সারা বছরই আকাঙ্খায় থাকি বইমেলা কখন আসবে: প্রধানমন্ত্রী

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এখানে আসতে আমার খুব ভালো লাগে। তবে এখন অনেক নিয়মে বন্দি থাকতে হয়। আবার কবে বইমেলায় আগের মতো ঘুরে বেড়াতে পারবো! মুক্ত হয়ে বইমেলায় ঘুরে বেড়ানোর প্রত্যাশায় থাকলাম। সারাবছরই আকাঙ্খা নিয়ে বসে থাকি বইমেলা কখন আসবে। ফেব্রুয়ারি আমাদের প্রেরণা দেয়। প্রতিবাদের ভাষা শেখায় এই মাস। বিজয়ের পথ দেখায় এই মাস।
বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অমর একুশে বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সোমবার বিকেলে তিনি এসব কথা বলেন।
শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের কবি-লেখকদের কাছে অনুরোধ তৃণমূল গণমানুষের জীবন-সংগ্রাম সাহিত্যকর্মে ফুটিয়ে তুলুন। দেশের সকল নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীর ভাষা-সংরক্ষণ ও বিকাশে আপনাদের সবাইকে আরও মনোযোগী হওয়ার অনুরোধ জানাই।’
তিনি আরও বলেন, প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বাংলা একাডেমি আমাদের সবার অত্যন্ত প্রিয় ও পবিত্র অঙ্গন। ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমির একুশের অনুষ্ঠান উদ্বোধন করতে এসে এই প্রাঙ্গণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- ‘আমাদের হাতে যেদিন ক্ষমতা আসবে, সেদিন থেকেই দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হবে। বাংলা ভাষার পণ্ডিতেরা পরিভাষা তৈরি করবেন, তারপরে বাংলা ভাষা চালু হবে, সে হবে না’।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তার এই দূরদর্শী বক্তব্য সেদিন সবাইকে উদ্বেলিত করেছিল স্বাধীনতার স্বপ্নে। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালে জাতীয় সাহিত্য সম্মেলন উদ্বোধন করতে এসে এ বাংলা একাডেমি অঙ্গনেই বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- ‘আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতি যেন শুধু শহরের পাকা দালানেই আবদ্ধ না হয়ে থাকে, বাংলাদেশের গ্রাম-গ্রামান্তরে কোটি কোটি মানুষের প্রাণের স্পন্দনও যেন তাতে প্রতিফলিত হয়। বঙ্গবন্ধুর দর্শনে আমরা যেমন রাষ্ট্রপরিচালনা-ভাবনার কেন্দ্রে রেখেছি সাধারণ মানুষের সার্বিক মুক্তির বিষয়টি, তেমনি বাংলা একাডেমির সার্বিক উন্নয়নেও আমরা বিশেষ মনোযোগ প্রদান করেছি।
শেখ হাসিনা বলেন, এ গ্রন্থমেলাকে কেন্দ্র করে দেশের নানাপ্রান্তের মানুষ এমনকি বহির্বিশ্বে বসবাসরত বাঙালিদের বিপুল সমাগম ঘটে। এই মেলা এখন পরিণত হয়েছে বৃহত্তর বাঙালির মিলনমেলায়। মননগত দিকের পাশাপাশি এর অর্থনৈতিক দিকও গুরুত্বপূর্ণ। গ্রন্থ বিপণন ও বাণিজ্যের মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতি সমৃদ্ধ হয়। সেই সঙ্গে গ্রন্থমেলা উপলক্ষে বাংলা একাডেমি আয়োজিত মাসব্যাপী সেমিনার ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সৃষ্টি করে নবতর চাঞ্চল্য।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি মনে করি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্থাপিত বিজয়ের অনির্বাণ আলোকস্তম্ভের মতই অমর একুশে গ্রন্থমেলা আমাদের মনকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিয়ে বিশ্বের দরবারে এ ভাষার গৌরব ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আমি নিজেও জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ অধিবেশনে নিয়মিত বাংলায় ভাষণ দিয়ে আসছি। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর রফিকুল ইসলাম, আবদুস সালামের মত প্রবাসী বাঙালিদের প্রচেষ্টায় এবং আওয়ামী লীগ সরকারের আন্তরিক উদ্যোগে ২১ ফেব্রুয়ারি ইউনেস্কো কর্তৃক ‘আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি পায়।’ এ সময় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার নেপথ্য-তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত প্রয়াত রফিকুল ইসলাম এবং সাবেক শিক্ষামন্ত্রী প্রয়াত এএসএইচকে সাদেককে স্মরণ করেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি প্রতিবছর গ্রন্থমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাংলা সাহিত্যের অনুবাদের ওপর জোর দিয়ে আসছি। এ বছর বাংলা একাডেমি থেকে মীর মশাররফ হোসেনের অমর উপন্যাস ‘বিষাদসিন্ধু’র ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। আমি আমাদের ধ্রুপদী ও সাম্প্রতিক সাহিত্যের সুনির্বাচিত সম্ভার বিশ্বপাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে আরও ব্যাপকভিত্তিক ও মানসম্পন্ন অনুবাদের আহ্বান জানাই।
তিনি বলেন, বাঙালি জাতি কোনোদিন মাথা নত করেনি। আন্দোলন-সংগ্রাম করে আর বুকের রক্ত দিয়ে বাঙালি যুগে যুগে তার ন্যায্য দাবি আদায় করেছে। এরই মহত্তম প্রকাশ ঘটেছিল ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি। ২১ ফেব্রুয়ারির আঘাত শুধু আন্দোলনকারীদের উপরই ছিল না, এটা ছিল বাংলা ভাষা এবং বাঙালি জাতিসত্তার উপর আঘাত। ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়ে শিক্ষা আন্দোলন, ছয়-দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের ঐতিহাসিক নির্বাচন ও একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ভাষা আন্দোলনের ফসল হিসেবেই তৎকালীন যুক্তফ্রণ্ট সরকারের ২১ দফার ১৬ নম্বর দফার বাস্তবায়ন হিসেবে ১৯৫৫ সালের ৩ ডিসেম্বর গড়ে ওঠে বাঙালি জাতিসত্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষের বাতিঘর-বাংলা একাডেমি। গত ডিসেম্বরে বাংলা একাডেমি তার প্রতিষ্ঠার ষাট বছর পূর্তি উৎসব উদযাপন করেছে। এ বছরই বঙ্গবন্ধু উত্থাপিত ঐতিহাসিক ছয়-দফার পঞ্চাশ বছর অর্থাৎ সুবর্ণজয়ন্তী। যে ছয়-দফা ছিল প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধুর এক দফা অর্থাৎ স্বাধীনতা ঘোষণার প্রথম ধাপ। আমি জেনে অত্যন্ত আনন্দিত যে, বাংলা একাডেমি এবারের একুশের মাসব্যাপী আলোচনায় ছয়-দফাকে একটি আলোচ্য বিষয় হিসেবে নির্ধারণ করেছে।
তিনি বলেন, গত কয়েক বছর ধরে একুশে গ্রন্থমেলার মঞ্চে দেশের বাইরের বিদেশি লেখক-পণ্ডিতদেরও সমাগম হচ্ছে। তাদের উপস্থিতির মধ্য দিয়ে বাংলার সমৃদ্ধ ভাষা-সাহিত্যের বার্তা যেমন বহির্বিশ্বে পৌঁছে যাবে, তেমনি বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির আলোয় আমরা নিজেদের সমৃদ্ধ করতে সক্ষম হব। আজ বঙ্গবন্ধুর একটি জীবনীগ্রন্থ দিয়ে বাংলা একাডেমির ব্রেইল প্রকাশনার শুভযাত্রা হলো। যে মানুষটি বাংলার সকল শ্রেণীর মানুষের মুক্তির জন্য তার জীবন উৎসর্গ করেছেন, আমরা তারই প্রদর্শিত পথে দেশের সুবিধাবঞ্চিত শারীরিক প্রতিবন্ধী ভাইবোনদের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দৃষ্টিপ্রতিবন্দ্বী ভাইবোনেরা যেন বাংলা ভাষা-সাহিত্য এবং বাঙালির গৌরবময় ইতিহাসগাথা তাদের ভাষায় সহজে বুঝতে ও পড়তে পারে, সেজন্য বাংলা একাডেমির এই ব্রেইল প্রকাশনা বিশেষ ভূমিকা রাখবে। আমি আশা করি, এই প্রকাশনাধারা অব্যাহত থাকবে এবং পর্যায়ক্রমে আমাদের আরও গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থাবলীর ব্রেইল সংস্করণ প্রকাশিত হবে।’
তিনি বলেন, সারাবিশ্বে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেছে। কিন্তু আমাদের সাহসী ও সময়োপযোগী পদক্ষেপের ফলে সব ধরনের সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের মূলোৎপাটন করা হয়েছে। বিভিন্নস্তরের স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহ শক্তিশালী হয়েছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব কাটিয়ে আমরা ধারাবাহিকভাবে ঈর্ষণীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করে চলেছি। সামাজিক-অর্থনৈতিক সকল ক্ষেত্রে টেকসই ও মানবিক উন্নয়নে বাংলাদেশের বিপুল অগ্রগতি এখন আর শুধু আমাদের বক্তব্য নয় বরং বিশ্বের নামকরা অর্থনীতিবিদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরাও এই স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হচ্ছেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ২০২০ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী এবং ২০২১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। এ সময়ের মধ্যে আমরা ক্ষুধা-দারিদ্র্য-অশিক্ষা-ধর্মান্ধতা-সাম্প্রদায়িকতা-জঙ্গিবাদ-শোষণ-বৈষম্য দূর করে একটি উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে চাই। ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র রচনায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়, যখন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায়। আওয়ামী লীগ সরকার গঠিত হওয়ার পর একুশে ফেব্রুয়ারি সত্যিকারভাবে মর্যাদা পায় এবং শহীদ দিবস হিসেবে একুশে ফেব্রুয়ারিকে ঘোষণা দেওয়া হয়। শহীদ মিনার নির্মাণের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়, অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয় এবং তখনই শহীদ মিনার নির্মাণের কাজ শুরু হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, যখন একজন বিদেশি আমাদের বাংলা ভাষায় কথা বলে তখন গর্বে আমাদের বুক ভরে যায়। তাই যেসব বিদেশি একুশে বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন তাদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।
শেখ হাসিনা বলেন, মূলত পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই শাসকগোষ্ঠী উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য উঠেপড়ে লাগে। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দিন আইন পরিষদে ঘোষণা দেন যে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নেবে। তার এই ঘোষণার বিরুদ্ধে ছাত্রলীগসহ গোটা ছাত্রসমাজ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের পরিকল্পনা গ্রহণ করে।
এর আগে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার-২০১৫ তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ড. শামসুজ্জামান খান, প্রকাশকদের পক্ষে অন্যপ্রকাশের প্রধান নির্বাহী মাজহারুল ইসলাম। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার।