গণজাগরণ মঞ্চের তিন বছর; জাতির চেতনাগত প্রাপ্তি

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় এদেশীয় ঘৃণ্য রাজাকারদের একজন জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লার রায়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল গণজাগরণ মঞ্চ। ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি কয়েকজন ব্লগার-অনলাইন এক্টিভিস্টদের আহ্বানে সারাদেশের লাখো সাধারণ জনতা জড়ো হয়েছিল শাহবাগের প্রজন্ম চত্ত্বরে। সবার দাবী ছিল একটাই-রাজাকারের ফাঁসি। দ্রুত সময়ের মধ্যে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশের জেলায় জেলায় এমনকি থানা পর্যায়েও। আন্দোলনের তীব্রতা এবং স্বতস্ফুর্ততায় দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিভিন্ন দেশের বাঙ্গালিরা যু্ক্ত হয় এই আন্দোলনে। বিদেশী নাগরিকরাও সমর্থন জানান এই আন্দোলনের প্রতি। অনেকে চলে আসেন শাহবাগেও। সৃষ্টি হয় নতুন ইতিহাস। অবাক বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আবারো ঘুরে যায় লাল-সবুজের বাংলায়।
জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে জনতা নেমে আসে রাজপথে। আন্দোলনে যোগ দেয় প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল, সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং সংস্কৃতিকর্মীরা। শাহবাগে এসে একাত্মতা জানান জাতীয় দলের ক্রিকেটাররা। জনতার দাবীর মুখে আইন পরিবর্তন করে রাষ্ট্রপক্ষের আপীল করার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়। আপীল বিভাগে কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় হয়। এবং কাদের মোল্লাকে দিয়েই স্বাধীন বাংলার মাটিতে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি কার্যকর শুরু হয়। এই প্রবল গণআন্দোলন নব্বইয়ের দশকের পর এই প্রথম। যার নেতৃত্বে যথারীতি ছিল তরুণরাই। তরুণদের অগ্রপথিক হিসেবে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের একটি বিশাল প্রতিকৃতি স্থাপন করা হয় শাহবাগে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে শহীদ জননীর ‘গণআদালত’ এর পর ২০১৩ সালে আবারো গড়ে উঠে গণজাগরণ মঞ্চ।
কিন্তু এত সহজ ছিল না গণজাগরন মঞ্চের এই অগ্রযাত্রা। সাধারণ মানুষের স্বত:স্ফুর্ত অংশগ্রহণে গড়ে উঠা এই আন্দোলনকে নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করতে সোচ্চার ছিল স্বাধীনতাবিরোধী মৌলবাদী শক্তি। মঞ্চের কর্মীদের নামে ‘নাস্তিক’ সহ নানান কুৎসা রটানো শুরু হয়। শুধু এতেই শেষ হয়নি; আন্দোলন চলাকালীন সময়ে নৃশংস কায়দায় কুপিয়ে খুন করা হয় প্রকৌশলী-ব্লগার রাজীব হায়দার শোভন কে। খুন করা হয় ব্যাংক কর্মাচারী জাফর মুন্সীকে। সেই খুনের ধারাবাহিকতায় পরবর্তী সময়ে ‘নাস্তিক’ উপাধি দিয়ে খুন করা হয় আরও বেশ কয়েকজন লেখক-ব্লগার এমনকি প্রকাশককে। রাজীব হায়দারকে খুনের পর থেকেই ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে পড়তে থাকে আন্দোলন। হেফাজত ইসলাম নামে একটি ধর্মীয় উগ্রবাদী দল হঠাৎ গজিয়ে উঠে। তারা শাহবাগ দখল করার ঘোষণা দেয়। মতিঝিলে মহাসমাবেশের ঘোষণা দিয়ে তান্ডব চালায় ঢাকা শহরে। এর আগেই তারা শাহবাগের আন্দোলনকারীদের ‘নাস্তিক’ আখ্যা দিয়ে তাদের বিচার দাবী করে। তারপর বেশ কিছু সংগঠন তথাকথিত ‘নাস্তিক’ ব্লগারদের তালিকা তৈরি করে। সরকার ধর্ম অবমাননার অভিযোগে বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতারও করে। পরবর্তী সময়ে খুন হওয়া অনেকের নামই সেই লিস্টগুলোতে ছিল। একসময়ের লোক লোকারণ্য শাহবাগে কমে আসে জনস্রোত। টানা সতের দিন চলা লাখো মানুষের সেই আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে উঠেপড়ে লাগে অনেক বুদ্ধিজীবীরাও। তবে কি সেইসব স্বাধীনতাবিরোধীরাই সফল? গণজাগরন মঞ্চের কি প্রয়োজন ছিল না?
এ প্রসঙ্গে মঞ্চের মুখপাত্র ড. ইমরান এইচ সরকার বলেন, এটা আদর্শবাদী একটা চেতনার আন্দোলন। যারা যুক্ত হন, তাঁরা কিন্তু ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তে অংশ নেন। এখানে বাসে করে কোনো লোক নিয়ে আসি না বা কোনো সংগঠন থেকে লোক ডেকে আনি না। গণজাগরণ সারা পৃথিবীতে একটি ইউনিক ধরনের আন্দোলন। যে আন্দোলনে টানা ১৭ দিন লাখ লাখ মানুষ রাজপথে থেকেছে। এমনকি ফরাসি বিপ্লবও মাত্র ১০ দিন স্থায়ী ছিল। সে দিক থেকে একটি শান্তিপূর্ণ, মানবিক ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন হলো গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন। এখন হয়তো এই আন্দোলনে লাখ লাখ মানুষ নেই, কিন্তু এই লাখ লাখ মানুষ কিন্তু এই আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে গেছে। শুরুর দিকে যে ছাত্র সংগঠনগুলো এখানে অংশ নিয়েছিল, পরে হয়তো সেই সংগঠনগুলো আর সেভাবে অংশ নেয়নি। সংগঠনগুলোর নিজস্ব একটা রাজনীতি আছে ও রাজনৈতিক এজেন্ডা আছে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে গণজাগরণ মঞ্চের কর্মসূচিরও কোনো মিল নেই।
গণজাগরন মঞ্চের আন্দোলনের পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে গতি পেয়েছে এটা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। তার মানে এই নয় যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে সরকারের দূর্বলতা ছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ়তার কথা জাতি শ্রদ্ধাভরেই স্মরণ রাখবে। এই গনআন্দোলনের ফলে আসল কাজটা হয়েছে যেটা তা হলো জনমত তৈরি। দেশের সিংহভাগ মানুষ এখনো সেই ঘৃণ্য নরপশুদের বিচার চায়। সেই দাবী সরকারের জন্য একটি শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। কাদের মোল্লার পর কামারুজ্জামান, সাকা এবং মুজাহিদের রায় কার্যকর করা হয়েছে। জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধের বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে এক ধরনের সম্ভাবনার কথা শোনা যাচ্ছে। তবু সরকারের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান না নেয়ার অভিযোগ করেন মঞ্চের সঙ্গে জড়িত নেতাকর্মীরা। তাদের মতে, সরকার আরও একটু কঠোর হলেই এই প্রগতিশীল –মুক্তমনা –বিজ্ঞানমনস্ক লেখকদের হারাতে হতো না। বরং অনেক সময় সরকারের প্রতিনিধিদের বিভিন্ন বক্তব্য মৌলবাদীদের উস্কে দিয়েছে বলে মনে করেন তারা।
অধিকাংশ মানুষই মনে করেন, গণজাগরন মঞ্চ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আবারও উস্কে দিয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য কারা বন্ধু আর কারা শত্রু সেটা চিহ্নিত করতে সাহায্য করেছে। স্কুল-কলেজে নানান অসাধারন কর্মসূচীর মাধ্যমে শিশু থেকে শুরু করে তরুণসমাজের মাঝে দেশপ্রেমের মশাল জ্বালিয়েছে। স্বাধীনতাবিরোধীরা জিততে পারেনি। তারা আবারো পরাজিত হয়েছে। পরাজিত হয়েই তারা একের পর এক গুপ্তহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে দেশের কিছু মেধাকে ধ্বংস করার জন্য।
গণজাগরন মঞ্চের কর্মীরা আরও বলেন, গণজাগরন মঞ্চের প্রধান দাবী হলো সকল যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা। কোন ধর্মের অবমাননা করা মঞ্চের কাজ নয়। ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার এই নীতিতে সবাই বিশ্বাসী। সকল ধর্মের প্রতি গণজাগরন মঞ্চের সকল নেতাকর্মীদের আন্তরিক শ্রদ্ধাবোধ আছে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলে মিলেই গড়ে উঠেছিল রাজাকারদের বিরুদ্ধে এই আন্দোলন। তাই মঞ্চের কর্মীদের ‘নাস্তিক’ বলা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মন্তব্য করেন তারা।
বর্তমানে জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ, যুদ্ধাপরাধীদের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ এবং পাকিস্তানের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার দাবীতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে গণজাগরণ মঞ্চ। যদিও ইতোমধ্যেই সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার কোন সম্ভাবনা নেই। পাকিস্তান বরবরই এই আন্দোলনের এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধীতা করে বিভিন্ন বিবৃতি এবং সভা-সমাবেশ চালিয়ে যাচ্ছে। এটাকে আভ্যন্তরীন হস্তক্ষেপ বলেই মনেই করেন বিশ্লেষকরা। স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরও সেই হানাদার পাকিস্তানীরা এজন্য ক্ষমা চায়নি, অনুতাপ প্রকাশ করেনি। যদিও ট্রাইব্যুনালে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের তালিকা তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। শাহবাগ আন্দোলন অহিংস এবং জাতীয় ইস্যুভিত্তিক অরাজনৈতিক আন্দোলন। স্বাভাবিকভাবেই এতবড় একটি স্বত:স্ফুর্ত আন্দোলন দিনের পর দিন চলতে পারে না। ফরাসি বিপ্লবও মাত্র ১০ দিন স্থায়ী হয়েছিল। কিন্তু গণজাগরন মঞ্চ চলেছে টানা সতের দিন। আন্দোলনকারীদের প্রত্যেকেই কোন না কোন পেশার সাথে জড়িত। এটাও আন্দোলনে মানুষ কমে যাওয়ার একটা অন্যতম প্রধান কারন হিসেবে দেখা হয়। এটাও সত্য যে এই মঞ্চের আন্দোলন যোগ দিতে এসে অনেক সাধারণ মানুষ তাদের চাকরি হারিয়েছেন কিংবা ছেড়ে দিয়েছেন। নিজের ব্যাক্তিগত ত্যাগটুকুই এই আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাঙ্গালি কখনো হারতে পারেনা । বাঙ্গালি হারতে শিখেনি। যখনই কোন অপশক্তি দেশের উপর আঘাত হানবে তখন একজোট হয়ে ঘুরে দাঁড়াবে বাঙ্গালি। গণজাগরণ মঞ্চ এই বিষয়টিই আবারও দেশের সীমানা ছাড়িয়ে সমস্ত বিশ্ববাসীকে স্মরণ করিয়ে দিল।