পদ্মার অনুরোধ বাস্তবায়নের পক্ষে নয় বাংলাদেশ ব্যাংক

রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচ ব্যাংকের যেকোনো একটির সঙ্গে একীভূতকরণের অনুরোধ জানিয়েছে বেসরকারি খাতের আলোচিত পদ্মা ব্যাংক লিমিটেড। তাদের এ আবেদন বিবেচনার আশ্বাসও দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। তবে এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মতামত হলো রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো নিজেরাই অনেক সমস্যার মধ্যে রয়েছে। অধিক মাত্রার খেলাপি ঋণ, মূলধন ঘাটতি ছাড়াও অন্যান্য আর্থিক সূচকেও খুব একটা সুবিধাজনক অবস্থানে নেই ব্যাংকগুলো। এ অবস্থায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার চেয়ে বিদেশ থেকে বিনিয়োগ আনার উদ্যোগ বাস্তবায়নই পদ্মা ব্যাংকের জন্য শ্রেয় হবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবকে দেয়া সাম্প্রতিক এক চিঠিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ মতামত উঠে আসে।
গত ৮ জুলাই রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী কিংবা বিডিবিএলের সঙ্গে পদ্মা ব্যাংককে একীভূত করার আবেদন জানিয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে একটি চিঠি দেন ব্যাংকটির এমডি মো. এহসান খসরু। ভবিষ্যৎ যেকোনো বিপর্যয়ের হাত থেকে সুরক্ষা দেয়ার জন্য এ একীভূতকরণ প্রয়োজন বলে তার চিঠিতে উঠে আসে। তিন বছর আগেও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো মূলধন জোগান দিয়ে পদ্মা ব্যাংককে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করেছিল।
আবেদনের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মতামত জানতে চেয়ে গত ২৫ আগস্ট চিঠি দেয় আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। সে অনুযায়ী ৫ অক্টোবর মতামত পাঠায় বাংলাদেশ ব্যাংক। একীভূতকরণের বিষয়ে অভিমত দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, ১৯৯১ সালের ব্যাংক কোম্পানি আইনে সরকারের অনুমোদন ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশের ভিত্তিতে একীভূতকরণ স্কিম প্রণয়নের কথা বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক দুর্দশাগ্রস্ত ব্যাংকটিকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে মরাটোরিয়াম আদেশের ভিত্তিতে অন্য কোনো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূতকরণ বা অবসায়নের ব্যবস্থা নিতে পারে। এছাড়া ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১ ও কোম্পানি আইন, ১৯৯৪-এর বিধি অনুযায়ী এ ধরনের একীভূতকরণে দুই পক্ষেরই আমানতকারী, পাওনাদার ও শেয়ারহোল্ডারদের সমানভাবে লাভবান বা উপকৃত হওয়ার সুযোগ থাকতে হবে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে হাইকোর্টে আবেদনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এ মর্মে সন্তুষ্টি বা প্রত্যয়ন নিতে হবে যে একীভূতকরণের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক দুটির পাওনাদার, শেয়ারহোল্ডার ও আমানতকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না। এজন্য ব্যাংক দুটির দায় ও সম্পদের মূল্য এবং প্রকৃত অবস্থা নিরূপণে বিশেষ নিরীক্ষা করতে হবে। তাছাড়া রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো অধিক মাত্রায় খেলাপি ঋণ ও মূলধন ঘাটতিসহ অন্যান্য আর্থিক সূচকে নিজেরাই ভালো অবস্থায় নেই। এছাড়া ব্যাংকগুলোয় পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যাও রয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, একীভূতকরণের আবেদনের আগে গত ১৫ জুন পদ্মা ব্যাংক যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক ডেল মরগান অ্যান্ড কোম্পানির সহায়তায় বিদেশী বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় মূলধন সংগ্রহের আবেদন করে। এ আবেদন পর্যালোচনা করে বিদেশী বিনিয়োগের মাধ্যমে মূলধন সংগ্রহের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক গত ২ আগস্ট নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে। ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক এরই মধ্যে ডেল মরগান অ্যান্ড কোম্পানির প্রতিনিধিদের সঙ্গে সভা করেছেন এবং বিদেশী বিনিয়োগ পাওয়ার বিষয়ে অগ্রগতি হয়েছে বলেও বাংলাদেশ ব্যাংককে জানিয়েছেন। এ অবস্থায় একীভূতকরণের পরিবর্তে বৈদেশিক বিনিয়োগ সংগ্রহের মাধ্যমে মূলধন ঘাটতি পূরণের পথে যাওয়াটাই পদ্মা ব্যাংকের জন্য শ্রেয় হবে বলে মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, পদ্মা ব্যাংক যেমন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের সঙ্গে একীভূতকরণের আবেদন করেছে, একই সঙ্গে তারা বিদেশী বিনিয়োগ বাড়িয়ে মূলধন বৃদ্ধির উদ্যোগও নিয়েছে। তাই বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করছে, এক্ষেত্রে সম্ভব হলে বিদেশী বিনিয়োগ বাড়ানোই ভালো হবে। এ মতামত অর্থ মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে। এখন সরকার যে সিদ্ধান্ত নেবে তা-ই হবে।
পদ্মা ব্যাংক একীভূতকণের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতামতকে যথার্থ মনে করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো নিজেরাই ভালো নেই। এ অবস্থায় কেন তারা একটি বেসরকারি ব্যাংকের দায় নেবে? পদ্মা ব্যাংক বেসরকারি খাতের ব্যাংক। এর দায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংককে দেয়া ঠিক হবে না। বরং তারা নিজেরাই ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টা করুক।
একীভূতকরণের আবেদন জানিয়ে দেয়া চিঠিতে একই সঙ্গে পদ্মা ব্যাংকের অগ্রাধিকারমূলক শেয়ার ও অতিরিক্ত সাবঅর্ডিনেট বন্ড ইস্যুর প্রস্তাবও দিয়েছিলেন এহসান খসরু। এতে বলা হয়, পদ্মা ব্যাংককে গোয়িং কনসার্ন হিসেবে পরিচালনা, ব্যাংকের মূলধন নিয়ন্ত্রক সংস্থার নির্ধারিত হারে সংরক্ষণ করা, আর্থিক লোকসান কমিয়ে আনা ও ন্যূনতম মূলধন পর্যাপ্ততা সাড়ে ১২ শতাংশে ধরে রাখার জন্য সরকারি অংশীদার ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, সরকারি করপোরেট গ্রাহকদের মেয়াদি আমানতের একটি অংশ অগ্রাধিকারভিত্তিক শেয়ারে সাবস্ক্রাইব করলে ব্যাংকটি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। ন্যূনতম মূলধন পর্যাপ্ততা সাড়ে ১২ শতাংশে ধরে রাখার জন্য ব্যাংকটির এখন ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা টিয়ার-১ মূলধন প্রয়োজন। এর মধ্যে ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা অগ্রাধিকারমূলক শেয়ার ইস্যুর কথা বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে পদ্মা ব্যাংকে রক্ষিত ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার সরকারি সংস্থার আমানত ও ৬০০ কোটি টাকা সরকারি ব্যাংকের আমানতের অর্থ অগ্রাধিকারমূলক শেয়ারে সাবস্ক্রাইব করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এর সঙ্গে ৬০০ কোটি টাকার অতিরিক্ত সাবঅর্ডিনেট বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে ব্যাংকটির মূলধন পর্যাপ্ততা ধরে রাখা সম্ভব হবে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক মতামত দিতে গিয়ে বলেছে, পদ্মা ব্যাংকে জমাকৃত ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকাকে রূপান্তর করে অগ্রাধিকার শেয়ার ইস্যুর প্রস্তাব ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১-এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তাই ব্যাংকের এ ধরনের আবেদন রক্ষার সুযোগ নেই।
বছর তিনেক আগে বিপর্যয়ের মুখে থাকা তত্কালীন ফারমার্স ব্যাংককে সুরক্ষা দিতে এগিয়ে এসেছিল অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক। রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইসিবি থেকে ওই সময় ৭১৫ কোটি টাকার পুঁজি ঢালা হয়েছিল। এক পর্যায়ে নাম পরিবর্তন করে ফারমার্স থেকে পদ্মা হয়েছে ব্যাংকটি। আইন ও রীতিনীতি পরিপালনে ব্যাপক ছাড়ও পেয়েছে। তার পরও ব্যাংকটি ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। বরং দিন দিন আর্থিক অবস্থার অবনতি হয়েছে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কাছে পদ্মা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পাঠানো আবেদনে ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতিসহ বিভিন্ন আর্থিক পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলা হয়, ঋণাত্মক সংরক্ষিত আয়ের (রিটেইনড আর্নিং) প্রভাবে ব্যাংকটির মোট মূলধনে শেয়ারহোল্ডারদের ইকুইটি ২০১৯ সালের ৪৮৭ কোটি থেকে ২০২০ সালে ৩৩২ কোটি এবং এ বছরের জুন শেষে ২২১ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে এ বছর শেষে ইকুইটির পরিমাণ ১০০ কোটি টাকার নিচে চলে আসার আশঙ্কা রয়েছে। এর সঙ্গে আবার সঞ্চিতি সংরক্ষণ করা হলে ব্যাংকটির ইকুইটি ঋণাত্মক অবস্থায় চলে যাওয়ার জোর সম্ভাবনা রয়েছে। ব্যাংকের বর্তমান প্রেক্ষাপটে ইকুইটি ধরে রাখার পাশাপাশি মূল ব্যাংকিং কার্যক্রম অনতিবিলম্বে শুরু করা প্রয়োজন।
২০২০ সালের নিরীক্ষিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্যাংকটির সুদযোগ্য সম্পদের পরিমাণ ৫ হাজার ৬২২ কোটি টাকা। আয়যোগ্য সম্পদের পরিমাণ ১ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। এ সময় ব্যাংকের পরিচালন লোকসান হয়েছে ১৬০ কোটি টাকা। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ছয় মাসে ব্যাংকটির পরিচালন লোকসান দাঁড়িয়েছে ১২০ কোটি টাকায়। এর মধ্যে নিট সুদের মার্জিন ৭১ কোটি টাকা।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ বণিক বার্তাকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের মতামত জানিয়েছে। তবে এখনো এ বিষয়ে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। তাই এখনই কোনো কথা বলার সুযোগ নেই।
এর আগে গত ২৯ সেপ্টেম্বর সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির এক বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছিলেন, সংশোধিত আইন অনুযায়ী ব্যাংকগুলোর একীভূত হওয়ার সুযোগ থাকছে। তবে আইনটি এখন ড্রাফট পর্যায়ে রয়েছে। সেটিকে আমরা সংসদে নিয়ে আসব এবং সেখানে অনুমোদনের পর একীভূতকরণ কার্যক্রম শুরু হবে।
ওই সময় অর্থমন্ত্রী বলেন, পদ্মা ব্যাংকের মালিকানা কাঠামোয় সব রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকই জড়িত। এর মধ্যে সোনালী, অগ্রণী, রূপালী ও জনতা ব্যাংকের শেয়ার রয়েছে। সেভাবেই ব্যাংকটি পরিচালিত হচ্ছে। পদ্মা ব্যাংকের বোর্ডে জনতা, সোনালী, রূপালী, অগ্রণী ব্যাংকও আছে। তাই অবশ্যই তাদের আবেদন বিবেচনা করতে পারি। তবে যে আইনের মাধ্যমে একীভূত হবে, সে আইনটি আগে হতে হবে।