English Version
আপডেট : ৩০ জানুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০

যে কারণে সুন্দরবনে কমছে গাছের সংখ্যা

নিজস্ব প্রতিবেদক
যে কারণে সুন্দরবনে কমছে গাছের সংখ্যা

জোয়ার-অরণ্য সুন্দরবন। নানা প্রজাতির গাছই বিশ্বের সর্ববৃহৎ এ ম্যানগ্রোভ বনের সৌন্দর্য। দুর্যোগে উপকূলীয় অঞ্চল রক্ষার ঢালও এসব গাছ। কিন্তু গত পাঁচ দশকে বনটিতে হেক্টরপ্রতি গাছের সংখ্যা কমে অর্ধেকে নেমে এসেছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ২০২০ সাল নাগাদ তা আরো কমে এক-তৃতীয়াংশে নেমে আসবে। মূলত পানি ও মাটিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ার কারণে সুন্দরবনে গাছের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কমছে। সেসঙ্গে কমছে গাছের উচ্চতাও। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ বন বিভাগের এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে।

‘বাংলাদেশ সুন্দরবনস: প্রেজেন্ট স্ট্যাটাস অব দি এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড বায়োটা’ শীর্ষক ওই গবেষণায় বলা হয়েছে, সুন্দরবনে ১৯৫৯ সালে প্রতি হেক্টরে ২৯৬টি গাছ ছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গাছের সংখ্যা কমতে থাকে। ১৯৮৩ সালে হেক্টরপ্রতি গাছের সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ১৮০তে। ১৯৯৬ সালে তা আরো কমে হয় ১৪৪টি। এভাবে চলতে থাকলে ২০২০ সালের মধ্যে গাছের সংখ্যা নেমে আসবে হেক্টরপ্রতি ১০৯টিতে।

১৯৫৯ সালে প্রতি হেক্টরে সুন্দরবনের প্রধান অর্থকরী গাছ সুন্দরীর সংখ্যা ছিল ২১১। কিন্তু তা ১৯৮৩ সালে ১২৫ ও ১৯৯৬ সালে ১০৬তে নেমে আসে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, ২০২০ সালে হেক্টরপ্রতি সুন্দরী গাছের সংখ্যা নেমে আসবে ৮০তে।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে গাছের সংখ্যা কমেনি বলে দাবি করেন পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। তিনি বলেন, ‘সুন্দরবন আগের চেয়ে ভালো অবস্থায় আছে। সেখানে গাছের সংখ্যা কমেনি।’

এদিকে ২০১১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অন্য এক গবেষণায়ও একই রকম পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা হয়। তাতে বলা হয়, ১৯৮৯ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত সুন্দরবনে সুন্দরী গাছের সংখ্যা কমেছে ২৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ। ১৯৮৯ সালে সুন্দরবনের ২৩ হাজার হেক্টর এলাকায় সুন্দরী গাছ ছিল। ২০০০ সালে তা কমে ১৯ হাজার ৩০৮ হেক্টরে নেমে আসে। পরের এক দশকে অবস্থার আরো অবনতি হয়। ২০১০ সালে সুন্দরবনের মাত্র ১৬ হাজার ৪০০ হেক্টর এলাকায় সুন্দরী গাছ দেখতে পাওয়া যায়।

সংখ্যার পাশাপাশি কমেছে সুন্দরবনের গাছের উচ্চতাও। বনের তিনটি জোনের মধ্যে গাছের উচ্চতা ওলিগোহেলাইন জোনে ১৫-২০ মিটার, মেসোহেলাইন জোনে ১০-১৫ মিটার ও পলিহেলাইন জোনে ৩-৫ মিটার। ওলিগোহেলাইন জোনে সুন্দরী গাছের বার্ষিক বৃদ্ধি দশমিক ১৩৩ সেন্টিমিটার। তবে মেসোহেলাইন জোনে তা দশমিক ১০২ ও পলিহেলাইন জোনে দশমিক শূন্য ৬২ সেন্টিমিটার। সুন্দরবনের পশ্চিম-দক্ষিণ অংশে পলিহেলাইন জোনে লবণাক্ততা সবচেয়ে বেশি এবং মাঝখানের মেসোহেলাইন জোনে তা তুলনামূলক কম। আর পূর্ব পাশের ওলিগোহেলাইন অঞ্চলে লবণাক্ততা সবচেয়ে কম। দেখা যাচ্ছে, যে অঞ্চলে লবণাক্ততা বেশি, সে অঞ্চলে গাছ জন্মাচ্ছে কম। বৃদ্ধিও হচ্ছে কম।

সুন্দরবনের এ গবেষণায় যুক্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুল আজিজ বলেন, মাটিতে লবণাক্ততা বেশি হলে বীজের অঙ্কুরোদ্গম হয় না। ফারাক্কা বাঁধের কারণে সুন্দরবনের পানিপ্রবাহ কমেছে। এতে মূলত মাটির লবণাক্ততা বাড়ছে। গাছের সংখ্যাও কমে যাচ্ছে। এছাড়া যেকোনো চাপে গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়।

গাছের সংখ্যা কমে যাওয়া ও বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়ার জন্য লবণাক্ততাকে দায়ী করা হয়েছে গবেষণায়। এতে বলা হয়েছে, ১৯৭৫ সালে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের পর শুষ্ক মৌসুমে সুন্দরবন প্রতি সেকেন্ডে শূন্য থেকে ১৭০ ঘনমিটার পলিযুক্ত মিঠা পানি গ্রহণ করেছে। সেখানে লবণাক্ততার পরিমাণ ঠিক রাখার জন্য কমপক্ষে ১৯৪ দশমিক ৪ ঘনমিটার পানিপ্রবাহ প্রয়োজন। কম পানিপ্রবাহ থাকায় সাগরের লবণাক্ত পানি বনের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। যদিও ১ শতাংশের বেশি লবণাক্ততা থাকলে সুন্দরী গাছের বেঁচে থাকা কঠিন।

সুন্দরবন এলাকায় সময় ও স্থানভেদে পানির লবণাক্ততার পরিমাণ ২ থেকে ২৭ পিপিএম (পার্টস পার মিলিয়ন)। গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে লবণাক্ততা ১ থেকে ৫ পিপিএমের মধ্যে থাকলেও শীতকালে তা বেড়ে যায়। তখন পশুর নদীর হিরণ পয়েন্টে সর্বোচ্চ লবণাক্ততা থাকে ২৭ দশমিক ৩ পিপিএম। একই নদীর মংলা পয়েন্টে লবণাক্ততা ২০ দশমিক ৭ পিপিএম। রূপসা নদীর খুলনা পয়েন্টে ১৬ দশমিক ৮ পিপিএম, শিবসা নদীর নালিয়ান পয়েন্টে ২৩ দশমিক ৪ এবং বলেশ্বর নদীর চরদোয়ানি পয়েন্টে সর্বোচ্চ ৮ দশমিক ৫ পিপিএম লবণাক্ততা থাকে।

গবেষণায় আরো বলা হয়েছে, গঙ্গা নদীর মিঠা পানি গড়াই হয়ে পশুর ও শিবসা নদীর মাধ্যমে সুন্দরবনে প্রবাহিত হয়। ফারাক্কা বাঁধের পর পানিপ্রবাহ কমে গেছে। ফলে সুন্দরবনের প্রবেশমুখে গড়াই নদীতে চর পড়ছে। এখন নদীটির ৮০ শতাংশই চর। একদিকে মিঠা পানির প্রবাহ কমছে, অন্যদিকে বঙ্গোপসাগরের লবণাক্ত পানি প্রবেশ করছে। মিঠা পানির প্রবাহ কম থাকায় লবণাক্ত পানি ঢুকে পড়ছে বনের মধ্যে। এ কারণে ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ বেঁচে থাকতে পারছে না। এর সঙ্গে সাইক্লোন ও বিভিন্ন কারণে বনভূমি ভেঙে বহু ছোট নদী তৈরি হয়েছে।

স্যাটেলাইট ইমেজের তথ্য ব্যবহার করে দেখানো হয়, সুন্দরবন থেকে গত ৪০ বছরে ৬৬-১২৭ বর্গকিলোমিটার বনভূমি বিলীন হয়ে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী ১০০ বছরে পুরো বনটিই বিলীন হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে গবেষণায়। এ বিষয়ে অধ্যাপক ড. আবদুল আজিজ বলেন, নিজেদেরই পানির প্রয়োজন হয় বলে সুন্দরবন রক্ষায় ভারত পানি দেবে না। এখন যা করতে হবে তা হলো, গড়াই নদীর ১০ কিলোমিটার ভাটিতে খনন করে পানির রিজার্ভার নির্মাণ। আর মাটিগুলো অন্য জায়গায় না নিয়ে বর্ষা মৌসুমে পানির প্রবাহের সঙ্গে সুন্দরবনের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে হবে। এতে লবণাক্ততা কমবে আর পলি পেয়ে পুনরায় আগের অবস্থায় ফিরে আসবে বন।

এদিকে সুন্দরবনের ১৪ কিলোমিটার উত্তরে নির্মিতব্য রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ভবিষ্যতে সবচেয়ে বড় হুমকি হিসেবে দেখানো হয়েছে। এ কেন্দ্রে প্রতিদিন ১৩ হাজার টন কয়লা পোড়ানো প্রয়োজন হবে। এতে আট মিলিয়ন টন কার্বন ডাই-অক্সাইড, দশমিক ৭৫ টন ফ্লাই অ্যাশ ও দশমিক দুই মিলিয়ন টন বটম অ্যাশ তৈরি হবে। প্রতি ঘণ্টায় পাঁচ হাজার ঘনমিটার গরম পানি মিশবে নদীর সঙ্গে। গবেষণায় এ প্রকল্প বাতিল করার কথা বলা হয়েছে। তবে বর্তমানে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের আরো একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য মাটি ভরাটের কাজ অনুমোদন দিয়েছে একনেক।