জোট ভাঙ্গার কৌশলে জড়িয়ে পড়ছে রাজনীতি

দল ভাঙ্গার রাজনীতি নতুন নয়। এক দল ছেড়ে অন্য দলে চলে যাওয়াও নতুন কিছু নয়। রাজনীতির প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে কিংবা দল বা জোটের মধ্যে বিরোধ তৈরি করতে কখনো কখনো ক্ষমতাসীনরাই নেপথ্যে এই দল ভাঙ্গার রাজনীতির কলকাঠি পরিচালনা করেন। দল ভাঙ্গা কিংবা নেতাদের এক দল ছেড়ে অন্য দলে চলে যাওয়া অধিকাংশ সময় সাধারণ কর্মীরা ভালো চোখে দেখে না। এতে আদর্শের মধ্যে অনেক বিরোধ তৈরি হয়। কিন্তু ক্ষমতার মোহে কিংবা পরিস্থিতির প্রয়োজনে তারপরও অনেক নেতা একদল ছেড়ে অন্য দলে চলে যান। আবার জোট হওয়ার পর থেকে এক পক্ষ আরেক পক্ষের জোট ভেঙ্গে ওই পক্ষকে দুর্বল করতে চায়। বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ২০ দলীয় জোট ও ১৪ দলীয় জোট রাজনীতির মূল চালিকা শক্তি। ক্ষমতায় রয়েছে ১৪ দলীয় জোট।
দেখা যায় যখন-ই ২০ দলীয় জোট সরকারের জন্য মাথা ব্যথার কারণ হয়ে উঠে, তখনই বিভিন্ন রাজনৈতিক কৌশলে ২০ দলীয় জোটে ভাঙ্গনের চেষ্টা চালানো হয়। এরই প্রক্রিয়ায় ব্যারিস্টার নাজমূল হুদা বিএনপি থেকে বেরিয়ে নতুন দল গঠন করেছেন। আবার আসল বিএনপি নামেও আরেকটি দল হয়েছে। মূল বিএনপি ভেঙ্গে এসব ছোট ছোট দল কখনো বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি। পারবেও না। কারণ, সাধারণ মানুষ এসব দলের প্রতি সমর্থন জানায় না।
সম্প্রতি শেষ হয়েছে দলীয় প্রতিকে পৌর নির্বাচন। পৌর নির্বাচনে বিএনপি খুবই খারাপ ফলাফল করেছে। এক পর্যায়ে বিএনপির পক্ষ থেকে পৌর নির্বাচনকে প্রত্যাখ্যান করা হয়। এরপর বর্তমান সরকারের মেয়াদের দ্বিতীয় বছর পূর্ণ করার দিন অর্থাৎ ৫ জানুয়ারি বহুদিন পর প্রকাশ্যে বিএনপি সমাবেশ করতে পারলো। অনেকে অবশ্য বলেন, পৌর নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পর থেকে বিএনপি তথা ২০ দলীয় ঐক্যজোটের নেতা-কর্মীরা অন্তরাল ছেড়ে প্রকাশ্যে আসার সুযোগ পান। ফলে এখন আবার জোট ভাঙ্গার প্রক্রিয়া দেখে কোন কোন রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলছেন, বিএনপি তথা ২০ দলীয় জোট যাতে ফের ঘুরে দাঁড়াতে না পারে সে কারণেই জোট ভাঙ্গার আলামত।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন আর আদর্শের বালাই নেই। মূলত কে কোনদিকে কি কি সুবিধা পাবেন তার উপরই নির্ভর করে জোট ভাঙ্গার প্রক্রিয়া। হিসেবে না মিললে ফের ফিরে আসেন নিজ নিজ জোটে এটাও নতুন কিছু নয়। বৃহস্পতিবার দিন জুড়েই আলোচিত ছিলো ইসলামী ঐক্যজোটের ২০ দলীয় জোট ছেড়ে দেওয়ার বিষয়টি। যা সন্ধ্যার দিকে আরও জটিল হয়ে উঠে। ইসলামী ঐক্যজোট ভেঙ্গে যাওয়ার-ই উপক্রম হয়েছে শেষ পর্যন্ত। পত্রিকার ভাষ্য মতে, ইসলামী ঐক্যজোটের ২০-দলীয় জোট ছাড়ার ঘোষণার মধ্য দিয়ে কেবল বিএনপির নেতৃত্বাধীন বহুদলীয় এ জোটই নয়, শরিক ওই দলটির মধ্যেও ভাঙন ধরেছে। মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ইসলামী ঐক্যজোটেরই একটি অংশ সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছে তারা ২০-দলীয় জোটেই আছে।
রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে বৃহস্পতিবার সকালে ইসলামী ঐক্যজোটের ত্রি-বার্ষিক সম্মেলনে দলের চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ নেজামী ঘোষণা দেন, ‘২০ দলের সঙ্গে আর আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই।’এর কয়েক ঘণ্টা পর বিকেলে গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে করেন আবদুর রকিব নামে ইসলামী ঐক্যজোটের এক নেতা। তিনি নিজেকে ওই ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান দাবি করে বলেন, ইসলামী ঐক্যজোট বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের সঙ্গেই আছে।
আবদুর রকিব ইসলামী ঐক্যজোটের বিদায়ী কমিটির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। সংবাদ সম্মেলনে তিনি দাবি করেন, গত বুধবার পুরানা পল্টনে দলের কার্যালয়ে বিকেল ৩ থেকে ৯টা পর্যন্ত মজলিশে শুরার বৈঠক হয়। সেখানে সিদ্ধান্ত হয় ইসলামী ঐক্যজোট ২০-দলীয় জোটে থাকবে। কিন্তু বৃহস্পতিবার সকালে দলের ত্রি-বার্ষিক সম্মেলনে আকস্মিকভাবে জোট ছাড়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। আবদুর রকিব দাবি করেন, দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তিনি এখন দলের চেয়ারম্যান। আজ নেজামীসহ যারা জোট ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছেন আগামী ১৫ দিনের মধ্যে মজলিশে শুরার বৈঠক করে তাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে এবং পূর্ণাঙ্গ কমিটি করা হবে। তিনি দাবি করেন, দেশের ওলামা মাশায়েখ সবাই তাদের সঙ্গে আছেন। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর একটি ইসলামী ঐক্যজোট। গত মঙ্গলবার (৫ জানুয়ারি) রাজধানী ঢাকায় অনুষ্ঠিত বিএনপির সমাবেশে জোটের শরিক দলগুলোর উপস্থিতি দেখা যায়নি। এমনকি জোটের এই সম্মেলনে বিএনপির কাউকে দাওয়াত করা হয়নি।
অন্যদিকে ২০ দলীয় জোট ভাঙ্গার বিষয়টি নিয়ে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ অভিযোগ করেছেন, নানা প্রলোভন সরকার দেখিয়ে ২০-দলীয় জোট ভাঙ্গার চেষ্টা করছে। বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে ফেলানি দিবস উপলক্ষে অল কমিউনিটি ফোরাম আয়োজিত আলোচনায় তিনি এ অভিযোগ করেন।
আন্দোলনের জন্য বিএনপিই যথেষ্ট বলে জানান হাফিজ উদ্দিন। একই সঙ্গে গণতন্ত্রকে সঠিক পথে এগিয়ে নিতে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আলোচনার প্রস্তাব মেনে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। এদিকে বৃহস্পতিবার ইঞ্জিনয়ার্স ইনস্টিটিউশনে দলের ত্রিবার্ষিক সম্মেলনে ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ নেজামী ২০-দলীয় জোট থেকে বের হয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন।
জোট ভাঙ্গার বিতর্কে এভাবেই জড়িয়ে যেতে থাকেন নেতারা। জড়িয়ে পড়ে রাজনীতিও। সেই সঙ্গে মানুষের মুখে মুখে এই বিষয়গুলো দেশব্যাপি সর্বাধিক আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। ইসলামী ঐক্যজোট ২০ দলীয় জোট ছেড়েছে, এমন খবরের পর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, আজ শুধু জোট নয়, বিএনপির অনেক নেতাই সন্ত্রাসী ও অনৈতিক কাজের জন্য দল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চিন্তাভাবনা করছেন। বৃহস্পতিবার বিকেলে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর ধানমণ্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে যৌথসভা-পরবর্তী এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। আবদুল লতিফ নেজামীর নেতৃত্বাধীন ইসলামী ঐক্যজোটের ২০ দলীয় জোট ছাড়ার ঘোষণার বিষয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে মাহবুব-উল আলম বলেন, ইসলামী ঐক্যজোট কী কারণে জোট ছেড়েছে, সেটা এই মুহূর্তে আমরা সঠিকভাবে বলতে পারি না। তবে সাম্প্রতিককালে আমাদের দৃষ্টিতে এসেছে খালেদা জিয়া পেট্রলবোমা দিয়ে জনজীবন বিপর্যস্ত করেছেন। যেটা আমাদের পবিত্র ধর্ম কখনো সমর্থন করে না। আজকে সেই কারণেই যদি কোনো দল এই অধর্মের কাজ করার জন্য জোট থেকে বেরিয়ে যায়, তাহলে সেটা স্বাভাবিক এবং যৌক্তিক। তিনি বলেন, আজ শুধু জোট নয়, বিএনপির অনেক নেতাই সন্ত্রাসী ও অনৈতিক কাজের জন্য দল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চিন্তাভাবনা করছেন। ইতিমধ্যে একজন বেরিয়ে গেছেন এবং অনেকে বেরিয়ে যাওয়ার অপেক্ষায় আছেন।
মাহবুব-উল আলম বলেন, সেই জন্য বলি- বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রে বিশ্বাসী বলেই সব সময় চায় একটি শক্তিশালী বিরোধী দল থাকুক। গণতন্ত্রের জন্য এটা অপরিহার্য। কিন্তু বিএনপির বর্তমান নেতৃত্বের প্রতি নেতাকর্মীদের যে অনীহা সৃষ্টি হয়েছে, আস্থাহীনতা সৃষ্টি হয়েছে, এর ভবিষ্যৎ একমাত্র তারাই ভালো বলতে পারে।
দল বা জোট ভাঙ্গার বিতর্কে আগামী কয়েক দিন নেতারা আরও বহু ধরণের কথা বলবেন, সেটাই ধারণা করা হচ্ছে। আবার যে জোট ভাঙ্গছে, তারাও চেষ্টা করবে প্রতিপক্ষ জোটে ভাঙ্গন সৃষ্টি করতে। সেটা হলে জোট ভাঙ্গার বিতর্ক আরও বেশ কিছুদিন ধরে চলছে এমনটাই ধারণা করা যায়।