English Version
আপডেট : ২ আগস্ট, ২০১৬ ১১:৫০

ভয়াল রূপ নিচ্ছে বন্যা, দেশে ৩৩ শতাংশ এলাকা ডুবে গেছে

অনলাইন ডেস্ক
ভয়াল রূপ নিচ্ছে বন্যা, দেশে ৩৩ শতাংশ এলাকা ডুবে গেছে

চীন, ভারত ও নেপাল থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে দেশে ৩৩ শতাংশ এলাকা ডুবে গেছে। এসব এলাকার ঘরবাড়ি, ফসলি জমি, শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় উত্তর ও উত্তর মধ্যাঞ্চলের ১৯ জেলায় বন্যা ভয়াল রূপ নিচ্ছে। আগামী ৪৮ ঘণ্টায় পদ্মা নদীসংলগ্ন রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ ও শরীয়তপুরে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার আভাস দিয়েছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র। এ ছাড়া ঢাকার চারপাশের নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে রাজধানীতেও বন্যার ঝুঁকি বাড়ছে।

এবারের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ২৫ লাখ মানুষ। এর মধ্যে রোগাক্রান্ত হয়েছেন ৩ হাজার ২২ জন, মারা গেছেন ৪৫ জন। বন্যার্তদের সহায়তায় ১৩ হাজার টন চাল, নগদ সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা ছাড় করেছে সরকার। এর বাইরে ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলোতে ৮ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার ও পর্যাপ্ত পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট পাঠানো হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য। 

বন্যাকবলিত এলাকায় খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। চাল, ডাল, আটা, সবজি, কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েছে। অনেক এলাকা বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়েছে। দেখা দিয়েছে সাপসহ বিষাক্ত প্রাণীর উপদ্রব। সেইসঙ্গে পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা পানির সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে গেছে। বিশুদ্ধ পানির সংকট বাড়ছে। সবকিছু মিলিয়ে হুমকির মুখে পড়েছে জনস্বাস্থ্য। বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হলে বিভিন্ন ধরনের পানিবাহিত রোগ ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।

ন্যাশনাল ডিজাস্টার রেসপন্স কো-অর্ডিনেশন সেন্টারের (এনডিআরসিসি) তথ্যমতে, দেশের ১৯টি জেলার ৫৯টি উপজেলার প্রায় ২৫ লাখ মানুষ বন্যাক্রান্ত হয়েছে। প্রায় ১০ হাজার ঘরবাড়ি পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত ও ১৫ হাজার আংশিক ক্ষতি হয়েছে। ১ হাজার ৩৪৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আংশিক এবং ৯৩টি সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২৮০ কিমি. পাকা রাস্তা এবং ২ হাজার ৫৩৮ কিমি. কাঁচা রাস্তা ক্ষতি হয়েছে। পাশাপাশি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২৫০টি। ১৫৮ আশ্রয় কেন্দ্রে হাজার হাজার মানুষকে আশ্রয় দেয়া হয়েছে। বন্যায় ১৭ জেলার ৯৪ হাজার ৫৩৬ হেক্টর আবাদি জমি পানির নিচে ডুবে গেছে বলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক (মনিটরিং) ড. মোহাম্মদ আবদু হু জানিয়েছেন। বন্যায় দেশের বিভিন্ন স্থানে নানা রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ৩ হাজার ছাড়িয়েছে। তাদের চিকিৎসায় ৩৪৬টি মেডিকেল টিম কাজ করছে। আক্রান্তদের মধ্যে মারা গেছেন ৪৪ জন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের ন্যাশনাল হেলথ ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্যমতে, এ পর্যন্ত দেশের উত্তরাঞ্চলের ১০টি জেলার ৫৬টি উপজেলার ২০৪টি ইউনিয়নে ৩ হাজার ২২ জন বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হন।

বন্যা সতর্কীকরণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের (এফএফডব্লিউসি) তথ্য অনুযায়ী ব্রহ্মপুত্র, পদ্মা, যমুনা, ধলেশ্বরী, ধরলা, আত্রাই, লক্ষ্যা, কালিগঙ্গা ও কংসসহ ১৩টি নদ-নদীর পানি গত তিন দিন ধরে বিপদসীমার ওপর দিয়ে বইছে। সোমবার পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্র নদের পানি কুড়িগ্রামের চিলমারী পয়েন্টে ৪২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছিল। যমুনার পানিও বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে ৮৫ সেন্টিমিটার ও বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে বিপদসীমার ৭৪ সেন্টিমিটার ওপরে বইছে। টাঙ্গাইলের সদর উপজেলার এলাসিনে ধলেশ্বরীর পানি ১৩৭ সেন্টিমিটার এবং গোয়ালন্দে পদ্মার পানি বিপদসীমার ১০০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ ছাড়া নাটোরের গুর নদীর পানি বিপদসীমার ওপরে অবস্থান করছে।

এফএফডব্লিউসির বৃষ্টিপাত ও নদ-নদীর অবস্থার সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্র, যমুনা এবং সুরমা-কুশিয়ারা নদ-নদীর পানি কমতে শুরু করেছে। গঙ্গার পানি স্থিতিশীল থাকলেও পদ্মার পানি বাড়ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের সহকারী প্রকৌশলী রিপন কর্মকার জানিয়েছেন, আগামী ৭২ ঘণ্টা পর যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র নদের পানি কমতে পারে। আগামী ৪৮ ঘণ্টা পদ্মা নদীর পানি সমতলে বৃদ্ধি পেতে পারে। এর ফলে রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ ও শরীয়তপুরের নিুাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে পারে। ঢাকার চারপাশে বুড়িগঙ্গা, বালু, শীতলক্ষ্যা প্রভৃতি নদ-নদীর পানি সমতলে বৃদ্দি পাবে এবং তা আগামী ২৪ ঘণ্টা অব্যাহত থাকতে পারে বলেও জানান এ প্রকৌশলী।

ওদিকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বলেছেন, সরকারের হাতে পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী রয়েছে। এগুলোর বিতরণে কোনো ধরনের অনিয়ম করা যাবে না। বানভাসি মানুষের কষ্ট লাঘবে সবার ঘরে ঘরে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দিতে হবে। সোমবার তিনি টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলায় যমুনা নদীর তীরে বানভাসি মানুষের মাঝে ত্রাণ বিতরণকালে এ কথা বলেন। মন্ত্রী বলেন, এই ত্রাণ বিতরণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরাসরি নিজেই তদারকি করছেন এবং তার নির্দেশেই আমরা প্রত্যেকটি জেলা ও উপজেলায় যাব। যতদিন পর্যন্ত পানি না নামবে এবং বন্যাদুর্গত মানুষগুলো ঘরে না ফিরতে পারে ততদিন এই ত্রাণ তৎপরতা চলবে।

জেলা প্রশাসক মাহবুব হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় বক্তব্য দেন স্থানীয় সংসদ সদস্য সানোয়ার হোসেন, মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. শাহ কামাল, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের মহাপরিচালক রিয়াজ আহমেদ, কালিহাতী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোজহারুল ইসলাম তালুকদার, উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবু নাসার উদ্দিন প্রমুখ। ত্রাণ বিতরণ শেষে মন্ত্রী টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসনের আয়োজনে বন্যা মোকাবেলায় স্থানীয় ক্যাবল চ্যানেলের মাধ্যমে জনসাধারণের করণীয় শীর্ষক প্রচারভিযানের উদ্বোধন করেন।

ব্যুরো, স্টাফ রিপোর্টার ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর- টাঙ্গাইল, নাগরপুর ও মধুপুর : যমুনা নদীর পানি অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় টাঙ্গাইলের বিভিন্ন স্থানে বন্যা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি হয়েছে। এতে কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ভূঞাপুর পয়েন্টে যমুনার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় ৫টি ইউনিয়নের শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। জেলার ৪টি উপজেলার ২শ’ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। 

ভূঞাপুরের বন্যাকবলিত এলাকা ঘুরে জানা যায়, উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের মধ্যে ৫টি ইউনিয়ন যমুনার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। এতে গাবসারা ইউনিয়নের ৪৭টি গ্রাম ও অর্জুনা ইউনিয়নের ২২টি গ্রাম সম্পূর্ণ প্লাবিত হয়েছে। গোবিন্দাসি ইউনিয়নের ৮টি গ্রাম, নিকরাইল ইউনিয়নের ১৫টি ও অলোয়া ইউনিয়নের ২০টি গ্রাম আংশিক প্লাবিত হয়েছে। রোববার সন্ধ্যায় নিকরাইল ইউনিয়নের কয়েড়া বকচড়া নামক স্থানে মাটিকাটা-নিকরাইল পাকা সড়কটি (বাঁধ) ভেঙে যাওয়ায় নিকরাইল ও অলোয়া ইউনিয়নে নতুন নতুন গ্রাম ও ফসলি জমি নিমজ্জিত হচ্ছে। ভূঞাপুর-তারাকান্দি সড়কের কুঠিবয়ড়া, তাড়াই, ভরুয়া ও গোলপেচা নামক স্থানে লিকেজ দেখা দেয়ায় এ সড়কটি হুমকির মুখে রয়েছে।  নাগরপুর উপজেলার চরাঞ্চল ভাড়রা মোকনা ও দপ্তিয়র ইউনিয়নের কমপক্ষে ৭ শতাধিক পরিবারের ঘর-বাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।  ধনবাড়ীর ঝিনাই ও বৈরান নদীতে স্বাভাবিক উচ্চতার চেয়ে বেশি উচ্চতায় পানি প্রবাহিত হয়ে মুশুদ্দি ইউনিয়নের কসাইবাড়ী বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ৯ জায়গায় ভেঙে গেছে। এতে প্রায় অর্ধশত গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।  ভাঙন ও বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছেন সাবেক খাদ্যমন্ত্রী ও অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ড. মো. আবদুর রাজ্জাক এমপি। 

জামালপুর, বকশীগঞ্জ ও দেওয়ানগঞ্জ : জেলার সাত উপজেলার ৬৮টি ইউনিয়নের মধ্যে ৫০টি ইউনিয়নের তিন লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বন্যার পানির স্রোতে দাঁতভাঙ্গা বেইলি ব্রিজের অ্যাপ্রোচ ভেঙে যাওয়ায় জামালপুর-মাদারগঞ্জ সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। টানা এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি থাকার পর তিন দিন ধরে পানি কিছুটা কমতে শুরু করেছে। ২৪ ঘণ্টায় যমুনা নদীর পানি ২১ সেন্টিমিটার কমে বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে বিপদসীমার ৮৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নতুন করে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বন্যার পানি ঢুকে পড়ায় জেলার ৭৮৭টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। শনিবার রাত থেকে বন্যার পানিতে রেল লাইন তলিয়ে যাওয়ায় জামালপুর-সরিষাবাড়ী-বঙ্গবন্ধু পূর্বপাড় পর্যন্ত লাইনে রেল যোগাযোগ এখনও বন্ধ রয়েছে। এদিকে, জামালপুর-দেওয়ানগঞ্জ রেল লাইন চালু করা হয়েছে। অন্যদিকে সরিষাবাড়ীর ভাটারা ইউনিয়নের ফুলবাড়িয়া এলাকায় বন্যার পানিতে সড়ক ভেঙে যাওয়ায় জামালপুর-সরিষাবাড়ী সড়ক যোগাযোগ এখনও বিচ্ছিন্ন। 

বকশীগঞ্জে সোমবার দুপুরে পানিতে ডুবে নিখোঁজ স্কুলছাত্র মিলনের লাশ উদ্ধার এলাকাবাসী। রোববার দুপুরে নিলাক্ষিয়ার পশ্চিমপাড়া গ্রামে কুদুস আলীর ছেলে মিলন হোসেন বাড়ির পাশে ঝুরায় গোসল করতে গিয়ে নিখোঁজ হয়। সোমবার দুপুরে পশ্চিমপাড়া ঝুরা থেকে আধা কিলোমিটার অদূরে পাটক্ষেত থেকে মিলনের লাশ উদ্ধার করা হয়। তিনি নিলাক্ষিয়া আরজে পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী। 

রৌমারী ও চিলমারী (কুড়িগ্রাম) : রৌমারীতে বন্যা কবলিত এলাকার ১৭৮টি প্রাথমিক ও ৩৮টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়সহ চরাঞ্চলে সবকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। বন্যার্তদের চিকিৎসাসেবা দেয়ার জন্য স্থানীয়ভাবে ৬টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। এতে রৌমারী-রাজীবপুরের ৯টি ইউনিয়নের ২৪০টি গ্রামের ২ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে দুর্ভোগে পড়েছেন। ব্রহ্মপুত্র নদে অব্যাহত পানি বৃদ্ধিতে চিলমারী-উলিপুর রেলপথের মাটিতে ধস দেখা দেয়ায় এ রুটে ২ দিন ধরে ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে।

শেরপুর : জেলার বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। চরাঞ্চলের ১৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আশপাশে পানি প্রবেশ করার কারণে ওই বিদ্যালয়গুলোতে ক্লাস বন্ধ রয়েছে। রোববার বিকেলে কুলুরচর বেপারিপাড়া গ্রামে মমিন নামে ৪ বছরের এক শিশু মারা গেছে। বন্যার পানিতে শতাধিক কাঁচা ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শেরপুর-জামালপুর আঞ্চলিক মহাসড়কের পোড়াদোকানের কাছে কজওয়ে দিয়ে প্রবল বেগে বন্যার পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এ সড়কে সড়ক ও জনপথ বিভাগ সাময়িকভাবে বাস-ট্রাকসহ ভারি যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে।

লালমনিরহাট : কেউ পানিবন্দি না থাকলে অব্যাহত ভাঙনের মুখে ভিটেমাটি হারিয়েছে সহস াধিক পরিবার। এদিকে বন্যার প্রভাবে জেলায় মোট ৪৩টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেলেও পানি নেমে যাওয়ার পর কিছু কিছু স্কুল খুলেছে। অন্যদিকে হাতীবান্ধার একটি নিু মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বিল্ডিং সম্পূর্ণ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। হাতীবান্ধার উত্তর ডাউবাড়ি এলাকায় নদী ভাঙনের মুখে পড়ে মোশারফ হোসেন নামের এক কৃষকের হৃদরোগে মৃত্যু হয়েছে।

শরীয়তপুর : উজান থেকে নেমে আসা ঢলের পানিতে প্লাবিত হয়েছে জেলার নিম্নাঞ্চল। এতে পদ্মা-মেঘনার পানি অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। জেলার সুরেশ্বর পয়েন্টে পদ্মার পানি বিপদসীমার ৫০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অপ্রতুল ত্রাণ সামগ্রী এসে পৌঁছেছে জেলা প্রশাসনের কাছে। শরীয়তপুর সদর, জাজিরা, নড়িয়া, ভেদরগঞ্জ ও গোসাইরহাট উপজেলার ২৫টি ইউনিয়নে প্লাবিত হয়ে লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ঘরে ঘরে পানি প্রবেশ করায় মানুষ এক ঘর থেকে আরেক ঘরে যেতে বাঁশের সাঁকো ব্যবহার করছে। জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত পদ্মা, মেঘনা, কীর্তিনাশা ও আড়িয়াল খাঁ নদের পানি অব্যাহত গতিতে বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রতিদিন নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। ১৭ বিদ্যালয়ে পাঠ দান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। 

মুন্সীগঞ্জ : জেলার বন্যা পরিস্থিতির ক্রমান্বয়ে অবনতি হচ্ছে। প্লাবিত হচ্ছে নিম্নাঞ্চলসহ নতুন নতুন এলাকা। এরই মধ্যে পদ্মা নদীর তীরবর্তী নিুাঞ্চলের শ্রীনগর, লৌহজং ও টঙ্গিবাড়ী উপজেলার ৩৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়ে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে কয়েক হাজার মানুষ। পদ্মার নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে পদ্মার ভাগ্যকুল পয়েন্টে বিপদসীমার ৩৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।  মাদারীপুর : মাদারীপুরের শিবচরে ২ সেন্টিমিটার পানি বেড়ে পদ্মা নদীর পানি বিপদসীমার ৮০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে নদ-নদীগুলো ভয়ংকর রূপ নিয়েছে। এদিন পানি বৃদ্ধির ফলে পদ্মার চরাঞ্চল ছাড়াও আড়িয়াল খাঁ তীরবর্তী এলাকায় দুর্ভোগ ভোগান্তি ছড়িয়ে পড়েছে। আড়িয়াল খাঁ নদের প্রবল পানির তোড়ে উপজেলার শিরুয়াইল ইউনিয়নের পূর্ব কাকৈরে বাজার রক্ষা বাঁধে প্রায় ১শ’ মিটার বাঁধ নদীতে বিলীন হয়ে বহেরাতলা বাজার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা হুমকিতে রয়েছে।  ফরিদপুর : চরভদ্রাসন উপজেলার গাজীরটেক ইউনিয়নের নতুন ডাঙ্গী বেড়িবাঁধ সড়কের প্রায় ১০০ মিটার ধসে গেছে। বাঁধ ধসে পানি ঢুকে পড়ায় রোববার রাতে কমপক্ষে ২০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এ সময় স্রোতের কোপে ৪টি বসতভিটা বিলীন হয়ে গেছে। এলাকাবাসীর জোর চেষ্টায় ক্ষতিগ্রস্ত বসতঘরগুলো ভেঙে এনে পাশের বেড়িবাঁধ সড়কে আশ্রয় নিয়েছে।

সিরাজগঞ্জ, শাহজাদপুর ও উল্লাপাড়া : যমুনা নদীর পানি গত দু’দিনে সামান্য কমলেও শাখা নদী ফুলজোর, করতোয়া, বড়াল, ইছামতি ও দইভাঙা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় সিরাজগঞ্জের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে। প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। যমুনার পানি কমতে থাকলেও শাখা নদী ফুলজোরে ৭২ সেমি., বড়ালে ৮২ সেমি., করতোয়ায় ৬৯ সেমি., দইভাঙা ৮৩ সেমি. ও ইছামতি নদীর পানি ৬২ সেমি. বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলে পানি উন্নয়ন বোর্ড (বিআরই) সূত্র নিশ্চিত করেছে। বন্যার্তদের জন্য ১৩৯টি কেন্দ্রে আশ্রয় কেন্দ খোলা হয়েছে।  শাহজাদপুর আদালত ভবন বন্যার পানিতে ডুবে যাওয়ায় বিচারকার্য চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে।

উল্লাপাড়া : উল্লাপাড়ায় বন্যায় প্রায় দেড় শতাধিক প্রাথমিক বিদ্যালয় পানিতে ডুবে যাওয়ায় ৩ আগস্ট অনুষ্ঠিতব্য দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। 

পাবনা : পদ্মা, যমুনা, বড়াল, হুরাসাগর নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় পাবনার ভাঙ্গুড়া, চাটমোহর, ফরিদপুর, সাঁথিয়া, সুজানগর ও বেড়া উপজেলায় বন্যা দেখা দিয়েছে। এসব এলাকায় অন্তত ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ৬ উপজেলায় ১৪৫ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বন্যায় প্রায় পাঁচ হাজার বসতবাড়ি পানিতে ডুবে গেছে। এখনও দুর্গত অঞ্চলে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছেনি।  বড়াল নদীসহ চলনবিলের পানি অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায় ভাঙ্গুড়া উপজেলার প্রায় ১০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ৪০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে।

বগুড়া ব্যুরো : সারিয়াকান্দি উপজেলায় যমুনা নদীতে পানি কমতে শুরু করায় বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত ২২ হাজার পরিবারের মধ্যে সোমবার বিকাল পর্যন্ত মাত্র এক হাজার ২০০ পরিবারের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করা সম্ভব হয়েছে। সোমবার বাঙালি নদীতে পানি বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হলেও যমুনার পানি ৬৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। সারিয়াকান্দি উপজেলার চালুয়াবাড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদুল কুদ্দুস সরকার ও অন্যরা জানান, গত কয়েকদিনে উজান থেকে নেমে আসা ঢল এবং বৃষ্টির পানিতে যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি পায়। এতে উপজেলার ৯ ইউনিয়নের ৯০ গ্রামের লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েন। 

গাইবান্ধা : ব্রহ্মপুত্র ও ঘাঘট নদীর পানি বিপদসীমার অনেক ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। ফলে বানভাসি মানুষের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। সোমবার সকাল ৬টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত ৯ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্রের পানি ৬ সেমি. হ্রাস পেয়ে বিপদসীমার ৩৯ সেমি. ওপর দিয়ে এবং ঘাঘট নদীর পানি ৫ সেমি. হ্রাস পেয়ে বিপদসীমার ৩৮ সেমি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।  সদর উপজেলার বোয়ালি ইউনিয়নের পিয়ারাপুর গ্রামে সোমবার দুপুরে বন্যার পানিতে ডুবে ফাতেমা বেগম (৪) নামে এক শিশু মারা গেছে। সে ওই গ্রামের সাজু মিয়ার মেয়ে।  গোয়ালন্দ (রাজবাড়ী) : রাজবাড়ী জেলায় বন্যাকবলিত হয়ে ১০ সহস্রাধিক পরিবারে সীমাহীন দুর্দশা বিরাজ করছে। সোমবার সকাল ৬টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় পদ্মা নদীর পানি গোয়ালন্দ পয়েন্টে ১ সেমি. হ্রাস পেয়ে বিপদসীমার ১০০ সেমি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।

ত্রাণ নিয়ে ছিনিমিনি বরদাশত করা হবে না- মায়া : মানিকগঞ্জ ও সাটুরিয়া প্রতিনিধি জানান, গরিবের রিলিফ নিয়ে কেউ যদি কোনো ছিনিমিনি খেলে তা বরদাশত করা হবে না। এছাড়া বন্যার সময় ত্রাণ কার্যক্রম নিয়ে সরকারি কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধি কোনো গাফিলতি করেন কিংবা এই দুরবস্থায় দুর্গতদের পাশে না থাকেন তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া সোমবার দুপুরে মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার বন্যাকবলিত জাফরগঞ্জ এলাকায় দুস্থ মানুষের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করতে এসে এসব কথা বলেন। এ সময় মন্ত্রীর সঙ্গে স্থানীয় সংসদ সদস্য নাঈমুর রহমান দুর্জয়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব শাহ কামাল, অতিরিক্ত সচিব সাজ্জাদ কবীর প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। 

এদিকে, মানিকগঞ্জের অভ্যন্তরীণ নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে যমুনা নদীর পানি আরিচা পয়েন্টে ২৪ ঘণ্টায় ৩ সেন্টিমিটার কমে বিপদসীমার ৫৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যার পানিতে ঘিওর উপজেলার বড়টিয়া গ্রামে লাল চাঁন নামের দুই বছরের একটি শিশু মারা যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। জেলায় প্রায় এক লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।