English Version
আপডেট : ১৪ এপ্রিল, ২০১৬ ০৯:০১

আজ পহেলা বৈশাখ স্বাগত : ১৪২৩ বঙ্গাব্দ

অনলাইন ডেস্ক
আজ পহেলা বৈশাখ স্বাগত : ১৪২৩ বঙ্গাব্দ

আজ যা নতুন, সময়ের ছুটে চলায় তা পেছনে পড়ে। পুরনো হয়। সেই অমোঘ নিয়মে পুরনো হলো আরও একটি বছর। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ভাষায়- ‘বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক/যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে যাওয়া গীতি/অশ্রুবাষ্প সুদূরে মেলাক...।’ আজ অভূতপূর্ব সাংস্কৃতিক জাগরণের দিন, আজ পহেলা বৈশাখ। এল প্রত্যাশার আলোয় রাঙানো নতুন বাংলা বছর।

১৪২৩ বঙ্গাব্দের আজ প্রথম দিন। আজকের প্রার্থণা- ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জ্বরা/অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা...।’ পুরনো দিনের শোক-তাপ-বেদনা-অপ্রাপ্তি-আক্ষেপ ভুলে অপার সম্ভাবনার দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ঘোষণার এইতো সময়। দুই হাতে অন্ধকার ঠেলে, সকল ভয়কে জয় করার মানসে নতুন করে জেগে উঠবে বাঙালী। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে দেশের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের আজ একটাই সুর এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ...। 

আনন্দে উৎসবে আজ মাতোয়ারা গোটা দেশ। জাতীয় কবি নজরুলের ভাষায় তোরা সব জয়ধ্বনি কর/তোরা সব জয়ধ্বনি কর/ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবোশেখির ঝড়/তোরা সব জয়ধ্বনি কর...। আজ দ্রোহের আগুনে শাণিত হবে। বাঙালীর চেতনাবিরোধী অপশক্তি রুখতে নতুন বছরে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে যাওয়ার শপথ নেবে বাংলাদেশ। 

বাংলা নববর্ষ ও বৈশাখের ইতিহাসে চোখ ফেরালে দেখা যায়, বাংলা নববর্ষের সঙ্গে সবচেয়ে নিবিড় সম্পর্ক কৃষির। এ সম্পর্কের সূত্রেই বাংলা সাল প্রবর্তন করেন সম্রাট আকবর। তার আমলেই প্রবর্তন হয় বাংলা সাল। এখন তা বঙ্গাব্দ নামে পরিচিত। 

আবহমানকাল ধরেই চলছে বৈশাখ বরণের আনুষ্ঠানিকতা। প্রকৃত রূপটি দৃশ্যমান হয় গ্রামে। এক সময় গ্রামবাংলায় চৈত্র সংক্রান্তি ছিল প্রধান উৎসব। বছরের শেষ দিনে তেতো খাবার খেয়ে শরীর শুদ্ধ করতেন কৃষাণ-কৃষাণিরা। নির্মল চিত্তে প্রস্তুত হতেন নতুন বছরে প্রবেশ করার জন্য। এখনও বৈশাখ বরণের অংশ হিসেবে বাড়িঘর ধুয়েমুছে পরিষ্কার করেন গৃহিণীরা। অদ্ভুত মুন্সীয়ানায় আল্পনা আঁকেন মাটির মেঝেতে। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠবেন সবাই। স্নান সারেন। নতুন পোশাক পরেন। আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীর বাড়িতে বেড়াতে যান। ঘরে ঘরে সাধ্যমতো বিশেষ খাবার রান্না করা হয়। থাকে পিঠাপুলির আয়োজন। আজ হাটে-মাঠে-ঘাটে বসবে ঐতিহ্যবাহী বৈশাখী মেলা। নানারকম কুটিরশিল্প, খেলনা, মিষ্টিসহ বাহারি পণ্যে স্টল সাজানো হবে। বিভিন্ন এলাকায় থাকবে নৌকাবাইচ, লাঠিখেলা কিংবা কুস্তির মতো ঐতিহ্যবাহী আয়োজন। পাহাড়ি জনপদে তো গত দুদিন ধরেই এই উৎসব চলছে।

নববর্ষ উপলক্ষে আজ সরকারি ছুটির দিন। রাষ্ট্রপতি মো: আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলের নেতা রওশন এরশাদ দিনটি উপলক্ষে পৃথক পৃথক বাণী দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত আগ্রহে এবারই প্রথম চালু হয়েছে বৈশাখী ভাতা, যা এবারের উৎসবে যোগ হয়েছে নতুন মাত্রা।

জাতীয় সংবাদপত্রগুলো বাংলা নববর্ষের বিশেষ দিক তুলে ধরে ক্রোড়পত্র বের করেছে। সরকারি ও বেসরকারি টিভি চ্যানেলে নববর্ষকে ঘিরে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানমালা প্রচার করা হচ্ছে।

বাংলা ১৪২২ সালকে বিদায় এবং নববর্ষ ১৪২৩ বরণকে কেন্দ্র করে তিন পার্বত্য জেলার আদিবাসী সম্প্রদায় প্রতিবছরের ন্যায় এবারও বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের আয়োজনের মধ্য দিয়ে ব্যাপক অনুষ্ঠানমালা পালন করছে।

বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনে সকল কারাগার, হাসপাতাল ও শিশু পরিবারে (এতিমখানা) উন্নতমানের ঐতিহ্যবাহী বাঙালি খাবার পরিবেশন করা হবে। শিশু পরিবারের শিশুদের নিয়ে ও কারাবন্দিদের পরিবেশনায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে এবং কয়েদিদের তৈরি বিভিন্ন দ্রব্যাদি প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হবে। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন এবং প্রততত্ত্ব অধিদপ্তরের ব্যবস্থাপনায় জাদুঘর ও প্রতœস্থানসমূহ সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। শিশু-কিশোর, প্রতিবন্ধী ও ছাত্র-ছাত্রীরা বিনা টিকেটে এদিন জাদুঘর পরিদর্শন করতে পারবে।

আজ বদলে যাবে রাজধানী ঢাকার দৃশ্যপট। শোভাযাত্রা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও মেলায় বর্ণবহুল হয়ে উঠবে নগরী। বরাবরের মতই ভোর সোয়া ছ’টায় রমনার বটমূলে ছায়ানটের প্রভাতী অনুষ্ঠানে ভোরের সূর তুলে শুরু হবে বর্ষবরণের আনুষ্ঠানিকতা। এর সঙ্গে সঙ্গেই রমনার বটমূল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, ধানমন্ডির লেকের পাড়, সংসদ ভবনসহ শেরেবাংলা নগর, গুলশান, বনানী, উত্তরা, মিরপুর, যাত্রাবাড়ি, অর্থাৎ এক কথায় পুরো রাজধানীই বৈশাখী আমেজে মেতে উঠবে। কাকডাকা ভোর থেকেই নগরীর পথে ঢল নেমেছে বাঙালি সংস্কৃতি লালনকারী আনন্দপিয়াসী নগরবাসীর। সবার পরনেই থাকবে বৈশাখী রং লাল-সাদার পাশাপাশি অন্যান্য রঙের বাহারি নকশার পোশাক।

নগরীর অভিজাত রেস্টুরেন্টগুলো এবং রমনা ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের আশেপাশে ভ্রাম্যমাণ রেস্টুরেন্টে কাল থাকবে ইলিশ পান্তার আয়োজন। বাসাবাড়িতে তৈরি হবে বাঙালি খাবারÑ ইলিশ মাছভাজা, শুটকি বেগুন ডাল আলুসহ নানা পদের ভর্তা। কেবল বাংলাদেশের অভ্যন্তরেই নয়, পৃথিবীর যেখানেই বাঙালি ও বাংলা ভাষাভাষী মানুষ রয়েছে, সেখানেই বর্ণাঢ্য উৎসবের পালিত হবে পয়লা বৈশাখ।

বাঙালীর এই প্রাণের উৎসবকে ঘিরে রমনা পার্কসহ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার পুরোটাই ঢেকে দেয়া হয়েছে নিরাপত্তা চাদরে। শুধু রাজধানী ঢাকাই নয় এ উপলক্ষে সারাদেশই নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশ ও র‌্যাবের পাশাপাশি গোয়েন্দা সংস্থা ও তাদের আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে যৌথভাবে কাজ করছে সব সংস্থা। বিভিন্ন সামাজিক এবং রাজনৈতিক সংগঠনের পক্ষ থেকেও নিরাপত্তা নিয়ে নেয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ।

সার্বিক নিরাপত্তা ও নজরদারি নিশ্চিত করতে বসানো হয়েছে কন্ট্রোল রুম, অবজারভেশন পোষ্ট ও চেকপোষ্ট। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের পাশাপাশি থাকছে গোয়েন্দা দলের সদস্য, বোমা ডিসপোজাল টিম ও মেডিক্যাল টিম।

মূল অনুষ্ঠানমালা : দিনের প্রথম প্রভাতেই রমনার বটমূলের ঐতিহ্যবাহী সংগঠন ছায়ানট ভোরের সুর্যের আলো দেখার সঙ্গে সঙ্গেই ভোর সোয়া ছ’টায় শুরু করবে বর্ষবরণের আনুষ্ঠানিকতা। চারুকলার শিক্ষার্থীরা সকালে বের করবে মঙ্গল শোভাযাত্রা। এ বছর ‘মা ও শিশু’কে চেতনায় ধারণ করে ‘অন্তর মম বিকশিত কর অন্তর তর হে’ এই প্রতিপাদ্যকে সামনের রেখে শোভাযাত্রাটি চারুকলা থেকে বের হয়ে রূপসী বাংলা হোটেল চত্বরে ঘুরে আবার চারুকলার সামনে এসে শেষ হবে।

ঢাকা বিশ্ব^বিদ্যালয় এর কর্মসূচির মধ্য রয়েছে, নববর্ষ বরণ উপলক্ষে চারুকলা অনুষদের মঙ্গল শোভাযাত্রা। ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক সভাযাত্রায় নেতৃত্ব দিবেন। চারুকলা ইনস্টিটিউটে দিনব্যাপী চলবে পুতুল নাচ ও নাগরদোলা। বাংলা বিভাগ ও বাংলা অ্যালামনাইয়ের উদ্যোগে কলাভবন প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হবে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান।

সংগীত বিভাগ সকাল ৮টায় বিশ্ববিদ্যালয় বটতলায় সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করেছে । থিয়েটার এন্ড পারফরমেন্স স্টাডিজ বিভাগের উদ্যোগে নাট-মন্ডল প্রাঙ্গণে বিভাগের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হবে পট-গান ও দেশের গান। মল চত্বর এলাকায় অনুষ্ঠিত হবে এক মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে আরও বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন থাকবে। মুহসীন হল মাঠে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকবে খাবারের আয়োজন।

বর্ষবরণ উপলক্ষে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ উত্তর ও দক্ষিণ পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্ক থেকে কাল সকাল ৭টায় বর্ণাঢ্য র‌্যালি বের করবে, যাতে বাংলার লোকজ সংস্কৃতির নানা উপকরণ শোভা পাবে। 

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট পয়লা বৈশাখের দিন বিকাল ৪টায় ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবরে একক ও দলীয় লোকসঙ্গীত, নৃত্য ও আবৃত্তিসহ নানা আয়োজন করবে। বাংলা একাডেমি সকাল ৮টায় একাডেমীর নজরুল মঞ্চে বর্ষবরণের সঙ্গীত দিয়ে দিবসটি উদযাপন করবে।

চ্যানেল আই ও সুরের ধারা বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র প্রাঙ্গণে পঞ্চম বারেরমত আয়োজন করেছে হাজারো কণ্ঠে বর্ষবরণের অনুষ্ঠান। এখানে মেলার আয়োজনও থাকবে। অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচার করবে চ্যানেল আই।

ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির মেলাপ্রাঙ্গণেবৈশাখী মেলার আয়োজন করেছে। জাতীয় প্রেসক্লাব বর্ষবরণে তাদের সদস্য ও পরিবারবর্গের জন্য সকাল থেকেই খৈ, মুড়ি-মুড়কি, বাতাসা সহ বিশেষ ভোজের আয়োজন করেছে। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিও তাদের সদস্য ও পরিবারদের জন্যও প্রাতঃরাশ, দুপুরের খাবার ও বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। সাংবাদিকদের জন্য জাতীয় প্রেসক্লাব ও রিপোর্টার্স ইউনিটিতে রয়েছে বিশেষ আয়োজন।