English Version
আপডেট : ১৬ মার্চ, ২০১৬ ১৪:৫৭

নড়াইলে মৃৎশিল্প বিলুপ্তির পথে

উজ্জ্বল রায়
নড়াইলে মৃৎশিল্প বিলুপ্তির পথে

নড়াইলের ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প বিলুপ্তির পথে। প্রয়োজনীয় পুঁজি, উপকরণ আর বাজারের অভাবে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত অনেকেই জীবিকার তাগিদে এখন যাচ্ছেন ভিন্ন পেশায়। পাশাপাশি বাচাঁর তাগিদে এ পেশা অনেকেই পাড়ি জমাচ্ছেন ভারতে। ফলে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে দেশের এ শিল্পটি।

নড়াইলের কুন্দশী, চোরখালি, জয়পুর, দিঘলিয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় ৪ শতাধিক পরিবার দীর্ঘদিন ধরে এই পেশার সঙ্গে জড়িয়ে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। এসব পরিবারের লোকসংখ্যা যে হারে বেড়েছে সে হারে মৃৎশিল্পের চাহিদা বাড়েনি। বরং দিনদিনের চাহিদা কমে যায়। ফলে তাদের মধ্যে দেখা দিযেছে আর্থিক সঙ্কট, বেড়েছে দারিদ্র্যতা। বাজারে আধুনিক প্রযুক্তির আ্যলুমিনিয়াম, প্লাষ্টিক ও স্টিলের তৈজসপত্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় মাটির তৈরি হাঁড়ি-পাতিল কিনছে না অনেকেই। ফলে তাদের মধ্যে দেখা দিযেছে আর্থিক সঙ্কট, বেড়েছে দারিদ্র্যতা।

মৃৎশিল্পের সঙ্গে জড়িত শিল্পীরা নিজ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় জীবিকা নির্বাহ করার জন্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। যেসব হিন্দু পরিবাব এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত  তারা রুদ্রপাল বা কুমার নামে পরিচিত। এই সম্প্রদায় ভুক্ত লোকরা শিক্ষায় অনগ্রসর হওয়ার কারণে সিংহভাগ সদস্যেরই চাকরি করার যোগ্যতা নেই। পূর্বপুরুষের পেশাকে ছেড়ে পাল সম্প্রাদায়ের লোকরা এতকাল নিজেদের অন্য কোন পেশার সঙ্গে যুক্ত করেনি। শত অভাবের মধ্যেও আকড়ে ছিলেন পূর্বপুরুষের ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পকে।

জীবিকার তাগিদে অনেক পরিবারই চলে গেছেন ভিন্ন পেশায়। শত অভাবের মাঝেও বেশ কিছু কুমার পরিবার তাদের পূর্বপুরুষের এই ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন। কুমারপাড়ায় ঢুকলেই চোখে পড়ে তাদের কষ্টের জীবনযাত্রা। গোটা পাড়াতেই যেন লেগে আছে এক বিষাদের ছোঁয়া। ময়লা ও ছেড়া কাপড় পরনে তাদের। পুষ্টিহীনতার শিকার জীর্ণ শরীরের শিশুদের দীপ্তি নেই চোখে মুখে। কুন্দশী এলাকার কুমারপাড়ায় গেলে তারা তাদের ক্ষোভের এবং হতাশার কথা বলেন।

তারা বলেন, কেউ তাদের খোঁজ নেয় না। জানতেও চায় না তাদের সুখ-দুঃখ, সুবিধা-অসুবিধার কথা। এই এলাকার তপন কুমার পাল জানান, সারা মাস হাঁড়ি-পাতিল, সরা-কলস, খোড়া, দোনাসহ বিভিন্ন ধরনের মাটির সামগ্রী তৈরি করে শুকানোর পর ভাটায় পুড়িয়ে সেগুলো নিয়ে যাওয়া হয় হাট-বাজারে। জ্বালানির খড়ি বা লাকড়ির দাম বৃদ্ধির জন্য এক খোলা মাল তৈরি করতে প্রায় থেকে ৮শ’ থেকে এক হাজার টাকা খরচ হয়। অথচ এক খোলা মাল বিক্রি করে চার থেকে পাঁচ শত টাকাও লাভ হয় না।

চোরখালী এলাকার কুমার শিল্পীরা জানিয়েছেন, মাটির জিনিস বানাই বিক্রি করি। আর তা দিয়ে কোন রকমে খাওয়া-দাওয়া চলে। এই কাজে হাড়ভাঙ্গা খাটুনি। অথচ আয় নেই। পূর্ব পুরুষের ঐতিহ্য এই পেশাকে ধরে আছেন।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, অধিকাংশ পাল পরিবারই ভূমিহীন। নিজেদের বসবাসের জন্য সামান্য ভিটেটুকু ছাড়া তাদের অন্য কোন জমি নেই। তারপরও তারা তাদের পেশার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে আঁকড়ে ধরে আছে এই শিল্পকে।

মৃৎশিল্পীরা জানান, এক সময় আমাদের কিনে খেতে হয়নি। গ্রামে গ্রামে চিটা ধানের বিনিময় হাঁড়ি-পাতিল বিক্রি করে যে ধান পাওয়া যেত তা দিয়েই চলে যেত প্রায় সারা বছর। কিন্তু এখন তা আর পাওয় যায় না। লোহাগড়ার পাল সম্প্রদায়ের লোকরা এত অভাবের পরও পূর্বপুরুষের এই ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে চান।

তারা জানান, পরিবারভিত্তিক ব্যাংক ঋণ ও আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ সম্পর্কে প্রশিক্ষণ ও কারিগরি উপকরণ সরবরাহের ব্যবস্থা করলে এখনও তারা মৃৎশিল্পকে অবলম্বন করে টিকে থাকতে পারেন। তাই এ অবস্থায় মৃৎশিল্পীদের তৈরি জিনিসপত্রের মান উন্নয়ন এবং আধুনিকীকরণ করতে না পারলে তাদের ভাগ্যের উন্নয়ন হবে না।