পহেলা বৈশাখকে সামনে রেখে ব্যস্ততা বেড়েছে কুমার পল্লীতে

সময় হারিয়ে যায় অতীতের অদৃশ্য গহ্বরে। তবে সে শুধু চলেই যায় না, সৃষ্টি করে যায় ইতিহাস। যুগে যুগে পৃথিবীর একেক মেরুতে গড়ে ওঠে মানুষের ভিন্ন ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিল্প, সংস্কৃতি। বহমান সময়ের সঙ্গে পরিবর্তন হয় দিনক্ষণ, কর্ম আর শিল্পের। তেমনি মৃৎশিল্প বাংলাদেশের ঐতিহ্য বহনকারী একটি শিল্প। আমাদের পূর্ব পুরুষরা নিত্য প্রয়োজনীয় ব্যবহারিক বস্তু হিসেবে মৃৎশিল্পের তৈরি থালা, বাসন, হাঁড়ি, পাতিল, ঘটি-বাটি, বদনা ইত্যাদি ব্যবহার করতেন। বিভিন্ন সময় এই শিল্প নানা রূপ রঙে আমাদের সামনে বৈচিত্র নিয়ে হাজির হয়েছে। কিন্তু সেই মৃৎশিল্পই বর্তমানে হারিয়ে যাবার পথে।
মৃৎশিল্প বলতে মাটি দিয়ে বাংলার কুমাররা হাতের নিপুণ স্পর্শে কারুকাজের মাধ্যমে যে শিল্পের সৃষ্টি করেছে তাকেই বুঝি। এর মধ্যে থাকতে পারে নিত্যব্যবহার্য পাত্র অথবা ঘর সাজানোর উপকরণ। এককালে মৃৎশিল্পের তৈজসপত্র রাজা, জমিদার ও অভিজাত পরিবারের নিত্যদিনের ব্যবহার্য বস্তু ছিল। সন্ধ্যা প্রদীপ কিংবা সকালের পান্তা-মরিচ খাওয়া পর্যন্ত এই শিল্পের ব্যাবহার ছিল বেশ উল্লেখ করার মতো। প্রযুক্তির অগ্রগতি আর বিজ্ঞানের জয়ের ফসল হিসাবে কম দামে অধিক টেকসই অ্যালুমিনিয়াম, মেলামাইন, প্লাস্টিকসহ বিভিন্ন মেটাল সামগ্রীর দাপটে মৃৎশিল্পের তৈরি সামগ্রীর চাহিদা ব্যাপক হারে হ্রাস পেয়েছে। স্থানীয়ভাবে মৃৎশিল্পীদের কুমার বলা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর রিক্ত হস্তে মৃৎশিল্পীরা পৈতৃক ভিটেমাটিতে বাপ দাদার পেশাকে আঁকড়ে ধরে জীবিকা নির্বাহ করছে।
একদিকে যুদ্ধ পরবর্তী পুনর্বাসন ৭৪-এর দুর্ভিক্ষ, অপরদিকে মৃৎশিল্প পুনঃস্থাপনের চেষ্টা চালানো। রুজি রোজগারের সংগ্রামে প্রয়োজনীয় পুঁজির অভাবে অনেক কুমার পেশা বদলিয়েন। তবু কেউ কেউ কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে শুধু টিকে থাকার লড়াই করে চলেছেন মাত্র।
মৃৎশিল্পের বর্তমান বাজার জানতে নড়াইলের রূপগঞ্জ বাজারের বিক্রেতা রহমত আলী এর সঙ্গে কথা বললে তিনি জানান, ‘মরা গাছে পানি দেয়ার মতো চলছে’ বেচা-বিক্রি ভালো না। শৌখিন কিছু মানুষ ছাড়া কেউ আর কিনতে আসে না তেমন। তবে বিভিন্ন মেলাই খুব ভালো বিক্রি হয়। সামনে পহেলা বৈশাখ, তাই পণ্যের সমাহার ও বেশ দেখার মতো। এখন শুধুই অপেক্ষা।
মাটির ফুলদানি কিনতে আসা কারওরান বাজার এলাকার একজন ক্রেতার সঙ্গে কথা বললে তিনি জানান, ‘সময়ের পরিবর্তন হচ্ছে তাই মাটির জিনিসের ব্যবহার কমে যাচ্ছে। তাছাড়া মাটির জিনিসের দাম একটু বেশি থাকে, সেজন্য সবাই এর বিকল্প খুঁজছে। তবে এই প্রাচীন শিল্পকে রক্ষা করতে হলে ক্রেতাদেরই সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে’। কুমাররা শৈল্পিক দক্ষতা ও মনের মধ্যে লুকায়িত মাধুর্য দিয়ে চোখ ধাঁধানো সব কাজ করে থাকেন। নকশা করা হাঁড়ি-পাতিল, চাড়ি, কলস, বদনা, খানদা, ফুলের টপ, ফুলদানী, জীবজন্তু, পাখির অবয়ব, সাজ-সজ্জা অলংকারসহ বাংলার চিরাচরিত সব নিদর্শন উঠে আসে সে শিল্পে। তবে আশার কথা হল, শিল্প সচেতন ব্যক্তিরা মৃৎশিল্পের কদর করছেন বেশ। তাদের চাহিদায় শৌখিনতার অনুষঙ্গ হচ্ছে মাটির এসব পাত্র। মাটির তৈরি জিনিসপত্র দিয়ে ঘরের শোভা প্রকাশ করছেন। সঠিক ব্যবহারে প্রশংসাও পান কম না। বর্তমানে কর্মক্ষেত্রেও এর ব্যবহার ভালো লক্ষ্যণীয়। মৃৎশিল্পের পণ্য ব্যবহার বাড়ানো গেলে দেশের কর্মসংস্থানও বৃদ্ধি পাবে অনেক। নড়াইলের রূপগঞ্জ, নিশিনাথতলাসহ অনেক জায়গাতেই পেতে পারেন আপনার শখের ফুলদানী কিংবা মাটির বাসনসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় মাটির পণ্য।
এছাড়া দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেমন- ইনফ্যাক্টস-ডু-ম্যান, আড়ং, ব্রাক, হ্যান্ডিক্রাফটস, কুমুদিনী, কারিকা, আইডিয়াসসহ অনেক প্রতিষ্ঠানে পাবেন পছন্দের এসব পণ্য। বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের নিজস্ব কুমার দ্বারা নিত্যনতুন ডিজাইনের মাটির জিনিস তৈরি করছেন। বিক্রয়ের পাশাপাশি দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্ব বাজারে রপ্তানি করেও অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। মৃৎশিল্প সম্পর্কে উজিরপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক মোঃ নাজমুল হাসান বলেন, আমাদের ছোট বেলায় হরেক রকমের মৃৎশিল্পের পশরা সাজিয়ে বিক্রি করতে দেখেছি। কিন্তু কালের আবর্তে তা আজ রুপকথার গল্পের মতো হয়ে গিয়েছে। বর্তমানে প্লাস্টিকের তৈজসপত্রের যুগে মৃৎশিল্প যেন অন্ধকারে নিমজ্জিত হচ্ছে।