ব্যাক গিয়ারে পা ফেলেনি বলেই বাবুল বিপদে

'পুুলিশের চাকরিতে শুধু ভালো কাজ করলে চলে না, পাশাপাশি পরিবেশ-পরিস্থিতি বুঝে পা ফেলতে হয়। বাবুল কখনও ব্যাক গিয়ারে পা ফেলেনি। এটাই তার জন্য বিপদ ডেকে এনেছে। তাই এত কথা হচ্ছে। এখন সে বন্ধুহীন, এখন সে বিপদে আছে। হয়তো সময় পেরোলে অনেক কথা বলা যাবে, অনেক সত্য বেরিয়ে আসবে। খারাপ কথা শুনতে আমাদেরও ভালো লাগছে না।'
২০০৯ সালে পুলিশ বাহিনী থেকে অবসরে যাওয়ার পর মোশাররফ হোসেন এ বাড়িতেই বাস করছেন। কন্যা মিতু খুন হওয়ার পর থেকে প্রায় প্রতিদিনই তার বাড়ির সামনে জড়ো হচ্ছে অনেক কৌতূহলী উৎসুক ব্যক্তি। বাড়ির সামনে সশস্ত্র পুলিশ সদস্যরা পাহারা দিতে শুরু করার পর তাদের কৌতূহলে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়। এখন সশস্ত্র অবস্থায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সদস্যরা দায়িত্ব পালন না করলেও সাদা পোশাকে পুলিশ সদস্য অবস্থান করছেন। মিতু হত্যা সংঘটিত হওয়ার পর বাবুল দুই শিশুসন্তানকে নিয়ে শ্বশুরের বাসাতেই থাকছেন। গত শুক্রবার গভীর রাতে এ বাসা থেকেই বাবুলকে নিয়ে গিয়ে টানা ১৫ ঘণ্টা মিন্টো রোডের গোয়েন্দা কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে ডিবির একটি দল। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে গত শনিবার বিকেলে বাবুলকে বাসায় পৌঁছে দেওয়া হয়। তার পর থেকে দোতলার একটি কক্ষে অবস্থান করছেন বাবুল আক্তার। বাসার বাইরেও বের হননি তিনি। এড়িয়ে চলছেন গণমাধ্যমকে। কার্যত 'গৃহবন্দি' তিনি। সময় যত পেরোচ্ছে, ঘটনাপ্রবাহে ততই যুক্ত হচ্ছে নতুন দৃশ্যপট। হত্যা রহস্যে বাবুলকে ঘিরেই তৈরি হচ্ছে নানা আলোচনা। পুলিশের ভেতরেও রয়েছে বিভিন্ন মত। তার আত্মীয়স্বজনকেও স্পর্শ করছে এসব আলোচনার আঁচ। পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, 'শুধু বাইরে নয়, বাসায় গিয়েও পরিবারের সদস্যদের কাছে মিতু হত্যাকাণ্ড নিয়ে তাদের নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। তারাও চান, প্রকৃত সত্য আলোর মুখ দেখুক। এতে বাহিনী উপকৃত হবে। আর যত দ্রুত সব তথ্য সামনে আসবে, ততই গুঞ্জন ও গুজবের ডালপালা কাটা পড়বে। উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে কথা হচ্ছিল মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে। বাবুল চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়েছেন কি-না বা এ নিয়ে মেয়ের জামাইয়ের সঙ্গে তার কথা হয়েছে কি-না। তিনি বলেন, 'এমন প্রশ্ন আমাদের অনেকেই করছে। শ্বশুর হিসেবে বাবুলের কাছে এ ব্যাপারে জানতেও চেয়েছি। উত্তরে সে শুধু বলেছে, যারা এই কথা বলছেন, পুলিশ কর্তৃপক্ষের কাছে থেকে তারাই জানুক, আসল সত্য কী। স্ত্রীকে হারিয়েছি, এরপর আবার চাকরি থেকে ইস্তফা দেওয়ার প্রশ্নও আসছে?' 'বাবুল আক্তার কেন গণমাধ্যমকে এড়িয়ে চলছেন, এটা কি কোনো চাপে, নাকি মানসিকভাবে স্থির না হওয়ায়?' এ প্রশ্নের জবাবে বাবুলের শ্বশুর মোশাররফ হোসেন বলেন, 'জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বাসায় আসার ঠিক আগে বাবুল ফোন করে আমাদের জানায়, সে রিলিজড। তবে এসব বিষয়ে কারও সঙ্গে কথা বলার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ রয়েছে। মিতু হত্যার পর বাবুলকে পুলিশ সদর দপ্তর আবার চট্টগ্রামে যাওয়ার প্রস্তাবও দেয়। কিন্তু মানসিক অবস্থা ভালো না থাকায় সে রাজি হয়নি। আর এখন তো সব পরিস্থিতিই যেন বদলে যাচ্ছে। মিতুর কবরস্থানেও পুলিশ পাহারা ছিল। কয়েক দিন আগে তা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।' বাসার সামনে থেকে হঠাৎ করে সশস্ত্র পুলিশ সদস্যদের প্রত্যাহার করে নেওয়া সম্পর্কে মোশাররফ হোসেন বলেন, 'বাসায় কোনো মেহমান এলে স্বাভাবিকভাবে যাওয়ার সময় বাসার লোকজনকে বলে যায়। ঘটনার পর আমাদের বাসার সামনে পুলিশের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু সোমবার দুপুরের পর থেকে তারা কাউকে কিছু না বলেই চলে গেছে।
তবে শুনেছি, বাসার সামনের সড়কে সাদা পোশাকে পুলিশ নজর রাখছে। আজ (মঙ্গলবার) ভোরে হঠাৎ দেখি, বাসার সামনে সাদা পোশাকে দু'জন লোক চলাফেরা করছে। প্রশ্ন করায় জানাল, দু'জনই পুলিশের লোক। এত লুকোচুরির কী আছে?' পুলিশ প্রত্যাহারের ব্যাপারে জানতে চাইলে খিলগাঁও থানার ওসি কাজী মাইনুল কাছে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। মোশাররফ হোসেনের কাছে জানতে চাওয়া হয়, বাবুল আক্তারের সরকারি গাড়ি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে কি-না। উত্তরে তিনি বলেন, 'সত্যি কথা বলতে গেলে, বাবুল এখন পুলিশ সদর দপ্তরের সঙ্গে যুক্ত। বাবুল ঢাকায় আসার পর থেকে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন থেকে একটি ভাড়া করা গাড়ি বাবুলকে দেওয়া হতো। ওই গাড়ির চালক প্রায় প্রতিদিনই ফোন করে কখন আসবে জানতে চাইত। কয়েক দিন ধরে গাড়ির চালক কোনো খোঁজখবর নিচ্ছে না। বাবুলও অবশ্য বাইরে যাচ্ছে না।' 'সময় যত এগোচ্ছে, ততই গুঞ্জন বাড়ছে এ ব্যাপারে আপনার কোনো বক্তব্য রয়েছে?' এ প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে মোশাররফ হোসেন বলেন, 'তদন্তের ওপর এখনও আমাদের আস্থা রয়েছে। যদি দেখি সত্য উদ্ঘাটন হচ্ছে, তখন এ নিয়ে কথা বলব। বাবুল সাহসী কর্মকর্তা। প্রফেশনাল জেলাসিও থাকতে পারে। ৬০ জনের বেশি কর্মকর্তা একসঙ্গে এসপি হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছে। যদিও পদায়ন হয়েছিল শুধু বাবুলের।' বাবুলের দুই শিশুর দিনরাত্রি কেমন কাটছে জানতে চাইলে তার শ্বশুর বলেন, 'মাহির মানসিক অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। ওর সামনে মিতুকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আর চার বছরের তাবাসসুম তাপুও বুঝতে পারছে, মা আর কোনোদিন আসবে না। সোমবার বাসা গোছগাছ করার সময় তাপু এর কারণ জানতে চায়। বাসার একজন বলে, তাপু আজ তো তোমার জন্মদিন। উত্তরে তাপু বলে, আম্মু নেই। আর কোনোদিন আমার জন্মদিন হবে না। হঠাৎ গভীর রাতে উঠে বাসায় হেঁটে হেঁটে মাকে খুঁজে বেড়ায় সে। ওদের মানসিক চিকিৎসা করতে চিকিৎসকের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়া হয়েছে। যদিও আতঙ্কে ঘরের বাইরেও এখন যাওয়া যায় না।' খবর- সমকাল