English Version
আপডেট : ১২ জানুয়ারি, ২০১৭ ১২:৩৩

নবাব সলিমুল্লাহর ১০২তম মৃত্যুবার্ষিকী ১৬ জানুয়ারি

নিজস্ব প্রতিবেদক
নবাব সলিমুল্লাহর ১০২তম মৃত্যুবার্ষিকী ১৬ জানুয়ারি
নবাব সলিমুল্লাহর

নিউজ ডেস্ক: জগৎশেঠের নেতৃত্বে বর্ণবাদী ও মুসলিম বিদ্বেষী হিন্দু সমাজপতিদের সহযোগিতায় ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধে  বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজিত করে বাংলা দখল করে। এরপর অর্থনৈতিক শোষণ করে বাংলার সমৃদ্ধ মুসলমানদের একটি দরিদ্র জনগোষ্ঠীতে পরিণত করে। একশত বছর পর ১৮৫৭ সালে হিন্দুদের অনুরূপ সমর্থন ও সহযোগিতা নিয়ে ভারতের শেষ স্বাধীন মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফরকে পরাজিত করে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গোটা ভারত দখল করে। ১৮৫৯ সালে ইষ্ট ইন্ডিয়া

কোম্পানি থেকে শাসন ভার গ্রহণ করে ব্রিটেনের রাণী ভিক্টোরিয়া ভারতের উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন যা ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত বলবত ছিল। ঢাকার নবাব আব্দুল গণির পুত্র নবাব আহসানউল্লাহ ১৯০১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর ইন্তেকাল করার পর তদীয় জ্যেষ্ঠ পুত্র ৩০ বছর বয়সী সলিমুল্লাহ নবাব পদে অধিষ্ঠিত হন। বাস্তববাদী এই তরুণ নবাব যথার্থ ভাবে উপলব্ধি করেন যে, বাংলার পশ্চাৎপদ ও দরিদ্র মুসলমানদের শিক্ষা দীক্ষায় উন্নতি করতে না পারলে তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তি আসবে না। 

ঢাকার নবাব হিসাবে তার প্রথম পদক্ষেপ ছিল মহল্লায় মহল্লায় নৈশ বিদ্যালয় স্থাপন। এ থেকেই বোঝা যায় যে তিনি মুসলমানদের শিক্ষা বিস্তারে কতোটা মনোযোগী ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, সমাজে বিভিন্ন পেশার লোক বাস করে এবং প্রত্যেকের জীবনের লক্ষ্য ও কর্ম স্বতন্ত্র সুতরাং তাদের শিক্ষা ব্যবস্থাও ভিন্ন ভিন্ন হওয়া জরুরী।

এই জন্য শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে সমাজের লোকদের তিনি চার ভাগে বিভক্ত করেনঃ ১। অভিজাত বা জমিদার শ্রেণী,  ২। ব্যবসায়ী ও সরকারি চাকরিজীবী শ্রেণী,  ৩। কারিগর শ্রেণী  ৪। কৃষক শ্রেণী। 

তিনি এই চার শ্রেণীর পেশা ও দায়িত্বের নিরিখে ভিন্ন ভিন্ন শিক্ষা পদ্ধতি ও ভিন্ন ভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সব শ্রেণীর জন্য উপযোগী স্বতন্ত্র ধরণের বইপত্র রচনার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। 

নবাব সলিমুল্লাহ শিক্ষার্থীদের চরিত্র গঠনের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, ধর্মীয় শিক্ষা ব্যতিরেকে তাদের নৈতিকতার ভিত্তি রচিত হবে না। এই জন্য তিনি বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং প্রতিষ্ঠিত অন্যান্য মাদ্রাসাগুলোতে আর্থিক অনুদান দিয়েছেন।

আলীগড় কলেজের অনুকরণে বাংলার মুসলমান ছাত্রদের জন্য প্রথম বারের মতো ঢাকায় একটি মুসলিম হল নির্মাণের জন্য নবাব সলিমুল্লাহ ১,৮৬,৯০০ শত টাকা দান করেন। 

ঢাকা মাদ্রাসার ছাত্রাবাসের জন্য তিনি ১৯১২ সালে লক্ষাধিক টাকা দান করেন। মুসলমানদের উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের উপর স্যার সৈয়দ আহমেদ বেরেলভি গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তৎকালীন সময়ে পশ্চিম ভারতের শিক্ষিত ও সচ্ছল মুসলমানদের জন্য তা ছিল বাস্তবমুখী। কিন্তু বাংলার ৯৫ শতাংশ হত দরিদ্র ও অশিক্ষিত মুসলমানদের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করাটাই ছিল দুষ্কর। হিন্দু জমিদারদের প্রতিষ্ঠিত ও হিন্দু শিক্ষক কর্তৃক পরিচালিত স্কুলগুলিতে মুসলিম ছাত্রদের ভর্তি করানো হত না। এজন্য বাংলার মুসলমানদের শিক্ষা গ্রহণ করতে হত মাদ্রাসা থেকে। 

১৯৪৭ সাল পর্যন্ত পূর্ব বাংলার মুসলমানদের শিক্ষা ছিল মূলত মাদ্রাসা কেন্দ্রিক। নবাব সলিমুল্লাহ, শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক, মাওলানা আকরাম খাঁ, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাষানী, পণ্ডিত আবুল হাশিম, খাজা নাজিমুদ্দিন, শাহ্‌ আজিজুর রহমান প্রমুখ রাজনীতিবিদ ছিলেন মাদ্রাসার ছাত্র। মাওলানা ভাষানী ব্যতীত অন্যান্যগণ পরবর্তীতে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করে ক্ষমতায় গিয়ে জাতির সেবা করেছেন।

নবাব সলিমুল্লাহ প্রাথমিক ও গণশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা তীব্র ভাবে অনুভব করেন। এই জন্য প্রাথমিক শিক্ষার প্রতি ছিল তার প্রখর দৃষ্টি। কংগ্রেস নেতা গোপাল কৃষ্ণ গোখলে ১৯১১ সালে ইম্পেরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে ‘বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বিল’ পেশ করেন। ১৯১২ সালের ৩রা মার্চ কলিকাতায় অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের ৫ম অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে দূরদর্শী নবাব সলিমুল্লাহ বাহাদুর কংগ্রেস নেতা গোপাল কৃষ্ণ গোখলের উত্থাপিত বিলটির প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে তা কার্যকর করতে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।

একজন সমাজ বিজ্ঞানীর ন্যায় নবাব সলিমুল্লাহ বাংলার মুসলিম সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর হাল হকিকত সম্পর্কে ছিলেন সম্পূর্ণভাবে সচেতন এবং পুরোপুরি ওয়াকিবহাল। তার সামনে ছিল মুসলিম জাতির জ্বলন্ত সমস্যাবলী। ছিল শত বছরের বিরাজমান দারিদ্র, অজ্ঞতার ও অশিক্ষার মতো স্থায়ী সমস্যাবলী দূরীভূত করার গুরুতর চ্যালেঞ্জ। পতিত মুসলিম জনগোষ্ঠীকে টেনে উপরে তোলার লক্ষ্যে তিনি গণশিক্ষা প্রচলনে ব্রতী হন। নবাব বিশ্বাস করতেন যে, বিজাতীয় ও পৌত্তলিক সমাজের সঙ্গে পাশাপাশি বসবাস করা মুসলিমকে মুসলমান রূপেই উন্নতি করতে হবে। এই জন্য তিনি সাধারণ শিক্ষার সঙ্গে ধর্মীয় শিক্ষাকে অপরিহার্য মনে করে মাদ্রাসা শিক্ষার প্রসার ঘটিয়েছেন। নবাবের উদ্দেশ্যে ছিল, বাংলার মুসলমানদের শিক্ষাদীক্ষাসহ সর্ব ক্ষেত্রে হিন্দুদের সমকক্ষ করে গড়ে তোলা এবং তাদেরকে উন্নত ও সম্মানিত কওমে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা। এ লক্ষ্যে কামিয়াব হবার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে বাংলার মুসলমানদের শিক্ষান্নোতির জন্য নিজের পকেট থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করে বিভিন্ন শিক্ষা সমিতি গঠনসহ শিক্ষার ব্যাপারে অশিক্ষিত মুসলমানদের আগ্রহী করে তোলার জন্য গোটা বাংলায় সভা সমিতির আয়োজন করেন। বিভিন্ন স্কুল ও মাদ্রাসায় অকাতরে অর্থ অনুদান দিয়ে তিনি নিঃস্ব হয়েছেন। শিক্ষা খাতে দান অব্যাহত রাখতে হিন্দু মহাজনের কাছে নিজের জমিদারী বন্ধক রেখে অর্থ নিয়েছেন এবং অবশিষ্ট জমিদারী গচ্ছিত রেখে ব্রিটিশ সরকার থেকে ১৬ লাখ ২৫ হাজার টাকা কর্জ করেছেন যা তিনি মৃত্যু পর্যন্ত পরিশোধ করতে পারেননি।

মুসলিম জাতির উন্নতির জন্য অকাতরে অর্থ দান করে বংশানুক্রমে বিপুল বিত্ত বৈভবের মালিক একজন নবাবের নিঃস্ব ও ঋণগ্রস্ত হবার একমাত্র দৃষ্টান্ত নবাব সলিমুল্লাহ। তার এই দৃষ্টান্তই অনুসরণ করেছেন মুসলিম লীগের পরবর্তী নেতা কর্মী গন। এই জন্য তদানীন্তন পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষমতায় থাকা মুসলিম লীগের সাবেক মন্ত্রী, এম.এন.এ, বা  এম.পি.এ, তো দূরের কথা এ দলের সাধারণ কোন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় সম্পদ এবং জনগণের অর্থ আত্মসাৎ করার মতো দুর্নীতির একটি অভিযোগও উত্থাপিত হয়নি।

নবাব সলিমুল্লাহ’র পরামর্শ মতে সীমানা বর্ধিত করে ভাইসরয় কার্জন ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ করেন। ঢাকাকে রাজধানী করে তিনি ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ’ গঠন করেন। নতুন প্রদেশের বিরুদ্ধে পূর্ববঙ্গের কলিকাতা প্রবাসী প্রজা শোষক হিন্দু জমিদার গন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে নিজেদের জমিদারী রক্ষার স্বার্থে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন শুরু করেন। এই আন্দোলনকে সমর্থন করে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস। মুসলিম বিদ্বেষী বর্ণবাদী হিন্দুদের বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন মোকাবিলার জন্য নবাব সলিমুল্লাহ গঠন করেন ‘প্রভিন্সিয়াল মোহামেডান এসোসিয়েশন’ এবং ‘প্রভিন্সিয়াল মোহামেডান এডুকেশন কনফারেন্স’ নামের দুটি সংগঠন। বঙ্গভঙ্গের পক্ষে জনমত সৃষ্টি করাই ছিল এ দুটি সংগঠনের মূল লক্ষ্য। পরবর্তীতে বঙ্গভঙ্গের পক্ষে গোটা ভারতের মুসলমানদের সমর্থন পাওয়ার দূরদর্শিতা নিয়ে ঢাকায় আহবান করেন ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম এডুকেশন কনফারেন্স’ এর ২০তম অধিবেশন। ঢাকার শাহবাগে অনুষ্ঠিত দু-দিনের এই অধিবেশনের পর দিন  ১৯০৬ সালের ৩০ শে ডিসেম্বর নবাব সলিমুল্লাহ বাহাদুর ভারতীয় মুসলমানদের জন্য ‘নিখিল ভারত মুসলিম লীগ’ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠনের প্রস্তাব করলে ব্রিটিশ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত হাজার হাজার বিশিষ্ট প্রতিনিধিগণ তা সমর্থন করেন। নবাব সলিমুল্লাহ ভারতীয় মুসলমানদের সাংগঠনিক রাজনীতির প্রথম গুরু।

এই জন্য বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের কৃতজ্ঞ মুসলমানরা নবাব সলিমুল্লাহ’র নামটি আজো শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারণ করেন। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের মধ্যে সৃষ্ট হিন্দুদের ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাবকে প্রশমিত করে নিজেদের শাসন, শোষণ ও আধিপত্য বজায় রাখার স্বার্থে মুঘল বাদশাদের নির্মিত দিল্লির দরবার হলে ব্রিটিশ সম্রাট পঞ্চম জর্জ ১৯১১ সালে ১২ ডিসেম্বর বঙ্গভঙ্গ রহিত করেন। ফলে অখণ্ড বাংলার রাজধানী পুনরায় কলিকাতায় স্থানান্তরিত হয়। আর ঢাকা পরিণত হয় ১৯৪৭ সালের ১৩ই আগস্ট পর্যন্ত একটি জেলা শহরে। বাংলার মুসলমানদের উচ্চ শিক্ষার অভাবে এবং অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে উচ্চ শিক্ষিত হিন্দু ও বিত্তশালী হিন্দু জমিদারদের মোকাবিলা করে বঙ্গভঙ্গ রক্ষা করা যায়নি, এই বাস্তবতা উপলব্ধি করে নবাব সলিমুল্লাহ পূর্ব বাংলার মুসলমানদের উচ্চ শিক্ষার জন্য একটি বিশ্ব বিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয়তা তীব্র ভাবে অনুভব করেন। বঙ্গভঙ্গ রহিত করার কারণে সদ্য বিলুপ্ত পূর্ব বঙ্গ ও আসাম প্রদেশের মুসলমানদের অবিসংবাদিত নেতা নবাব সলিমুল্লাহ’র ক্ষোভ এবং অসন্তুষ্টি প্রশমিত করার উদ্দেশ্যে তার দেয়া প্রস্তাব মতে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে ব্রিটিশ সরকার সম্মত হয়। সেই সঙ্গে নবাবের দেয়া মাদ্রাসা শিক্ষা সংস্কারের দাবীও মেনে নেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য সমুদয় জমি দান করেন নবাব সলিমুল্লাহ।

নবাবের দান করা জমির উপরে বুয়েট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত। বাংলার পশ্চাৎপদ, শোষিত ও নিরক্ষর মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের প্রচেষ্টা, ভারতীয় মুসলমানদের জন্য রাজনৈতিক সংগঠন মুসলিম লীগ গঠন ও পূর্ব বাংলার মুসলমানদের উচ্চ শিক্ষার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা নবাব স্যার সলিমুল্লাহ বাহাদুরের (১৮৭১-১৯১৫) জীবনের অনন্য সাধারণ কীর্তি ও অবিস্মরণীয় অবদান। ১৬ই ডিসেম্বর এই সেচ্ছাসেবী মহান নবাবের ১২০তম মৃত্যু বার্ষিকীতে তার অসামান্য অবদান ও অমলিন ত্যাগকে স্মরণ করবে শ্রদ্ধাবনত চিত্তে।