ফারাক্কার সব গেট খুললে ভয়াবহ বন্যার আশঙ্কা

ভারতের বিহারসহ কয়েকটি রাজ্যকে বন্যার কবল থেকে বাঁচাতে ফারাক্কা ব্যারেজের সবগুলো গেট খুলে দেবার উদ্যোগ নিয়েছে ভারত। ফলে এক সঙ্গে কয়েক লক্ষ কিউসেক পানি ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে ফারাক্কার এপারে পদ্মা নদীতে। কিন্তু ফারাক্কার কারণেই পদ্মার তলদেশ ভরাট হয়ে যাবার ফলে এতো পানির ধারণ ক্ষমতা নেই এই নদীর। এর ফলে ব্যাপক বন্যার আশংকা দেখা দেবে বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলজুড়ে।
জানা গেছে, গত ৪০ বছরে বাংলাদেশে পদ্মার তলদেশ ১৮ মিটার ভরাট হয়ে গেছে। এক সময় যে পদ্মা ২৫ লাখ কিউসেক পানি ধারণ করতে পারতো এখন তা ৫০ ভাগে নেমে এসেছে। ইতোমধ্যে মওসুমী বন্যায় পদ্মা এখনই বিপদসীমার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। এখন ভারত ফারাক্কার গেটগুলো খুলে দিলে এক সঙ্গে পানির এতো চাপ সহ্য করতে পারবে না পদ্মা। ফারাক্কার কারণে পদ্মার বুকে শত শত চর পড়েছে। পদ্মার শাখাগুলোও ধারণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। ফলে রাজশাহী শহর রক্ষা বাঁধ ভেঙে পড়তে পারে, শহর তলিয়ে যেতে পারে- এমন আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।
বিবিসি এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সাম্প্রতিক বন্যায় বিহার, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ ও ঝাড়খ- রাজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এরমধ্যে একমাত্র বিহারেই দুর্গত লোকের সংখ্যা প্রায় দশ লক্ষ। আর এই অস্বাভাবিক বন্যার জন্য বিহারের প্রধান রাজনীতিক নীতিশকুমার ফারাক্কা বাঁধকে দায়ী করেছেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে ভারতের কেন্দ্রীয় পানি সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রণালয় অবিলম্বে ফারাক্কা বাঁধের সবগুলো গেট খুলে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে। এতে করে গঙ্গার বাড়তি পানি বাংলাদেশে প্রবেশ করবে এবং বিহার ও পশ্চিমবঙ্গে পানির চাপ কমে যাবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্ষাকালে এমনিতেই ফারাক্কা বাঁধের ১০৪টির মধ্যে ৭০টি গেট খুলে রাখা হয়, এখন সেই জায়গায় একশ’টি গেট খুলে দিয়ে অন্তত ১১ লাখ কিউসেক পানি বের করে দেয়া হবে। রিপোর্টে আরো জানা যায়, বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার গঙ্গা নদীর ওপর নির্মিত বিতর্কিত ফারাক্কা বাঁধকে পুরোপুরি সরিয়ে দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন। গত মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দেখা করে এ প্রস্তাব দেন তিনি। দুই নেতার বৈঠক সম্পর্কে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়, বিহারের বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন বিহারের তিনবারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার।
বৈঠকের আগে সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেন, ফারাক্কা বাঁধের কারণে গঙ্গায় বিপুল পরিমাণ পলি জমছে। আর এ কারণে প্রতিবছর বিহারে বন্যা হচ্ছে। তিনি বলেন, এর একটা স্থায়ী সমাধান হলো ফারাক্কা বাঁধটাই তুলে দেয়া। ভারতের ফারাক্কা বাঁধ নিয়ে বাংলাদেশের আপত্তি দীর্ঘদিনের। এই প্রথম ভারতের একজন প্রভাবশালী রাজনীতিক ও মুখ্যমন্ত্রী ফারাক্কা বাঁধ তুলে দেয়ার কথা বললেন।
রাজশাহীর নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, গত ৪০ বছরে বাংলাদেশে পদ্মার তলদেশ ১৮ মিটার ভরাট হয়েছে। এক সময় যে পদ্মা ২৫ লাখ কিউসেক পানি ধারণ করতে পারতো এখন তা ৫০ ভাগে নেমে এসেছে। ভারত ফারাক্কার গেটগুলো খুলে দিলে এক সঙ্গে পানির এতো চাপ সহ্য করতে পারবে না পদ্মা। ফলে চর ও পাড় উপচে পানি নগর-জনপদকে প্লাবিত করবে। রাজশাহী শহর রক্ষা বাঁধ ভেঙে যেতে পারে। নগরীর অধিকাংশ এলাকা কয়েক ফুট পানির নীচে তলিয়ে যেতে পারে। এর আগে বন্যায় ১৮৫৫ ও ১৮৬২ সালে রাজশাহী শহর ডুবে যাবার কথা জানান মাহবুব সিদ্দিকী।
পর্যবেক্ষদের মতে, পদ্মার বুকে এখন শত শত চর পড়েছে। ফলে নদীর মূল স্রোত বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। পানির ধারণ ক্ষমতা ব্যাপকভাবে কমে গেছে। অন্যদিকে পদ্মার পানিতে প্রবহমান থাকতো এমন শাখাগুলোও মরে হেজে-মজে গেছে। সেগুলোর ধারণ ক্ষমতা নেই বললেই চলে। বড়াল, গড়াই, মাথাভাঙা, মধুমতি, নবগঙ্গা, কাজলা, মাথাভাঙ্গা, আত্রাই, চিকনাই, হিনসা, কুমার, সাগরখালি, কপোতাক্ষ, চন্দনাসহ পদ্মার ৮৫টি শাখা-প্রশাখা নদীর বুকে জেগে উঠেছে ছোট-বড় অসংখ্য চর।
কোনো কোনো স্থানে বালু স্থায়ী মৃত্তিকায় রূপ নেয়ায় ফসল আবাদ করেছেন অনেকেই। বর্তমানে পদ্মা নদীর দীর্ঘ চর এলাকায় নানা রকম ফসলের আবাদ করছেন কৃষকরা। এই ভরাট হওয়া নদীগুলোর জন্য বর্তমান পরিস্থিতিতে ফারাক্কা থেকে হঠাৎ ছেড়ে দেয়া পানি ধারণ করতে না পেরে আকস্মিক ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি করতে পারে। যদিও ভারতীয়রা নিজেদের স্বার্থকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছেন।
ভারতের কর্মকর্তারা বলছেন, পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত ফারাক্কা বাঁধের গেটগুলো খুলে পানি ছেড়ে দিলে বিহার রাজ্যে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হবে। দেশটির কেন্দ্রীয় পানিসম্পদ মন্ত্রালয়ের মুখপাত্র সমীর সিনহা বিবিসিকে জানান, বর্ষাকালে এমনিতেই অন্য সময়ের তুলনায় ফারাক্কায় বেশি গেট খোলা থাকে। কিন্তু বিহার রাজ্যে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় ফারাক্কার ১০৪টি গেটের মধ্যে প্রায় ১০০টি গেট খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
কর্মকর্তারা বলছেন, এসব গেট খুলে দিলে ১১ লাখ কিউসেক পানি সরে যাবে। এতে করে বিহারের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হবে। বিহার রাজ্যে গত এক সপ্তাহে ১০ লাখের বেশি মানুষ বন্যা কবলিত হয়েছে। ফারাক্কায় গেটগুলো খুলে দেয়ার বিষয়ে বাংলাদেশকে আগেই নোটিশ দিয়ে জানানো হয়েছে এবং এনিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে পরামর্শ করা হয়েছে বলে সমীর সিনহা উল্লেখ করেন। বর্ষার মওসুমে এটিকে ‘স্বাভাবিক ঘটনা’ হিসেবে বর্ণনা করেন ভারতের কেন্দ্রীয় পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র।