অভিজিতের খুনিরা শনাক্ত; ব্লগার খুনে তৎপর এবিটির ‘স্লিপার সেল’

লেখক-ব্লগার অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের এক বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ। এমন পরিস্থিতিতে তদন্তে নতুন আশার কথা শোনা গেলেও দৃশ্যত কোনো অগ্রগতি নেই। অভিজিতের বই প্রকাশ করা দুই প্রকাশনীতে হামলা চালিয়ে এক প্রকাশককে হত্যা ও তিনজনকে আহত করার ঘটনাও রহস্যাবৃত। তবে তদন্তকারী সূত্রগুলো বলছে, এসব মামলা একই সূত্রে গেঁথে তদন্ত চলছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা শিগগিরই তদন্তে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যায় প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেওয়া তিন খুনিকে শনাক্ত করেছেন তদন্তকারীরা। শনাক্ত করা গেছে আরো সন্দেহভাজন সাতজনকে, যারা হত্যাকাণ্ডের সময় বইমেলা এলাকায় অবস্থান করে খুনিদের সহায়তা করেছে। তাদের গ্রেপ্তারে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে ব্যাপক অভিযান চলছে। শিগগিরই অভিজিতের খুনিরা গ্রেপ্তার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
একের পর এক ব্লগার হত্যার পর প্রকাশক খুনের মিশনে নেমেছে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) সদস্যরা। এসব গুপ্ত হত্যায় কাজ করছে দু-তিনটি স্লিপার সেল। এবিটির অনুসারীরা গোপনে সংগঠিত হলেও তাদের কাছে হত্যার নির্দেশনা আসছে একই চক্র থেকে। মুক্তমনা লেখক-ব্লগার ড. অভিজিৎ রায় হত্যা মামলার তদন্ত করতে গিয়ে এসব তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা।
এসব আসামি গ্রেপ্তারের মাধ্যমে প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যা ও আহমেদুর রশীদ টুটুলসহ তিনজনের ওপর হামলা, ব্লগার নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় ওরফে নিলয় এবং সিলেটের অনন্ত বিজয় দাশ হত্যার পুরো রহস্য উন্মোচিত হবে বলে আশা তদন্তকারীদের। বইমেলা এলাকার সিসিটিভি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ, তথ্যপ্রযুক্তির বিশ্লেষণ এবং সম্প্রতি গ্রেপ্তার হওয়া এবিটির দুই সদস্যের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ব্লগার-লেখক হত্যার তদন্তে নতুন তথ্য মিলেছে। তবে তদন্তের স্বার্থে এবিটির হত্যাকারী দলের (স্লিপার সেল) হোতাদের নাম প্রকাশ করেনি সূত্র।
ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটি) প্রধান, অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম গতকাল বৃহস্পতিবার বলেন, ‘ড. অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডের সময় যারা ঘটনাস্থলে ও আশপাশে ছিল, তাদের কাউকে কাউকে আমরা শনাক্ত করেছি। তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি অভিযান চলছে। আমরা আশাবাদী। আমরা শুধু ডিএনএ রিপোর্ট বা এফবিআইয়ের কাছ থেকে আসা রিপোর্টের জন্য বসে আছি, তা নয়। খুব তাড়াতাড়ি এই মামলাসহ যেসব ব্লগার ও প্রকাশক হত্যা মামলা এখনো ডিটেক্টেড হয়নি, সেগুলোর উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি খুব তাড়াতাড়ি হবে বলে আশা করছি।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ঘটনাস্থলে ছিল এবং ঘটনাস্থলের আশপাশে ছিল এমন তিনজনকে আমরা শনাক্ত করেছি। এর বাইরে ঘটনাস্থলের আশপাশে ছিল এমন ছয়-সাতজনকে আমরা আইডেন্টিফাই করেছি, যারা বইমেলা এলাকায় অবস্থান করে খুনিদের সহায়তা করেছে। তাদের সম্পৃক্ততা সম্পর্কে কিছু ডকুমেন্টারি এভিডেন্স আমাদের হাতে আছে। আমরা যাদের শনাক্ত করেছি তারা সবাই আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য।’
জানতে চাইলে মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘খুনিদের মধ্যে তিনজন ঘটনাস্থলে এবং বাকিরা বইমেলার বিভিন্ন জায়গা থেকে এই হত্যাকাণ্ডে সহযোগিতা করেছিল।’
এদিকে নিহত অভিজিৎ রায়ের বাবা অধ্যাপক অজয় রায় কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পুলিশ বারবার একই কথা বলে আসছে। কিন্তু অগ্রগতি বা সাফল্য বলে কিছু নেই। অনেক দিন তো হয়ে গেল। তার পরও আমরা তাদের ওপর আস্থা রাখতে চাই। আশা করি, তারা সফল হবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের পুলিশ-ডিবি অনেক ঘটনার রহস্য উন্মোচন করেছে। এফবিআইয়ের প্রতিবেদনের আশায় তাদের বসে থাকতে হবে, এটা হতে পারে না। আমি হতাশ হতে চাই না।’
অভিজিৎ, দীপন ও নিলয় হত্যা এবং টুটুলের ওপর হামলার ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্ত করছে ডিএমপির গোয়েন্দা ও অপরাধ তদন্ত বিভাগ (ডিবি)। ডিবির উপকমিশনার (ডিসি-দক্ষিণ) মাশরুকুর রহমান খালেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা অভিজিতের কয়েকজন খুনির ব্যাপারে তথ্য পেয়েছি। দুই এবিটি সদস্য গ্রেপ্তারের পর আমরা অনেক দূর পৌঁছে গেছি। অভিযান চালাচ্ছি। আমাদের কাছে তথ্য আছে, এদের ধরতে পারলে অন্য ঘটনাগুলোরও রহস্য খুলতে পারে।’
গতকাল অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘এবিটির জঙ্গিদের দু-তিনটি গ্রুপ টার্গেট কিলিং করছে। তাদের নেক্সট টার্গেট কে ছিলেন তা আমরা জেনেছি। তিনি ইতিমধ্যে দেশ ছেড়েছেন (প্রকাশক টুটুলকে ইঙ্গিত করে বলেন)।’
তদন্তের ব্যাপারে মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘অভিজিৎ হত্যার মামলাটি ক্লুবিহীন ছিল। তদন্ত করে আমরা কয়েকজনকে চিহ্নিত করেছিলাম, নানাভাবে যাদের সম্পৃক্ততা আছে। অভিজিৎ রায়ের হত্যা ছিল সুপরিকল্পিত। শিক্ষিত ও স্মার্ট ছেলেরা এ ধরনের ঘটনা ঘটালে সেটি বের করতে একটু সময় লাগে।’ তিনি আরো বলেন, ‘এ পর্যন্ত মোট আটজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যাদের দুজনের বিরুদ্ধে সরাসরি প্ররোচনাদানের অভিযোগ আছে। এ দুজন হলো ফারাবী ও সিলেটে অনন্ত বিজয় হত্যা মামলার আসামি মান্নান রাহী। এর পাশাপাশি সন্দেহভাজন কয়েকজন গ্রেপ্তার হয়েছে। তাদের কেউ কেউ ঘটনাস্থলে থাকলেও থাকতে পারে। তবে আমরা যে চেহারাগুলো শনাক্ত করেছি সেগুলোর মধ্যে তারা নেই। যে আলামতগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে সেগুলো ডিএনএ টেস্টের জন্য পাঠানো হয়েছে। ফলাফল পেলে নমুনা মিলিয়ে দেখা হবে।’
মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘এফবিআইয়ের সঙ্গে আমাদের প্রতিনিয়ত যোগাযোগ আছে। ড. অভিজিৎ রায়ের স্ত্রীর কাছ থেকে যেসব তথ্য এফবিআই পাচ্ছে, সেগুলো আমাদের জানাচ্ছে। আমাদের তথ্যও তাদের দিচ্ছি। কিছু জানার থাকলে যোগাযোগ করছি। এফবিআই জানিয়েছে, তাদের রিপোর্টগুলো সম্পন্ন হয়েছে। যারা গ্রেপ্তার হয়েছে তাদের কারো কারো ডিএনএ স্যাম্পল পরীক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। রিপোর্ট হাতে এলেই জানতে পারব।’
গত বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় ড. অভিজিৎকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক অভিজিতের স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাও ওই হামলায় গুরুতর জখম হন। পরে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান।
তদন্তে নেমে দুজনকে জিজ্ঞাসাবাদের পর ডিবি দাবি করে, হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে এবিটি। এর ঠিক আড়াই মাস পর ১২ মে সিলেটে ব্লগার অনন্ত বিজয় দাসকে একই কায়দায় কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। অভিজিৎ হত্যা মামলায় সন্দেহভাজন ব্লগার ফারাবীকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। ফারাবী এখন জেলহাজতে।
এদিকে অভিজিৎ হত্যার তদন্তে সহায়তা করতে এফবিআইর দল আসে বাংলাদেশে। ১১টি আলামত পরীক্ষা করে তদন্তে সহায়তার জন্য তাদের কাছে হস্তান্তর করেছে ডিবি। গত বছরের ১৮ আগস্ট তৌহিদুর রহমান, সাদেক আলী মিঠু ও আমিনুল মল্লিক নামের তিন এবিটি সদস্যকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। এই তিন আসামিকে সাত দিনের রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করে ডিবি পুলিশ। র্যাব দাবি করে, অভিজিৎ রায়কে হত্যার নির্দেশ আসে কারাগার থেকে। এবিটিপ্রধান মুফতি জসিম উদ্দিন রাহমানী কারাগার থেকে তার ভাই আবুল বাশারের মাধ্যমে ওই নির্দেশনা পাঠায়।
এদিকে অনন্ত বিজয় হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার ব্লগার মান্নান রাহী ও তার ছোট ভাই মোহাইমিন নোমানকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। পরে রাহী ব্লগার অন্তত হত্যা মামলায় স্বীকারোক্তি দিলে তাকে অভিজিৎ হত্যা মামলার রিমান্ডে নেয় ডিবি।
এ ছাড়া গত বছরের ৭ আগস্ট রাজধানীর গোড়ানে বাসায় ঢুকে স্ত্রীর সামনে ব্লগার নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় ওরফে নিলয়কে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এই হত্যা মামলায় এবিটির সদস্য সাদ আল নাহিন, মাসুদ রানা, কাউসার হোসেন ও কামাল হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেওয়ার কথা অস্বীকার করলেও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে।
অন্যদিকে গত বছরের ৩০ অক্টোবর আজিজ সুপার মার্কেটে নিজ কার্যালয়ে জাগৃতি প্রকাশনীর কর্ণধার ফয়সাল আরেফিন দীপনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। একই দিন লালমাটিয়ায় প্রকাশনা সংস্থা শুদ্ধস্বরের কার্যালয়ে ঢুকে এর কর্ণধার আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুল, কবি তারেক রহিম ও লেখক রণদীপম বসুকে কোপানো হয়। চিকিৎসা নেওয়ার পর জীবনের নিরাপত্তার জন্য গত বছরই যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান টুটুল। দুই লেখক ও তাঁদের পরিবার এখনো আতঙ্কে আছে।
ডিবির সূত্র জানায়, পাঁচটি ঘটনার মাস্টারমাইন্ড বা পরিকল্পনাকারী ধরতে ব্যাপক তদন্ত শুরু করে ডিবি ও সিআইডি। সম্প্রতি ডিএমপির সিটি ইউনিট গঠনের পর যৌথ তদন্তে নতুন গতি পেয়েছে। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর বাড্ডার একটি জঙ্গি আস্তানায় অভিযানে কামাল ওরফে শাহীন ওরফে জামাল (২৬) ও শাহ আলম ওরফে সালাউদ্দিন ওরফে হিরন (৩০) নামের এবিটির দুই সক্রিয় সদস্যকে গ্রেপ্তার করে সিটি ও ডিবি। পরে তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মোহাম্মদপুরের নবোদয় হাউজিংয়ের প্রধান সড়কের বি-ব্লকের ২৮ নম্বর বাড়ির পাঁচতলার একটি ফ্ল্যাটে বোমার কারখানার সন্ধান পাওয়া যায়। দুই জঙ্গিকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে অভিজিৎ ও প্রকাশকসহ অন্য ব্লগার হত্যার ব্যাপারে চাঞ্চল্যকর তথ্য মিলেছে। এ ছাড়া বইমেলার সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে ঘটনাস্থলের আশপাশে অবস্থান করা সাতজনের চেহারা শনাক্ত করেছে ডিবি।
ডিবি সূত্র জানায়, এবিটির সদস্যরা আগে লেখক অভিজিৎকে খুন করে। এই স্লিপার সেলের সম্পৃক্ত আরেকটি দল অভিজিতের বইয়ের প্রকাশকদের হত্যার পরিকল্পনা করে। দুই ঘটনা সরাসরি সম্পৃক্ত। ফলে খুনিরাও একই গ্রুপের। তবে দুই খুনের স্থানে থাকা সব খুনি এক নয় বলে তথ্য পাওয়া গেছে। অভিজিৎকে হত্যার মিশনে অংশ নিয়েছে পাঁচজন। এর মধ্যে তিনজন খুনের স্থানে ছিল। সেখানে চাপাতি ব্যবহার করে কোপায় দুজন।
ডিবির কর্মকর্তারা জানান, শনাক্ত হওয়া তিন প্রত্যক্ষ খুনির বিস্তারিত পরিচয় পেয়েছেন তাঁরা। আসামিদের ধরতে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে অভিযান চলছে। তবে তদন্তের স্বার্থে কেউ খুনিদের নাম প্রকাশ করতে চাইছেন না। একই দল অভিজিৎ ও দীপন খুনে সরাসরি সম্পৃক্ত বলে দাবি করলেও অন্য খুনেও তারা জড়িত কি না তা নিশ্চিত করছেন না তদন্তকারীরা। সন্দেহভাজন খুনিদের ধরতে বিমানবন্দরে সতর্কতা জারি করা হয়েছে। তথ্য দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন সংস্থার কাছে।
সূত্র আরো জানায়, এবিটি সদস্য জামাল ও হিরনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালত ছয় দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। তাদের রিমান্ডে এনে মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদের জন্য অপর এবিটি সদস্যদের খুঁজছেন গোয়েন্দারা। গ্রেপ্তারকৃত দুজন প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদেই ব্লগার ও লেখক হত্যার ছকের ব্যাপারে তথ্য দেয়। তারা দাবি করে, টুটুল ছাড়াও উত্তরা ও আজিমপুরে দুই ব্লগারকে হত্যার পরিকল্পনা ছিল তাদের।
তথ্যসূত্র ও কৃতজ্ঞতা : কালের কন্ঠ