English Version
আপডেট : ১ জুলাই, ২০১৬ ১৬:০২

কলিজা কেটে দিলেও জামাল ভাইয়ের ঋণ শোধ হবে না

অনলাইন ডেস্ক
কলিজা কেটে দিলেও জামাল ভাইয়ের ঋণ শোধ হবে না

বৃহস্পতিবার (৩০ জুন) সকাল থেকেই দিল্লির ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে অপেক্ষমাণ ছিলেন প্রায় অর্ধ যুগ আগে বাংলাদেশে পাচার হয়ে আসা কিশোর সনুর বাবা মেহবুব ও মা মমতাজ ওরফে মাধুরী। তাদের সঙ্গে সে দেশের সরকারী কর্মকর্তা এবং সাংবাদিকরাও ছিলেন অধীর আগ্রহে।

বাংলাদেশ সময় দুপুর একটার দিকে সনুকে বহকারী বিমানটি দিল্লি বিমানবন্দরে অবতরণের পরই এক আবেগঘন পরিস্থিতির তৈরি হয়। ৬ বছর আগে যে নাড়িছেঁড়া ধন হারিয়ে ফেলেছিলেন তাকে কাছে পেয়ে আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন মেহবুব-মমতাজ দম্পতি। অর্ধ যুগ পর মায়ের কোল ফিরে পায় ১২ বছর বয়সী শিশু সনু। বিমানবন্দর থেকে সনুকে নিয়ে সে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের সঙ্গে দেখা করেন মেহবুব-মমতাজ দম্পতি।

হারিয়ে যাওয়া সন্তানকে ফিরে পাওয়ার অনুভূতি কী-জানতে চাইলে সনুর মা মমতাজ ওরফে মাধুরী বৃহস্পতিবার বিকেলে বলেন, ‘সবই সম্ভব হয়েছে আপনাদের (বাংলাদেশ) জামাল ভাইয়ের কারণে। কলিজা কেটে দিলেও জামাল ভাইয়ের ঋণ শোধ করতে পারব না। আল্লাহ বলেন, আর ভগবান বলেন, উনি আমার কাছে সব। ওনাকে আমি গাড়ি বেঁচে এক লাখ টাকা হাতে দিয়েছিলাম, কিন্তু উনি নেননি।’

সনুকে নিয়ে পরিকল্পনা কী-জানতে চাইলে তার মা মমতাজ বলেন, ‘ওকে আমি ভাল করে লেখাপড়া শিখাবো। আমি আমাদের মন্ত্রীর কাছে (পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ) বলেছি যে, ৬টা বছর ওর (সনু) পুরো বরবাদ হয়ে গেছে। আমি আমার ছেলেকে ভাল স্কুলে পড়াব। আমার বাচ্চার ভবিষ্যতটা গড়ে দিবেন।’

তিনি বলেন, ‘পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আমাদের দেখা সাক্ষাত হয়েছে। তিনি আমার বাচ্চার গলা জড়িয়ে ধরে আদর করেছেন। সনুকে বলেছেন তুমি তোমার মায়ের সঙ্গে থাক, মায়ের হাতে ভাল মন্দ খাও। দুদিন পর তোমরা আমার সঙ্গে দেখা করো।’ প্রধানমন্ত্রীর (নরেন্দ্র মোদি) সঙ্গেও আমাদের তিনি দেখা করিয়ে দেবেন বলে তিনি জানিয়েছেন।

সনুর মা বলেন, ‘জামাল ভাইয়ের জন্য আপনাদের(বাংলাদেশ) সরকার যেন সহায় হন। আমরা আপনাদের সরকারকে অনুরোধ করছি বিনা কারণে তিনি যেন জেল না খাটেন। ওনার মামলাগুলো যেন প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।’

মমতাজ ওরফে মাধুরী বলেন, ‘সন্তানকে ফিরে পাওয়ার অনভূতি কী মুখে বলে শেষ করা যায়? আমরা সবাই খুশি। কিছুক্ষণ পরপর এখানকার (দিল্লি) টিভিগুলো সনুর সাক্ষাৎকার নিচ্ছে। আমি এখনো বাসায় পৌঁছিনি। এইতো এখনো কয়েকটা টিভি ওর সাক্ষাৎকার নিচ্ছে।’

সনুর সঙ্গে কথা বলতে চাইলে কিছুক্ষণ পর তিনি সেখানকার সাংবাদিকদের কাছ থেকে ডেকে আনেন। বলেন, বাংলাদেশ থেকে ফোন করেছে, আগে ওনাদের সঙ্গে কথা বলো। মাকে ফিরে পাওয়ার অনুভূতি জানতে চাইলে সনু শুধু জানায়, ‘আমি ভাল আছি, ভাল লাগছে।’

২০১০ সালের ভারতের দিল্লি থেকে বাংলাদেশের বরগুনার বেতাগী উপজেলায় পাচার হয়ে আসে শিশু সনু। বেতাগীর গেরামর্দন গ্রামে রহিমা এবং আকলিমা নামের দুই বোন কাজের সূত্রে দিল্লি থাকার সময় সনুকে বাংলাদেশে এনে তাদের বড় বোন হাসি বেগমের জিম্মায় দেন বলে অভিযোগ।

হাসি বেগমের প্রতিবেশী জামাল ইবনে মূসা শিশু সনুর বিষয়ে সন্দেহ হলে খোঁজ নিয়ে পাচারের কথা জানতে পারেন। এরপর বরগুনার নারী ও শিশু আদালতে মামলা করলে ২০১৫ সালের ২২ ডিসেম্বর আদালত সনুকে যশোরের কিশোর সংশোধনী কেন্দ্রে রাখার নির্দেশ দেন।

এরপর জামাল সনুকে তার প্রকৃত বাবা-মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য নিজ উদ্যোগে দিল্লিতে যান চলতি বছরের মে মাসে। প্রায় ১৫ দিনের প্রচেষ্টায় সনুর বাবা মেহবুব এবং মামমতাজকে খুঁজে পান জামাল। সনু এবং তার মায়ের ডিএনএ (ডি অক্সিরাইবো নিউক্লিক এসিড) পরীক্ষায় তা তাদের মা ছেলের পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর গত ২৮ জুন আদালত সনুকে ভারতীয় হাইকমিশনের জিম্মায় দেন। বৃহস্পতিবার (৩০জুন) দুপুরে মায়ের কোল ফিরে পায় ১২বছর বয়সী শিশু সনু। দিল্লির ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অপেক্ষারত মেহবুব-মমতাজ দম্পতি তাদের প্রথম সন্তানের দেখা পেলেন ছয় বছর পর। বিমানবন্দর থেকে সনুকে নিয়ে সেদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের সঙ্গে দেখা করেন মেহবুব-মমতাজ দম্পতি। অর্ধযুগ আগে হারিয়ে যাওয়া তাদের সন্তানকে ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে মহামিলনের দূতের ভূমিকা পালন করেন বাংলাদেশের বরগুনা জেলার জামাল ইবনে মূসা।

দিল্লীতে বাবা-মায়ের কোলে কিশোর সনুর ফিরে যাওয়ার অনুভূতি জানতে চাইলে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেন জামাল ইবনে মূসা। তিনি বলেন, ‘যতটা সম্ভব আমি ওর জন্য করেছি। এ জন্য আমি কত হয়রানির শিকার হয়েছি, জেলে খেটেছি। আমার নামে, আমার পুরো ফ্যামিলি, আত্মীয়-স্বজনদের নামে মামলা দেওয়া হয়েছে। যারা আমার পক্ষে সাক্ষী দিয়েছেন তাদের নামে মামলা দেওয়া হয়েছে। ৫টি মামলার মধ্যে ১টিতে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। সে যাই হোক, এগুলোকে আমি পরোয়া করি না। আমি তাকে (সনু) তার মায়ের কোলে ফিরিয়ে দিতে পেরেছি, এটাই স্বার্থকতা আমার।’

যশোর শিশু কিশোর সংশোধন কেন্দ্রের সাইকো-সোশ্যাল কাউন্সিলর মো.মুশফিকুর রহমান দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘সনুকে নিয়ে আমার মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। সে আমাদের এখানে ৬ মাসের মতো ছিল। সবসময় সে আমাদের সঙ্গে থেকেছে। সে চলে যাওয়ায় কষ্ট লাগছে। তার বন্ধুরাও আমাকে বার বার জিজ্ঞেস করছে সনু তার বাবা-মার কাছে পৌঁছেছে কি না, সে কেমন আছে। তাদেরও কষ্ট লাগছে। আর আনন্দ লাগছে এ জন্য যে, সনু পাচার হয়ে আসার সাড়ে ৫ বছরে বাবা-মাকে ছাড়া ১০টি ঈদ করেছে। এবার ঠিক ঈদের আগে বাবা-মার কাছে গেছে। বাবা-মার সঙ্গেই সে ঈদ করবে।’ খবর- দ্যরিপোর্ট২৪.কম