নতুন মাত্রায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি

জিএসপি সুবিধা, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মতো ইস্যুতে বাংলাদেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে সাময়িক শীতলতা আসলেও এখন উষ্ণতা ফিরছে। আবার ভারতের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক ও রাশিয়ার সঙ্গে পরমাণু প্রকল্পসহ নানা চুক্তিতে তৎপর বাংলাদেশ। অথচ রুশ মিত্র ইরান,সিরিয়ার ‘চরম শত্রু’ বলে বিবেচিত সৌদি আরবের সঙ্গেও সুসম্পর্ক বজায় রাখার ধারাটি আরও পাকাপোক্ত হচ্ছে। সৌদি নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটে বাংলাদেশের নাম এবং জোটে থাকার বিষয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি তারই প্রমাণ। তবে বাংলাদেশের বহুমুখী এই অবস্থানকে সময়ের প্রয়োজন,নিজ স্বার্থ রক্ষা এবং সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও প্রতি বৈরীতা নয় এমন পররাষ্ট্রনীতির বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা।
জটিল এসব সমীকরণে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ঠিক কী অবস্থায় আছে, সে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন সাবেক কূটনীতিক হুমায়ুন কবির এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক আমেনা মহসিন।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক বলেই মনে করেন সাবেক কূটনীতিক হুমায়ুন কবির। তিনি বলেন, জিএসপি, নির্বাচন নিয়ে তৎপরতাকে আপাত দৃষ্টিতে টানাপোড়েন মনে হতে পারে। আসলে কূটনৈতিক সম্পর্ক বহুমাত্রিক। রাজনৈতিক কারণে জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে। তখন দ্বন্দ্ব দৃশ্যমানও হয়। তবে মৌলিক সম্পর্কের বেলায় এটা দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে না, অন্তত বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের বেলায় সেটা কখনো দেখা যায়নি।
বাংলা-মার্কিন সম্পর্কের ধরণ তুলে ধরে সাবেক এই কূটনীতিক আরও বলেন,যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের মূল সম্পর্কের জায়গাটি আসলে বাণিজ্যিক। এক্ষেত্রে গত কয়েক বছরে রপ্তানি বেড়েছে। জিএসপি সুবিধা না থাকা সত্ত্বেও রপ্তানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। জিএসপি নিয়েও আলোচনা হয়েছে, বিশেষ করে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা বা টিকফা চুক্তির বেলাতেও বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে।
এছাড়াও দীর্ঘদিনে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কয়েকটি ক্ষেত্রে কাঠামোবদ্ধ সম্পর্কও রয়েছে। দু’দেশের মধ্যে পার্টনারশিপ ডায়লগ হচ্ছে, টিকফা হয়েছে আর নিরাপত্তা-সন্ত্রাসবাদ দমন ইস্যুতে বাংলাদেশের অবস্থান মার্কিন নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। নিরাপত্তা প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করছে’।
দক্ষিণ এশিয় দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ-রাশিয়ার সম্পর্ক তুঙ্গে হলেও সৌদি আরবের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে তা নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে না বলে মনে করেন হুমায়ুন কবির। এক্ষেত্রেও বাংলাদেশ-সৌদির সম্পর্ককে দ্বিপাক্ষিক স্বার্থসংশ্লিষ্টতার ভিত্তিতে বিচার করতে চান তিনি। তার মতে,মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরব যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় মিত্র, এতোদিন সবাই এটা জানলেও অবস্থা কিন্তু পাল্টানোর আভাস পাওয়া যাচ্ছে। তেলের জন্য এখন আর আগের মতো সৌদি নির্ভর নয় যুক্তরাষ্ট্র। তাই কৌশল পাল্টাচ্ছে তেলকেন্দ্রীক বাণিজ্যের দেশ সৌদি আরব। তারা ঝুঁকছে চীন, রাশিয়ার দিকে। বিষয়টি আসলে পুরোপুরি বাণিজ্যিক।
শ্রমবাজার এবং ধর্মীয় দৃষ্টিকোণের দিক দিয়ে বাংলাদেশ-সৌদির মধ্যে সম্পর্ক আগে থেকে ভালো। একক দেশ হিসেবে শুধু সৌদি আরব থেকে দেশে বিপুল পরিমাণ রেমিটেন্স আসছে। আর সামরিক জোটে যোগ দিয়ে সে সম্পর্ক নতুন মাত্রা পাচ্ছে। যদিও এই জোটের রূপরেখা চূড়ান্ত হয়নি। তবে হলে বোঝা যাবে এখান থেকে বাংলাদেশ কিভাবে উপকার পাবে। দেশে জঙ্গিবাদের মদদ ও অর্থের যোগান কারা দিচ্ছে এমন তথ্যও আদায়ের সুযোগ নিতে পারে বাংলাদেশ। অর্থাৎ এখানেও সম্পর্কটা কিন্তু বহুমাত্রিক। তবে কিছু উপাদানের ওঠা-নামা তো চলবেই।
সাবেক কূটনীতিকের দেখানো পররাষ্ট্রনীতির বর্তমান চিত্রের সঙ্গে মিলে যায় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক আমেনা মহসিনের কথা।দেশের পররাষ্ট্রনীতি খুব জটিল অবস্থানে, তা মনে করেন না এই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশারদ। তিনি বলেন, প্রতিটি দেশ নিজের স্বার্থে কাজ করে। আর এখন তো আর স্নায়ুযুদ্ধের সময় নয়। এখন বলয় থেকে বেরিয়ে এসে নিজের ভালোটা বুঝে নিচ্ছে রাষ্ট্রগুলো। রাজনৈতিক মৌলিক বিষয়গুলো বাধা না হলে দেশগুলো বাণিজ্যিক সম্পর্কে জড়াচ্ছে। বাংলাদেশও বিশ্বায়নের এই সময়ে সেটাই করছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে কোনো সংকট নেই বলে মনে করেন আমেনা মহসিন। তার মতে,একই সঙ্গে ভারত-রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি অন্যদিকে সৌদি জোটে যোগদান আসলে সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব কারও প্রতি বৈরীতা নয় এই পররাষ্ট্রনীতিরই বহিঃপ্রকাশ।