বাংলা একাডেমির বই মেলায় নিরাপত্তা ব্যবস্থায় বড় ধরণের ত্রুটি

এবারের বইমেলায় শুরু থেকেই ঢাক-ঢোল পিটিয়ে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, বইমেলা ঘিরে থাকছে চার স্তরের নিরাপত্তা। প্রকাশক-লেখকদের জন্যও বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছিল। তবে বইমেলা শুরুর পর বেরিয়ে এলো নিরাপত্তা আয়োজনের বড় গলদ। সন্দেহভাজনদের গতিবিধি নজরদারি করতে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঘিরে যে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা (সিসিটিভি) বসানো হয়েছে তাতে ধরা পড়েছে বড় ত্রুটি। এখন পর্যন্ত সেখানে স্থাপিত ১১৩টি ক্যামেরার মধ্যে ২০টি পুরোপুরি অকেজো। আবার অনেক ক্যামেরার ধারণকৃত ফুটেজের মানও খারাপ। এসব সিসিটিভিতে ধারণকৃত ফুটেজ স্পষ্টভাবে দেখা সম্ভব নয়। বাংলা একাডেমির তত্ত্বাবধানে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এসব সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো হয়েছে।
বইমেলার নিরাপত্তায় লাগানো সিসিটিভির ফুটেজের অস্পষ্টতা ও অপর্যাপ্ততার কথা উল্লেখ করে বুধবার রাতে শাহবাগ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছে পুলিশ। সেখানে আরও বলা হয়, বইমেলা উপলক্ষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাতি লাগানোর সিদ্ধান্ত ছিল। মেলার তিন দিন পার হলেও এখন পর্যন্ত একটি বাতিও লাগানো হয়নি। নিরাপত্তা আয়োজনের এমন গাফিলতির কথা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে জানানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পুলিশের রমনা বিভাগের এডিসি জসীম উদ্দিন জানান, বইমেলার নিরাপত্তায় বসানো ২০টি সিসিটিভি নষ্ট। বিষয়টি বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষকে বুধবার মৌখিকভাবে জানানো হয়েছে। শাহবাগ থানার ওসি আবু বকর সিদ্দিক বলেন, সিসিটিভি ক্যামেরার গুরুতর ত্রুটি ধরা পড়ার পর বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একাধিকবার কথা হয়েছে। অধিকাংশ ক্যামেরার ফুটেজ অস্পষ্ট। ভালোমানের ক্যামেরা লাগাতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দুই দিনের সময় নিয়েছে। মেলা শুরুর আগেই পর্যাপ্ত সিসিটিভি লাগানোর কথা থাকলেও দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান তাতে ব্যর্থ হয়। এ ছাড়া এখনও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এলাকায় বাতি লাগানো হয়নি। এ ব্যাপারে থানায় একটি জিডি হয়েছে।
যোগাযোগ করা হলে বাংলা একাডেমির পরিচালক (প্রশাসন) এ কে এম মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, সিসিটিভি ক্যামেরার ব্যাপারে পুলিশের কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়া গেছে। আজকালের মধ্যে ক্যামেরা পরীক্ষা করে দেখা হবে। তিনি জানান, চার বছর ধরে ইভেন্ট টাচ নামক প্রতিষ্ঠান থেকে ক্যামেরা নেওয়া হয়। এবারও তাদের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে।বইমেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব ড. জালাল আহমেদ বলেন, বইমেলার নিরাপত্তায় আড়াইশ' সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানোর পরিকল্পনা রয়েছে। এখনও সব লাগানো সম্ভব হয়নি। বৃহস্পতিবারের মধ্যে সব ক্যামেরা লাগানো হবে।
গত বছর বইমেলা থেকে ফেরার পথে টিএসসি এলাকায় বিজ্ঞানমনস্ক লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায় খুন হন। গুরুতর আহত হন তার স্ত্রী ডা. রাফিদা আহমেদ বন্যা। ওই ঘটনার ৮ মাসের মাথায় শাহবাগে নিজের প্রতিষ্ঠানের ভেতর জাগৃতির প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপনকে হত্যা এবং একই দিন শুদ্ধস্বরের প্রকাশক আহমেদুর রশীদ টুটুলের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় ধর্মীয় উগ্রপন্থি গ্রুপ জড়িত বলে পুলিশ বলে আসছে। এ সব বিষয় মাথায় রেখে এবার একুশে বইমেলায় সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়।
দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, এবারের বইমেলার নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে বাংলা একাডেমির আয়োজনে যে একাধিক সমন্বয় সভা হয়েছিল তাতে সব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়_ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাতি লাগাবে গণপূর্ত বিভাগ আর টিএসসি ও আশপাশ এলাকায় সড়কের নিরাপত্তা দেখবে সিটি করপোরেশন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রাস্তায় সব বাতি ঠিকঠাক করা হয়েছে। তবে এখনও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কোনো বাতি বসেনি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে গণপূর্ত বিভাগের উপ-সহকারী প্রকৌশলী রাশেদুল হাসান খান বলেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এলাকা আলোকিত করার জন্য প্রয়োজনীয় চাহিদাপত্র বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষকে দেওয়া হয়েছিল। তাদের কাছ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। তাই অর্থ সংকটে কাজও শুরু হয়নি। মেলা প্রাঙ্গণে বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ যে আলোর ব্যবস্থা করেছে তাও ঝুঁকিপূর্ণ।
সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, গত বছর বর্ষবরণ উৎসব ঘিরে টিএসসি এলাকায় সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো হয়েছিল। সেখানে কয়েকজন নারীর ওপর যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটে। তবে সিসিটিভি ক্যামেরার মান ভালো না হওয়ায় জড়িতদের স্পষ্ট ছবি পাওয়া যায়নি। তাদের শনাক্ত করতে না পারায় পুলিশ ওই ঘটনায় দায়ের করা মামলায় আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়। চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার পর পুলিশ সম্প্রতি কামাল নামে এক সন্দেহভাজনকে আটক করে। এ ছাড়া গত বছর বইমেলা থেকে ফেরার পথে লেখক অভিজিৎ রায়কে হত্যার পর আশপাশের এলাকার সিসিটিভির ফুটেজ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তেমন কোনো তথ্য বের করতে পারেনি পুলিশ। নিশ্চিদ্র নিরাপত্তায় শুধু 'লোক দেখানো' ক্যামেরা লাগানো নয়_ এর মান ভালো হওয়া জরুরি।
জানা গেছে_ পুলিশ, র্যাবসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থা সমন্বিতভাবে বইমেলায় নিরাপত্তায় নিয়োজিত রয়েছে। পুলিশ ও র্যাবের তিনটি কন্ট্রোল রুম, ৯টি ওয়াচ টাওয়ার ও আড়াই শতাধিক সিসিটিভি ক্যামেরায় এ নিরাপত্তা কার্যক্রম সমন্বয় করা হবে। এবার বইমেলায় প্রবেশ ও বের হওয়ার পথগুলো আলাদা করা হয়েছে। পুরো বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ছাড়াও দোয়েল চত্বর থেকে শাহবাগ পর্যন্ত ৬টি করে ক্রস ফুট প্যাট্রোল (পায়ে হেঁটে টহল) টিম রয়েছে। এ ছাড়া মেলা ঘিরে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে।