English Version
আপডেট : ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ১৩:৪৯

ঊর্ধ্বমুখী শেয়ারবাজারে বাড়ছে ঝুঁকি

অনলাইন ডেস্ক
ঊর্ধ্বমুখী শেয়ারবাজারে বাড়ছে ঝুঁকি

দীর্ঘ মন্দা কাটিয়ে ঊর্ধ্বমুখী ধারায় ফিরেছে দেশের শেয়ারবাজার। প্রায় দুই বছর ধরে ইতিবাচক ধারায় রয়েছে বাজার। ফলে ২০১০ সালের মহাধসের পর শেয়ারবাজারে যে সঙ্কট দেখা দিয়েছিল তা আস্তে আস্তে অনেকটাই কেটে গেছে। তবে গত কয়েক মাস ধরে মৌলভিত্তি সম্পন্ন কোম্পানির পাশাপাশি বেশকিছু দুর্বল কোম্পানির শেয়ারের দামও পাল্লা দিয়ে বেড়েছে।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) থেকে দুর্বল কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়ায় বিনিয়োগকারীদের বারবার সতর্ক করা হলেও কাজে আসছে না। অতিমুনাফার লোভে গুজবের ভিত্তিতে বিনিয়োগ করছেন বিনিয়োগকারীরা। বিনিয়োগকারীদের এমন আচরণ ও দুর্বল কোম্পানির দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ায় শেয়ারবাজারে নতুন করে এক ধরনের ঝুঁকি সৃষ্টি হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

তারা বলছেন, ২০১০ সালের ধসের ধাক্কা কাটিয়ে উঠেছে শেয়ারবাজার। মহাধসের পর খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলা ২০১৫ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে বাজার ইতিবাচক ধারায় ফেরার ইঙ্গিত দিতে থাকে। গত দুই বছরের বেশি সময় ধরে বাজারে অস্বাভাবিক উত্থান অথবা বড় ধরনের পতন দেখা যায়নি। এ সময়ের মধ্যে একদিকে যেমন কোনো রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল না, অন্যদিকে আমানত ও সরকারি সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমে গেছে। এর সঙ্গে শেয়ারবাজারের প্রতি সরকারের ওপর মহলের ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে। ফলে বাজারের ওপর প্রায় সব শ্রেণির বিনিয়োগকারীর কিছুটা হলেও আস্থা ফিরে আসে।

অস্বাভাবিক উত্থান-পতন না থাকায় বিনিয়োগকারীদের লোকসান দিয়ে বাজার ছাড়তে হচ্ছে- এমন খবর এখন আর শোনা যাচ্ছে না। বাজারে প্রাতিষ্ঠানিক ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে। সেই সঙ্গে নতুন করে বিনিয়োগে ফিরছেন ব্যক্তি বিনিয়োগকারীরা। ফলে লেনদেনেও গতি ফিরেছে। বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীদের বিচক্ষণতার সঙ্গে বিনিয়োগ করতে হবে।

অতিমুনাফার লোভে হুজুগে বা গুজবে বিনিয়োগ করা ঠিক হবে না। কারণ গুজবের ভিত্তিতে বিনিয়োগ করে হয়তো কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীরা লাভের মুখ দেখতে পারেন। কিন্তু এমন বিনিয়োগে ঝুঁকির পরিমাণই বেশি। ২০১০ সালে শেয়ারবাজারে যে উল্লম্ফন ও মহাধসের ঘটনা ঘটে এর মূল কারণ ছিল গুজবের ভিত্তিতে বিনিয়োগ। সে সময় শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করলেই রাতারাতি বড় লোক হওয়া যাচ্ছে, ঢাকাজুড়েই এমন গুজব ছড়িয়ে পড়ে।

ওই গুজবে কান দিয়ে অল্পদিনে মোটা অঙ্কের টাকার মালিক বনে যেতে শিক্ষার্থী, দিনমজুর এমনকি একাধিক মুচিও (যিনি জুতা সেলাইয়ের কাজ করেন) শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেন। শেয়ারবাজার সম্পর্কে বিন্দুমাত্র জ্ঞান না থাকলেও গুজবের ভিত্তিতে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের বিনিয়োগে অস্বাভাবিকভাবে ফুলে ফেঁপে ওঠে শেয়ারবাজার। ২০১০ সালে ৫ ডিসেম্বর প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাধারণ সূচক পৌঁছে আট হাজার ৯১৮ পয়েন্টে। লেনদেন হয় তিন হাজার ২৪৯ কোটি টাকা। আর বাজার মূলধন দাঁড়ায় তিন লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা।

ফলে পরিণতি যা হওয়ার ঘটেও তাই। শুরু হয় কলঙ্কের অধ্যায়। শেয়ারবাজারে দেখা দেয় মহাধস। মূল ধস শুরু হয় ৮ ডিসেম্বর থেকে। ওইদিন লেনদেনের প্রথম সোয়া এক ঘণ্টার মধ্যে ডিএসইতে সাধারণ সূচকের ৫৪৪ পয়েন্ট পতন হয়। আর দিন শেষে সূচকের পতন হয় ১৩৪ পয়েন্ট। এরপর পতন যেন নিয়তি হয়ে ওঠে শেয়ারবাজারের। চারদিন পর ১২ ডিসেম্বর সূচকের পতন ঘটে ২৮৫ পয়েন্টে। এটি ছিল ১৯৯৬ সালের পর শেয়ারবাজারে সবচেয়ে বড় পতন। তবে রেকর্ড যেন সৃষ্টি হয় রেকর্ড ভাঙার জন্য, এর প্রমাণ পাওয়া যায় পরের সপ্তাহে ১৯ ডিসেম্বর। এদিন বাজারে নামে মহাধস। সূচকের পতন ঘটে ৫৫১ পয়েন্ট।

শেয়ারবাজারের এমন পতনে প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে ২১ দফার বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়। ঢেলে সাজানো হয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। পতন থেকে শেয়ারবাজারের উত্তরণের জন্য সরকারপ্রধান পদক্ষেপ নেয় ২০১১ সালে। সে সময় নিয়ন্ত্রক সংস্থার চেয়ারম্যান জিয়াউল হক খোন্দকারসহ সব সদস্যকে বিদায় করে দিয়ে নতুন করে কমিশন পুনর্গঠন করা হয়। ওই বছরের মে মাসে নিয়ন্ত্রক সংস্থার চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দেয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক ড. এম খায়রুল হোসেনকে।

এরপর একে একে চারটি বছর পার হলেও ২০১৫ সাল পর্যন্ত শেয়ারবাজার ছিল মূলত পতনের বৃত্তে। সরকারের উপর মহলের নানা উদ্যোগে ধসের ধাক্কা কাটিয়ে ২০১৫ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে বাজার ঘুরে দাঁড়াতে থাকে। তবে নতুন করে বাজারের মূল উত্থান শুরু হয় গত বছরের জুলাই থেকে। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে বাড়তে থাকে লেনদেনের পরিমাণ। জুলাই মাসের পর থেকে ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে লেনদেনের গতি।

জুলাই মাসে ডিএসইতে প্রতি কার্যদিবসে গড় লেনদেন ছিল ৩৮৬ কোটি টাকা, ধারাবাহিকভাবে বেড়ে ডিসেম্বরে ৯০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। লেনদেন বৃদ্ধির এ ধারা চলতি বছরও অব্যাহত থাকে। বছরের প্রথম তিন মাসে গড় লেনদেন হাজার কোটি টাকার ঘরে চলে আসে। মাঝে এপ্রিল ও মে মাসে লেনদেনের গতি কিছুটা কমলেও ঊর্ধ্বমুখী থাকে শেয়ারবাজার। আর শেষ তিন মাসের ৫৯ কার্যদিবসের মধ্যে ২৯ দিনই লেনদেন হয়েছে হাজার কোটি টাকার ওপর। জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর- এ তিন মাসে প্রতি কার্যদিবসে গড় লেনদেন হয়েছে প্রায় হাজার কোটি টাকা করে।

তবে এ সময় লেনদেনের থেকে বড় উত্থান ঘটেছে মূল্য সূচকে। ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচক ডিএসইএক্স পাঁচ হাজার ৮৩ পয়েন্ট দিয়ে চলতি বছর শুরু করে, যা ধারাবাহিকভাবে বেড়ে গত ১৭ সেপ্টেম্বর ছয় হাজার ২৪০ পয়েন্টে পৌঁছে যায়। অর্থাৎ চলতি বছর সূচকটি বাড়ে এক হাজার ১৫৭ পয়েন্ট। এর মধ্যে শেষ তিন মাসেই বাড়ে ৫৮৬ পয়েন্ট। মূল্য সূচকের এমন উত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে ব্যাংকিং খাত। তবে এ সময় ভালো কোম্পানির পাশাপাশি দুর্বল মৌলভিত্তির কোম্পানির দামও বেশ বেড়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান সময়ে শেয়ারবাজার একটি ক্রিটিকাল অবস্থায় রয়েছে। এ বাজারে ভালোভাবে তথ্য বিচার-বিশ্লেষণ করে বিনিয়োগ করতে পারলে ভালো মুনাফা পাওয়া যাবে। তবে বিনিয়োগকারীদের সব সময় মনে রাখতে হবে বাজারের উত্থানের সঙ্গে যেমন মুনাফার সম্ভাবনা বাড়বে, তেমনি পাল্লা দিয়ে বাড়বে ঝুঁকির পরিমাণ। তাই বিনিয়োগকারীদের অতীতের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে বিনিয়োগ করতে হবে। অতিমুনাফা লোভের প্রবণতা পরিহার করতে হবে।

বিএসইসি’র সাবেক চেয়ারম্যান মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, শেয়ারবাজারে ঝুঁকি থাকবেই। যাদের শেয়ারবাজার সম্পর্কে জ্ঞান নেই তাদের এ বাজারে না আসাই ভালো। বিনিয়োগকারীদের অবশ্যই কোম্পানির সার্বিক অবস্থা ভালোভাবে বিশ্লেষণ করে বিনিয়োগ করতে হবে। অতিমুনাফার লোভে গুজবের ভিত্তিতে দুর্বল কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা উচিত নয়।

বিএসইসি’র সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, বর্তমানে শেয়ারবাজার বেশ ইতিবাচক। বেশকিছু দিন ধরে বাজারে বড় ধরনের উত্থান-পতন নেই। এটা পজেটিভ দিক। তবে কেউ যদি দুর্বল কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে নিজের বিনিয়োগ ঝুঁকির মধ্যে ফেলে, তাহলে তার দায় ওই বিনিয়োগকারীকেই নিতে হবে। বিনিয়োগকারীদের দায়িত্ব নিয়েই বাজারে বিনিয়োগ করতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, কোম্পানির শেয়ারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে ডিএসই বা সিএসই থেকে যে সতর্কতা জারি করা হয়, সে বিষয়ে বিনিয়োগকারীরা খুব একটা পাত্তা দেন না। এটা উচিত নয়। কোন কোম্পানির শেয়ারের দাম কেন বাড়ছে সে তথ্য অবশ্যই বিনিয়োগকারীদের ভালোভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. বখতিয়ার হাসান বলেন, শেয়ারবাজার যখন পতনের ধাক্কা থেকে বেরিয়ে ঊর্ধ্বমুখী ধারায় ফেরে, তখন একটা মহল বাজার থেকে নানা রকম সুযোগ-সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করে। বাজারে বিভিন্ন গুজব ছড়িয়ে দিয়ে তারা ফায়দা হাসিলে সচেষ্ট থাকে। বর্তমান বাজারেও এ তৎপরতা চলছে। এতে বাজারে এক ধরনের ঝুঁকির সৃষ্টি হচ্ছে। এ অবস্থায় বিনিয়োগকারীদের সতর্কভাবে বিনিয়োগ করতে হবে।

তিনি বলেন, প্রায় দুই বছর ধরে বাজার ঊর্ধ্বমুখী ধারায় রয়েছে। আর সাম্প্রতিক সময়ে মোটামুটি বড় ধরনের উত্থানই ঘটেছে। এতে বেশকিছু দুর্বল কোম্পানির শেয়ারের দামও অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। এসব কোম্পানি সম্পর্কে বিনিয়োগকারীদের সচেতন থাকতে হবে। পাশাপাশি এ ঊর্ধ্বমুখী ধারা ধরে রাখতে বাজারে নতুন নতুন কোম্পানি তালিকাভুক্তির দিকে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে নজর দিতে হবে। এক্ষেত্রে অবশ্যই ভালো ভালো কোম্পানি যাতে বাজারে তালিকাভুক্ত হয় বিএসইসিকে সেই উদ্যোগ নিতে হবে।

তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা বাড়লে বিনিয়োগকারীদের বিকল্প বিনিয়োগের ক্ষেত্র বড় হবে। এতে গুটিকয়েক কোম্পানিতে বিনিয়োগ কেন্দ্রীভূত হবে না, যার ইতিবাচক প্রভাব সার্বিক বাজারে পড়বে।