করা হয়, হোমল্যান্ড দফতরকে সেই পরামর্শও দেয়া হবে।
হত্যার নিন্দা জানাল যুক্তরাজ্য ও জার্মানি : সমকামী ও হিজড়া অধিকারকর্মী জুলহাজ মান্নানসহ সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ডগুলোর নিন্দা জানিয়ে খুনিদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হুগো সয়্যার ও বাংলাদেশে জার্মানির রাষ্ট্রদূত থমাস প্রিনজ।
ব্রিটিশ প্রতিমন্ত্রী এক টুইট বার্তায় ও জার্মান রাষ্ট্রদূত এক বিবৃতিতে শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনাও জানিয়েছেন। হুগো সয়্যার লিখেছেন, ‘বাংলাদেশে অধ্যাপক করিম, তনয় ফাহিম ও জুলহাজ মান্নানের নির্বিচার হত্যাকাণ্ডে আমি গভীরভাবে শোকাহত। খুনিদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আনতে হবে।’
এক বিবৃতিতে জার্মান রাষ্ট্রদূত ‘অসাধারণ দুই মানবাধিকার কর্মীর ওপর নৃশংস হামলার তীব্র নিন্দা’ জানিয়ে বলেন, ‘এটা শুধু দু’জন সাহসী মানুষের ওপর নয়, এ দেশের মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর হামলা।’ দ্রুত ও ব্যাপক তদন্ত নিশ্চিত করতে সব ধরনের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানান প্রিনজ। ‘বিগত মাসগুলোতে এ ধরনের অনেক ঘটনা আমরা ঘটতে দেখেছি। মত প্রকাশের স্বাধীনতার মৌলিক অধিকার রক্ষায় ঘুরে দাঁড়াতে পুরো সমাজের জন্য এখনই সময়।’ নিহতদের পরিবার ও বন্ধুদের প্রতি সমবেদনা জানান জার্মান রাষ্ট্রদূত।
জাতিসংঘ বলছে, অসহিষ্ণুতায় সহিংসতা বেড়েছে : এ দেশে অসহিষ্ণুতা থেকে সহিংসতা দিন দিন বাড়ছে বলেও মন্তব্য করেছেন ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক রবার্ট ওয়াটকিন্স। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এএফএম রেজাউল করিম সিদ্দিকী এবং ইউএসএআইডির কর্মী জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু নাট্যকর্মী মাহবুব রাব্বী তনয় হত্যার পর জাতিসংঘের এ প্রতিক্রিয়া এলো।
মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে ওয়াটকিন্স ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, অধিকার কর্মীদের ওপর এ ধরনের হামলা বন্ধের কোনো লক্ষণ তারা দেখতে পাচ্ছেন না। জুলহাজ মান্নান এবং মাহবুব তনয় একই ধরনের সহিংস জঙ্গি হামলার সর্বশেষ শিকার বলে জাতিসংঘ মনে করছে। জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক বিবৃতিতে বলেন, ‘বাংলাদেশে অসহিষ্ণুতা থেকে সহিংসতা বেড়েই চলেছে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠদের সঙ্গে যাদের মতের অমিল রয়েছে তারাই এর শিকার হচ্ছে। দু’দিন আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকী হত্যাও এ ধরনের একটি ঘটনা ছিল।’
রবার্ট ওয়াটকিন্স বলেন, সব মানুষেরই সন্ত্রাস এবং বৈষম্যহীন পরিবেশে বাঁচার অধিকার রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে সংঘটিত নৃশংস ঘটনায় রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতাদের নিন্দা জানানো উচিত বলে জাতিসংঘ মনে করে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি এ ধরনের সহিংসতা আরও বাড়াবে বলে মন্তব্য করেন রবার্ট ওয়াটকিন্স।
হত্যার বিচার দাবিতে সোচ্চার বিশ্ব : নৃশংস হত্যাকাণ্ড দমনে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ ব্যর্থ হয়েছে বলে মন্তব্য করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। সোমবার নিজস্ব ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে সংস্থাটির দক্ষিণ এশিয়ার পরিচালক চাম্পা প্যাটেল এ মন্তব্য করেন। বিবৃতিতে বলা হয়, শুধু এ মাসেই ৪টি মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এটা খুবই দুঃখজনক যে এসব ঘটনার জন্য কাউকে দায়ী করা হচ্ছে না। আর হুমকির মুখে থাকা সুশীল সমাজের সদস্যদের নিরাপত্তা দেয়া হচ্ছে না।
জুলহাজ মান্নান হত্যার নিন্দা জানিয়েছেন বাংলাদেশে যুক্তরাজ্যের সাবেক হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন। তিনি জুলহাজকে তার বন্ধু আখ্যায়িত করে সোমবার সন্ধ্যায় এক টুইটার বার্তায় বলেন, ‘ভয়ংকর। আমি আমার বন্ধু ও মানবাধিকার কর্মী জুলহাজের হত্যার নিন্দা জানাই। হত্যাকারীদের অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।’
নিউইয়র্কভিত্তিক সাংবাদিকদের সংগঠন দ্য কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট (সিপিজে) এক বিবৃতিতে তাৎক্ষণিকভাবে জুলহাজ মান্নান হত্যার সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানায়। সিপিজের এশিয়া প্রকল্পের সমন্বয়কারী বব দিজ বলেন, বাংলাদেশের সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীরা হামলার শিকার হচ্ছেন এবং সরকার এ অপরাধ বন্ধ করতে অথবা ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জোরালভাবে কাজ করছে না।