সংলাপ প্রস্তাবে নতুন মাত্রায় রাজনীতি

আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির ৫ জানুয়ারির সমাবেশ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করলেও শেষ পর্যন্ত সংঘাত এড়িয়েই শেষ হয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশ ও ডিএমপি নির্ধারণ করে দেওয়া স্থানেই উভয়দল প্রায় সব ধরণের নিয়ম মেনেই সমাবেশ শেষ করে। সমাবেশ শেষে উভয় দলের নেতা-কর্মীরা নিজ নিজ আবাস স্থলে ফিরে যাওয়ার পথেও কোন প্রকার অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটার খবর পাওয়া যায়নি। এ নিয়ে নগরবাসী এবং দেশের মানুষের মধ্যে আপাত এক ধরণের স্বস্তি ফিরেছে। বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার প্রায় ৩৮ মিনিট জুড়ে দেওয়া বক্তৃতার কোথায় বিশেষ কোন কথা বলেননি। সবই গতানুগতিক। উল্টো অনেককেই বলতে দেখা গেছে, বেগম জিয়ার প্রকাশ ভঙ্গিতেও বিশেষ কোন তেজ পরিলক্ষিত হয়নি। তার মধ্যেও খালেদা জিয়া নতুন করে যে আলাপ-আলোচনার কথা বলেছেন তা ‘টক অফ দ্যা কান্ট্রি’ হয়েছে। সাধারণেরা বলছেন, খালেদা জিয়া নতুন করে আলাপ-আলোচনার প্রস্তাব দিয়ে মূলত পেছনের ভুলগুলোকে অতিক্রম করতে চাইছেন।
২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার প্রায় একক যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বেগম জিয়া, তার সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসছেন তিনি। সরে আসছেন সংঘাতের পথ থেকেও। গত সপ্তাহে হয়ে যাওয়া পৌর-নির্বাচনের আগে খালেদা জিয়া তার গুলশানের অফিসে বলেছিলেন, আর পথের আন্দোলন নয়, নির্বাচনের মাধ্যমেই সরকারকে ঘায়েল করতে হবে। বেগম জিয়ার এই মন্তব্যকে অনেকে এভাবে বিশ্লেষণ করেছেন- গত বছর অবিবেচকের মতো খালেদা জিয়া টানা তিন মাস যে অবরোধ-হরতাল চালিয়ে গেছেন, তাতে মানুষের সমর্থন যেমন মেলেনি, উল্টো প্রচুর প্রাণহাণী এবং সম্পদের ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতি হয়েছে দল এবং নেতা-কর্মীদেরও। খালেদা জিয়া হয়তো সেসব অনুধাবন করে দলকে নতুন করে সাজাতে, নেতা-কর্মীদের নতুন করে উজ্জীবিত করে তুলতে নতুন এই রাজনৈতিক কৌশন গ্রহণ করেছেন। পৌর নির্বাচনের ফলাফল যা-ই হোক না, নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় অন্তত বহুকাল পর নেতা-কর্মীরা অন্তরাল গুঁচিয়ে মাঠে বের হয়ে এসেছেন।
এসবি হয়তো রাজনীতির নতুন কৌশল। ফলে ৫ জানুয়ারি নয়াপল্টনের সমাবেশে দেওয়া খালেদা জিয়ার বক্তব্যে নতুনত্ব খুঁজে পেয়েছেন। সরকারের যে কোন প্রকার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে শুধুমাত্র আন্দোলন-সংগ্রাম করে সরকার পতনের কৌশল থেকে বের না হয়ে বিএনপি তথা ২০ দলীয় জোটের আর কোনও উপায় ও নেই। কারণ, সরকার পতনের যে আন্দোলন ২০ দল করে আসছে, সে আন্দোলনে সরকার আরও শক্তভীতের উপর দাঁড়িয়েছে। এমন অবস্থায় খালেদা জিয়ার নতুন ভাষ্য, আলাপ-আলোচনা কতটুকু ফলপ্রসু হবে তা সময়-ই বলে দেবে।
তার আগে দেখা যাক বেগম জিয়া ৫ জানুয়ারির সমাবেশে কি ভাষ্য রেখেছিলেন। ভাষ্য হলো- অবিলম্বে আলোচনার মাধ্যমে নতুন জাতীয় নির্বাচনের পরিবেশ ও গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তিনি বলেন, আমরা চাই আলাপ-আলোচনা করে সমাধানের একটি পথ বের করতে, নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ ও গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে। এ জন্য একসঙ্গে কাজ করতে চাই। যেহেতু তারা জোর করে ক্ষমতায় বসে আছে, এ দায়িত্ব তাদের।’ দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তিতে মঙ্গলবার বিকেলে রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে আয়োজিত সমাবেশে খালেদা জিয়া এ আহ্বান জানান। তিনি আরও বলেন, কারও বিরুদ্ধে আমাদের রাগ-ক্ষোভ-দুঃখ নেই’, ‘আসুন, সংলাপ করে, আলোচনা করে সমাধানের পথ বের করি, গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনি। এতে কারও ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। আপনারা ভালো থাকেন, ভদ্র থাকেন, তাহলে আপনাদের বিরুদ্ধে আমাদেরও ক্ষোভ থাকবে না। যা করেছেন, ভুল করেছেন, মনে মনে তা স্বীকার করে নেন।’
এই হলো খালেদা জিয়ার মূল কথা। কিন্তু সরকার কি খালেদার এসব কথা শুনতে এখন প্রস্তুত? গত দুই বছরে সরকার যে অবস্থানে চলে এসেছে, তাতে খালেদা জিয়ার এমন প্রস্তাব কতোটা গুরুত্ব বহণ করে? এখানে স্মরণ রাখা খুব জরুরি। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুবার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। একবার টেলিফোন করে, আরেকবার খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর পর গুলশানে বেগম জিয়ার বাড়িতে গিয়ে সহানুভূতি দেখানোর উদ্যোগ। কিন্তু একরোখা মনোভাবের কারণে প্রধানমন্ত্রীর এই দুই উদ্যোগ সফল হয়নি। এরপর বিভিন্ন সমাবেশে প্রধানমন্ত্রীতে যখন কোনও সাংবাদিক নতুন করে সংলাপের উদ্যোগের কথা বলেছেন প্রত্যেক বার-ই প্রধানমন্ত্রী অতীত এই দুই উদাহরণ টেনেছেন। এমন অবস্থায় বেগম জিয়ার নতুন করে আলাপ-আলোচনার কথা কতো গ্রহণযোগ্য হবে তা সময় বলবে। তবে খালেদা জিয়া আলাপ-আলোচনার উদ্যোগ নেওয়ার বিষয়টি সরকারের উপরই চাপিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন- যেহেতু তারা জোর করে ক্ষমতায় বসে আছে, এ দায়িত্ব তাদের।
প্রাথমিক পর্যায়ে খালেদা জিয়ার এই প্রস্তাবের কিছু প্রতিক্রিয়া এরই মধ্যে পাওয়া যেতে শুরু করেছে। আজ বুধবার ধানমণ্ডিতে আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর কার্যালয়ে এক যৌথসভা শেষে আয়োজন করা সংবাদ সম্মেলনে দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন- আন্দোলনের নামে আগুনে পুড়িয়ে মানুষ হত্যার জন্য জাতির কাছে ক্ষমা না চাওয়া পর্যন্ত খালেদা জিয়ার আলোচনার কথা বলা উচিত নয়।এর মাধ্যমে কি বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আলোচনার প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছে আওয়ামী লীগ? সেটা কিন্তু মনে হয়নি। হানিফের ভাষায় ‘আগে’ কথাটি রয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের করা এক প্রশ্নের জবাবে মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, ‘উনি আজকে সংলাপের কথা বলছেন, ন্যায়ের কথা বলেন, শান্তির কথা বলেন। এই যে ১৪৭ জন মানুষকে হত্যা করা হলো, তাদের পরিবারের কাছে ক্ষমা চান নাই। জাতির কাছে তার ক্ষমা চাওয়া উচিত ছিল। এ জন্য খালেদা জিয়া কোনো সংকট বা সংলাপের কথা বলার আগে এই ধরনের বর্বরোচিত নৃশংসতার জন্য তার আগে ক্ষমা চাওয়া উচিত এবং এরপর তিনি অন্য কিছুর জন্য আবেদন করতে পারেন। বাংলাদেশের মানুষ কোনো খুনি-হত্যাকারীর সঙ্গে বৈঠক মনে হয় পছন্দ করে না।’ খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ্য করে হানিফ বলেন, ‘উনি সরকারের সঙ্গে আলোচনা বসতে চান। অন্যদিকে যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে নিয়ে তাদের রক্ষার জন্য দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র করবেন। তার সঙ্গে আর কি সংলাপ হতে পারে?’
এর আগে বুধবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এক অবস্থান কর্মসূচিতে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন- বিএনপি চেয়ারপরসন বেগম খালেদা জিয়া মুক্তিযুদ্ধকে কটাক্ষ করে দেয়া বক্তব্যের জন্য দোষী স্বীকার করে ক্ষমা না চাওয়া পর্যন্ত কোনো আলোচনা হতে পারে না।
নির্বাচন নিয়ে খালেদা জিয়ার আলোচনার আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেন আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, কার সঙ্গে আলোচনা হবে? যিনি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেন তার সঙ্গে কোনো আলোচনা হতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধকে কটাক্ষ করে দেয়া বক্তব্যের জন্য দোষ স্বীকার করে ক্ষমা না চাওয়া পর্যন্ত কোনো আলোচনা হতে পারে না। তিনি বলেন, খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে বিভিন্ন বাণীতে মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা ৩০ লাখ বললেও এখন পাকিস্তানিদের সঙ্গে গলা মেলাতে স্ববিরোধী বক্তব্য দিচ্ছেন। গত ২১ ডিসেম্বর রাজধানীতে এক আলোচনা সভায় অংশ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন
অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম বলেছেন, বিএনপির আক্রোশ দেশের গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে। তারা দেশের উন্নয়ন চায়না। তিনি বলেন, তাদের আন্দোলন বাংলাদেশের যা কিছু ভাল তার বিরুদ্ধে। দেশের জনগণ ভাল থাকবে শিক্ষা ও চিকিৎসায় উন্নত হবে, সমৃদ্ধদেশ গড়ে উঠবে এটা তাদের গাত্রদাহ। বুধবার রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমিতে আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা উপ-পরিষদ আয়োজিত তথ্য চিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে এ কথা বলেন তিনি।
এইচটি ইমাম বলেন, পৌরসভা নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিয়েছে, তাদের দলের প্রার্থীরাও বিজয়ী হয়েছে। তারপরও তারা পৈশাচিক আচরণ করছে। কেন করছে আমরা ভেবে পাইনা।বিএনপি দেশের উন্নয়ন চায় না দাবি করে তিনি বলেন, দেশ যখন সবক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছে, সমগ্র বিশ্ব যখন বাংলাদেশের প্রসংসা করছে। তখন তারা দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। আসলে বিএনপির আক্রোশ গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে। যা কিছু ভাল তার বিরুদ্ধে।
এসব বক্তব্যের কোথাও আলাপ-আলোচনার পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়নি। কিছু শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে। রাজনীতির কৌশল-ই এমন। একদিকে সরকার দাবি করছে, বর্তমান সরকারের গ্রহণযোগ্যতা বিশ্ব মেনে নিয়েছে। সমর্থন করছে। কিন্তু বিএনপি তথা ২০ দলীয় জোট বলছে, বর্তমান সরকারের গ্রহণযোগ্যতা কোথাও নেই। বর্তমান সরকার নৈতিকভাবে দুর্বল, ইত্যাদি। রাজনীতির এসব করণ-কৌশল থাকবে। কিন্তু রাজনীতিতে শেষ বলেও কোন কথা নেই। ৫ জানুয়ারির পরিবেশ অর্থাৎ প্রধান দুই দল সংঘাত এড়িয়ে সমাবেশ শেষ করে সাধারণ মানুষের মধ্যে যে স্বস্তি দিতে পেরেছে, দ্রুতই উভয়ের মধ্যে সংলাপের বিষয়েও নিশ্চয়ই কোন পথ বের হয়ে যাবে।