বন্যার ব্যাপকতায় ইঁদুরতত্ত্ব

২০১৬ সালের এপ্রিলেও সুনামগঞ্জে হাওড়ের বাঁধ ভেঙে তলিয়েছিল প্রায় দুই লাখ টন বোরো ধান। এ ঘটনায় দায়ীদের খুঁজে বের করতে জোরেশোরে মাঠে নামে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। দীর্ঘ তদন্ত শেষে তারা নিশ্চিত হয়, ওই ঘটনার সব দায় ইঁদুরের। ৩৭টি হাওড়রক্ষা বাঁধের ২৭টিতেই গর্ত করে ইঁদুরের দল। সে বছর বৃষ্টিপাত বেশি হওয়ায় দুর্বল এসব বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয় হাওড়। মানুষের কোনো দোষ এতে খুঁজে পায়নি পাউবো। যদিও বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম-দুর্নীতিকেই এর কারণ বলে চিহ্নিত করে পরিকল্পনা কমিশন গঠিত পৃথক আরেকটি তদন্ত কমিটি।
এবারের বন্যার পেছনেও সেই ইঁদুর। তবে এর সঙ্গে বাড়তি যোগ হয়েছে উইপোকা। গাইবান্ধা পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান বিষয়টির ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে— বাঁধের বিভিন্ন জায়গায় গর্ত তৈরি করেছে ইঁদুর ও উইপোকা। এসব গর্ত দিয়ে পানি ঢুকে বাঁধের ক্ষতি হচ্ছে।
বাঁধ রক্ষার দায়িত্বে থাকা পাউবো সব দোষ ইঁদুরের ওপর চাপালেও তাদের এ তত্ত্বের সঙ্গে মিলছে না বিশেষজ্ঞ ও স্থানীয় মত। তারা বলছেন, বাঁধের ওপর ভারী যান চলাচল ও বাড়িঘর নির্মাণের কারণে এগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। এক্ষেত্রে নজরদারির ঘাটতি রয়েছে পাউবো কর্মকর্তাদের।
পানি বিশেষজ্ঞ পাউবোর সাবেক মহাপরিচালক প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, বাঁধের নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে একসময় খালাসি নিয়োগ দেয়া হতো। তাদের প্রধান কাজই ছিল বাঁধ ও বাঁধসংলগ্ন পরিবেশের খোঁজ রাখা। কোনো জায়গায় বাঁধ কেটে দেয়া হলে তা ভরাট করা, বৃষ্টিতে বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা মেরামত ও ইঁদুর বা শেয়ালের গর্ত থাকলে সেগুলো মাটি দিয়ে পূরণ করাই ছিল তাদের কাজ। তবে এক যুগেরও বেশি সময় আগে এসব পদ বিলুপ্ত করা হয়। বাঁধসংলগ্ন স্থানের মানুষ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করবে, এমন ধারণা এক্ষেত্রে কাজ করেছে।
ইঁদুর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শস্যক্ষেত-সংলগ্ন স্থানেই ইঁদুরের বাস। ফলে বাঁধেও ইঁদুরের গর্ত থাকতে পারে। আর বাঁধে ইঁদুরের গর্ত থাকলে সামান্য পানিতে সমস্যা না হলেও পানি বাড়তে থাকলে তার চাপে বাঁধ ভেঙেও যেতে পারে। নিয়মিত পরিদর্শন ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এটি ঘটছে। পাশাপাশি বাঁধ নির্মাণে অনিয়মের বিষয়টিও রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই নির্মাণকাজ অসম্পূর্ণ রেখেই বিল নিয়ে যাচ্ছেন ঠিকাদার।
পাউবোর তথ্য অনুযায়ী, সংস্থাটির অধীনে সারা দেশে বাঁধ রয়েছে প্রায় সাড়ে ১১ হাজার কিলোমিটার। এর বেশির ভাগই মাটির। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, এবারের বন্যায় মোট বাঁধের এক-তৃতীয়াংশই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ঘটনায় বাঁধ সংস্কার কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। গতকাল বৈঠক শেষে সংসদীয় কমিটির সভাপতি ও সাবেক পানিসম্পদমন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেন সাংবাদিকদের বলেন, আগে নভেম্বরের আগেই ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার বাঁধগুলো পরীক্ষা করা হতো। এমনকি রোলার দিয়ে বাঁধ শক্ত করেও দেয়া হতো, যাতে বন্যার পানি সহজে প্রবেশ করতে না পারে। কিন্তু এবার তা দেখিনি।
এবারের বন্যায় ঝুঁকিতে রয়েছে বগুড়ার বেশকিছু বাঁধ। এজন্যও ইঁদুরকেই দায়ী করছে পাউবো। বগুড়া পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী রুহুল আমিনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ এলাকায় বেশকিছু মানুষ দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছে। এ কারণে সেখানে খাবার পেয়ে যাচ্ছে ইঁদুর। ইঁদুর সেখান থেকে খাবার সংগ্রহ করে বাঁধে বাসা তৈরি করছে।
ইঁদুর খুব গভীরে বাসা তৈরি না করলেও যতটুকু গর্ত করছে, তা দিয়ে পানি প্রবেশ করে বাঁধকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে।
মঙ্গলবার সারিয়াকান্দির গোদাখালীতে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ওপর কিছুটা ধস দেখা দেয়। সেটি মেরামত করার সময় উইপোকার বাসাও পাওয়া যায়। উইপোকা সেখানে বাসা বেঁধে মাটি নরম করে ফেলেছে। সেই অংশ প্রবল বর্ষণ ও নদীতে পানি বৃদ্ধির চাপে কিছুটা দেবে গেছে।
পাউবোর এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন স্থানীয়রা। বাঁধপাড়ের বাসিন্দা সারিয়াকান্দির খাইরুল ইসলাম বলেন, পাউবোর নজরদারির অভাবেই বাঁধগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। তাদের নজরদারি বাড়িয়ে এগুলো টেকসই করা যেত। পাউবোর কর্মকর্তাদের নজরদারি কম থাকায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সারা বিশ্বেই মাটির বাঁধ রয়েছে। বাঁধের স্থায়িত্বের বিষয়টি অনেকখানি নির্ভর করে রক্ষণাবেক্ষণের ওপর। এছাড়া পরিকল্পনার বিষয়টি রয়েছে। ষাটের দশকে উপকূলীয় যে বাঁধ নির্মাণ হয়েছে, তা আজ পর্যন্ত পানির চাপে ভেঙে পড়েছে, এমন নজির নেই। ওই সময় দেশে যত বাঁধ তৈরি হয়েছে, তার সবই এখনো টিকে রয়েছে।
পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত এ প্রসঙ্গে বলেন, কিছু কিছু স্থানে বাঁধ দুর্বল হয়ে গেছে মূলত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে। পূর্ববর্তী বছরের বন্যার কারণে, বাঁধের ওপর থাকা গাছ উপড়ে এমনকি বর্ষার আগে বাঁধে আশ্রয় নেয়া ইঁদুরের কারণেও তা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তবে এসব কারণের কোনোটিই নতুন নয়। নতুন যেটা তা হলো বাঁধ রক্ষণাবেক্ষণে দায়িত্ব পালনের ব্যর্থতা।