English Version
আপডেট : ৫ মার্চ, ২০১৬ ১৩:০০

৭১ স্থাপনা-নিদর্শন বাঁচাতে মেট্রো রেলের নকশা বদল

নিজস্ব প্রতিবেদক
৭১ স্থাপনা-নিদর্শন বাঁচাতে মেট্রো রেলের নকশা বদল

রাজধানীর উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রো রেলপথ নির্মাণ করা হবে জাতীয় সংসদ ভবন, জাতীয় জাদুঘর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যসহ ৭১টি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের পাশ দিয়ে। এসব স্থাপনা ও নিদর্শনের মধ্যে মোগল আমলে নির্মিত ঢাকা গেটসহ বিভিন্ন ভবন বাঁচাতে গত এক বছরে স্থানে স্থানে নকশা পরিবর্তন করা হয়েছে। রেলপথ নির্মাণ ও ট্রেন চলার সময় শব্দ ও কম্পনে স্থাপনাগুলো যাতে কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে জন্য উচ্চ শব্দ প্রতিরোধক দেয়াল ও মাস  স্প্রিং সিস্টেম ব্যবহার করা হবে। প্রকল্পের বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। প্রকল্পের ঐতিহাসিক স্থাপনা ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন-সংক্রান্ত সমীক্ষা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, উড়াল রেলপথ যে ৭১টি নিদর্শনের পাশ দিয়ে যাবে সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ আটটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পড়েছে রুটের মধ্যেই। এগুলো হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার রাজু ভাস্কর্য, ঢাকা গেট, দোয়েল চত্বর, কদম ফোয়ারা ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, মতিঝিলের শাপলা চত্বর, কারওয়ান বাজারের সার্ক ফোয়ারা ও জাতীয় সংসদ ভবন। প্রকল্পের বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলীরা জানান, রাজু ভাস্কর্য থেকে মেট্রো রেলপথের দূরত্ব হবে ৩০ মিটার, রেলপথের পিয়ার বা পিলারের দূরত্ব হবে ২০ মিটার। প্রকল্পের সুরক্ষাবিষয়ক বিশেষজ্ঞ মো. নুরুল ইসলাম বলেন, বিভিন্ন স্থাপনার মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি ছিল ঢাকা গেটের। এটি মোগল আমলে নির্মিত। রেলপথের পিয়ার থেকে এই গেটের দূরত্ব আগে ১২ মিটার রাখা হয়েছিল। ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকায় এর দূরত্ব ২০ মিটার করে নকশা পরিবর্তন করা হয়েছে। তিনি জানান, অন্য সব স্থাপনা ঝুঁকিমুক্ত রেখেই গত এক বছরে নকশা ঠিক করা হয়েছে। আশঙ্কা ছিল, রেলপথ নির্মাণের সময় পাইলিং করতে গিয়ে ঢাকা গেটের পিলারটি ধসে পড়তে পারত। তা যাতে না হয় সে জন্য আধুনিক প্রযুক্তির বিশেষ যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হবে।  মেট্রো রেলের কারণে রাজু ভাস্কর্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে দাবি করা হচ্ছে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে। তবে প্রকল্প কর্মকর্তারা বলছেন, এই ভাস্কর্যের ২০ মিটার দূরে মেট্রো রেলের পিলার থাকবে। ফলে এই ভাস্কর্যের কোনো ক্ষতি হবে না, এমনকি সৌন্দর্যহানিও ঘটবে না। কারণ এটি কংক্রিটের তৈরি। এ ছাড়া নির্মাণের পর রেল চলাচলের কম্পনে এটি ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। দোয়েল চত্বর, কদম ফোয়ারা, সার্ক ফোয়ারা ও শাপলা চত্বরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে না বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন।  প্রকল্পের অংশ যাবে জাতীয় সংসদ ভবন এলাকার মধ্য দিয়ে। বিশেষজ্ঞ মো. নুরুল ইসলাম বলেন, খামারবাড়ির অদূরে খেজুরবাগানের মধ্য দিয়ে ৬০ মিটার ভেতরে ঢুকবে মেট্রো রেলের অবকাঠামো। ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতাল ও ফার্মগেটের একটি মার্কেট রক্ষা করতে সংসদ ভবন এলাকায় ২০০ মিটার ব্যাসার্ধে বেঁকে যাবে রেলপথ। রেলপথ নির্মাণকালে ধূলিকণার ওড়াউড়িতে সংসদ ভবনের সৌন্দর্য যাতে নষ্ট না হয় সে জন্য কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে জানতে চাইলে বিশেষজ্ঞ মো. নুরুল ইসলাম বলেন, ওই সময় ঠিকাদারদের সতর্ক থাকতে হবে। তিনি বলেন, ‘শেওড়াপাড়ায় প্রকল্পের স্টেশনে অবকাঠামো নির্মাণ করা হলে একটি ৯ তলা ভবন বাধা হয়ে দেখা দিতে পারে। আগুন লেগে গেলে অগ্নিনির্বাপণকারীরা রেল অবকাঠামোর কারণে আগুন নেভাতে যেতে পারবে না। আমরা সেটি বুঝতে পেরে এখানেও নকশা পরিবর্তন করেছি। এভাবে বিভিন্ন স্থানে নকশা পরিবর্তন করা হয়েছে।’ প্রকল্পের সমীক্ষানুসারে, নির্মিতব্য রেলপথের ১৯ থেকে ১৩৬ মিটারের মধ্যে পড়বে টিএসসির পাশের গ্রিক স্মৃতিস্তম্ভ, তিন নেতার মাজার, পুরাতন হাইকোর্ট ভবন, চামেলী হাউস, কার্জন হল, বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউস, কারওয়ান বাজারের খাজা আম্বর শাহ মসজিদ, জাতীয় জাদুঘর, বায়তুল মোকাররম মসজিদ, হাইকোর্টের পাশে হাজী খাজা শাহবাজ মসজিদ ও হাজী খাজা শাহবাজের সমাধি এবং মুসা খান মসজিদ। সমীক্ষা প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলা হয়েছে, রেলপথের পাইলিংয়ের জন্য তিন নেতার মাজার, কার্জন হল, গ্রিক স্মৃতিস্তম্ভ, হাজী খাজা শাহবাজ মসজিদ ও হাজী খাজা শাহবাজের সমাধি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। চামেলী হাউস, বর্ধমান হাউস ও পুরনো হাইকোর্ট ভবনও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। দুর্বল হয়ে পড়তে পারে খাজা আম্বর শাহ মসজিদ ও মুসা খান মসজিদ। পুরাতন বিমানবন্দর, বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র, ফার্মগেটের ব্রিটিশ বাংলো, হলিক্রস চার্চ, কারওয়ান বাজারের খাজা আম্বর পুল, রূপসী বাংলা হোটেল (ইন্টারকন্টিনেন্টাল) ও জাতীয় কবির সমাধি ক্ষতির মুখে পড়তে পারে। প্রকল্প কর্মকর্তারা বলছেন, ক্ষতি থেকে বাঁচাতে ব্যবহার করা হবে শব্দরোধক দেয়াল। এসব স্থানের সামনে দিয়ে রেলপথে বড় বড় স্প্যান দেওয়া হবে। প্রকল্পের পরিবেশগত সমীক্ষায় রেলপথ নির্মাণ ও ট্রেন পরিচালনার সময় শব্দদূষণ ও কম্পন নিয়ন্ত্রণে রাখতে বিভিন্ন সুপারিশ করেছেন পরামর্শকরা। তাঁরা বলেছেন, স্থাপনাগুলো ক্ষতি থেকে রক্ষার জন্য ব্যবহার করতে হবে শব্দহীন রেলপথ। রেলপথের পাশে ব্যবহার করতে হবে শব্দ প্রতিবন্ধক। দৃঢ়ভাবে যুক্ত লম্বা ট্র্যাক ব্যবহার করতে হবে। বাঁক নেওয়া অংশে গতি সীমিত রাখতে হবে মেট্রো রেলের। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সোজা পথে রেলের গতি ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার। তবে বাঁক নেবে এমন অংশে তা ২০০ মিটারে নামিয়ে আনতে হবে। তাঁরা ২০০৬ সালের শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ আইন মেনে চলা, শব্দের মাত্রা জাপানি আদর্শ মানের (৮৫ ডেসিবল) মধ্যে রাখা, কম শব্দ উৎপন্ন হয় এমন যন্ত্রপাতি ব্যবহার, নির্মাণ এলাকার চারপাশে শব্দ প্রতিবন্ধক ব্যবহারের সুপারিশ করেছেন। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী, বাণিজ্যিক এলাকায় শব্দমাত্রা ৭০ ডেসিবল ও আবাসিক এলাকায় তা ৬০ ডেসিবেলের মধ্যে রাখতে হয়। প্রকল্প পরিচালক মো. মোফাজ্জেল হোসেন বলেন, ‘রেলপথ নির্মাণে আধুনিক প্রযুক্তির শব্দবিহীন ট্র্যাক ব্যবহার করার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া ট্র্যাকের দুই পাশে শব্দ প্রতিবন্ধক দেয়াল ব্যবহার করা হবে। আমরা সব স্থাপনাই অক্ষত রেখে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করব।’ ২০১৭ সালের শেষ দিকে রেলপথ নির্মাণের কাজ শুরু হবে। রেলপথের নকশা চূড়ান্ত করা হয়েছে। মৃত্তিকা পরীক্ষাও শেষ হয়ে গেছে। এখন এই প্রকল্পের এলাকায় সেবালাইন সরানোর উদ্যোগ নেওয়া হবে।  প্রকল্পের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, আন্তর্জাতিক ও দেশীয় বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুসারে স্পর্শকাতর স্থাপনাগুলো থেকে যত দূরে সম্ভব উড়াল রেলপথ ও রেলস্টেশন নির্মাণ করা হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্য দিয়ে এই রেলপথ যাবে না। প্রকল্পের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় বা টিএসসির কোনো স্থাপনাও ভাঙতে হবে না। তবে নিয়োগ পাওয়ার পর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বিশেষজ্ঞদের নির্দেশনা অনুসারে কাজ করছে কি না তা নিবিড়ভাবে তদারকি করতে হবে।  প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত রেলপথ হবে ১৯ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার দীর্ঘ। রাস্তার ১৩ মিটার ওপর দিয়ে যাবে রেলপথ। ৩০ মিটার পর পর বসানো হবে পিয়ার বা পিলার। তবে স্পর্শকাতর স্থাপনাগুলো রক্ষার জন্য ৭০ মিটার লম্বা স্প্যানও ব্যবহার করা হবে। উড়াল রেলপথের ক্ষতি প্রতিরোধে বিল্ডিং কোড অনুসরণ করার সুপারিশ করা হয়েছে সমীক্ষা প্রতিবেদনে। তাতে আট থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পেও রেলপথের পিলার বা ভায়াডাক্ট ক্ষতির মুখে পড়বে না বলে মন্তব্য করা হয়েছে।