English Version
আপডেট : ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০৬:৪২

মানসিক চাপ সৃষ্টিকারী শহরের তালিকায় ঢাকার নাম

অনলাইন ডেস্ক
মানসিক চাপ সৃষ্টিকারী শহরের তালিকায় ঢাকার নাম

*১০-এ ১ পেয়ে জার্মানির স্টুটগার্ট শহরটি কম চাপ সৃষ্টিকারী শহরের মর্যাদা পেয়েছে। অর্থাৎ শান্তিতে বসবাস করার জন্য এ শহরটি সেরা। *যানজটের কারণে রাজধানী ঢাকায় প্রতিদিন ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। *এই শহরের মানুষের হার অনুপাতে সবুজ জায়গা কিংবা ওপেন স্পেসের পরিমাণ ৯০ ভাগের ১ ভাগ।

নিত্যদিনের ঢাকা শহর এমনই। যানজট থেকে মনে পড়ে চাপ একদিন রাস্তায় কোনো যানজট পেলেন না। নির্ধারিত সময়ে অফিসে পৌঁছালেন। বৃষ্টি হলো কোথাও একটু পানিও জমল না। ঝকঝকে-তকতকে একটা ছিমছাম শহর। বিশুদ্ধ বাতাস মনকে ফুরফুরে করে দিল যেন। ঢাকাবাসীর কাছে এই দৃশ্য স্বপ্নের আরেক নাম। বাস্তবতা জানা যাক তরুণ পেশাজীবী সৈয়দা নাফিসা প্রধানের কাছে। খুব সকালে অফিসের জন্য বাড়ি থেকে বের হন তিনি। ঠিক সময়ে অফিসে পৌঁছানোর তাড়া আর কাজের চাপ মিলিয়ে তাঁর মেজাজের পারদ আজকাল শুধু ওঠানামা করে। সৈয়দা নাফিসার মতো নাগরিক অস্থিরতায় ভুগছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সাবরিনা রহমান। ‘বৃষ্টি হলে রাস্তায় চলাফেরা করা যায় না, জলাবদ্ধতায় পথে পা রাখাই মুশকিল, যেখানে-সেখানে নাগরিকদের আবর্জনা ফেলার মতো বদভ্যাসগুলো আমাদের বেঁচে থাকাটাকেই অস্বস্তিকর করে ফেলছে। এতে মনে চাপ পড়ে। জীবনে চাপ পড়ে।’ বলেন সাবরিনা। সাবরিনা আর সৈয়দা নাফিসা যে শহরে থাকেন, সেই ঢাকা এখন সবচেয়ে বেশি মানসিক চাপ সৃষ্টিকারী শহরের তালিকায় সপ্তম।

রাজধানী ঢাকা বিভিন্ন শহরের মধ্যে বেশি মানসিক চাপ সৃষ্টিকারী ১০ শহরের মধ্যে সপ্তম। যুক্তরাজ্যের ড্রাই-ক্লিনিং ও লন্ড্রি সার্ভিস জিপজেটের তথ্য বিশ্লেষণ করে সিএনএন ট্রাভেল সম্প্রতি এই তালিকা প্রকাশ করেছে। বিশ্বের ৫০০ শহরের বিভিন্ন প্রকারের তথ্য বিশ্লেষণ করে জিপজেট ১৫০টি শহরের তালিকা তৈরি করে।

যেসব সূচকের কারণে চাপ কম ও বেশি

শহরের জনঘনত্ব, পরিবহনব্যবস্থা, যানজটের মাত্রা, পরিবেশদূষণ, সবুজের সমারোহ, নাগরিকদের আর্থিক অবস্থান, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা, কর্মঘণ্টার প্রয়োগসহ বিভিন্ন সূচকের ওপর ভিত্তি করে এই তালিকা তৈরি করে জিপজেট। এই প্রভাবকগুলো শহরের নাগরিকদের ওপর কতখানি চাপ তৈরি করছে, তা জানা যাচ্ছে এই তালিকা থেকে। জিপজেটের প্রধান ফ্লোরিয়ান ফার্বার বলেন, ‘আমরা যে নগরে বাস করছি, তার ওপর নির্ভর করছে আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য কতটুকু ভালো, কতটুকু খারাপ। যে শহরগুলো কম চাপগ্রস্ত, সেগুলোর জীবনধারা বেশি চাপে জর্জরিত শহরগুলোর চেয়ে বেশ আলাদা। সেই ভিন্নতাই খুঁজে বের করার জন্য এই তালিকা।’

চার প্রভাবক

শহর, দূষণ, অর্থ ও মানুষ—এই চার ভাগে ১৭টি মাত্রায় ১০ নম্বরের মধ্যে পয়েন্ট দিয়ে তালিকা তৈরি করা হয়েছে। ঢাকার পরই আছে করাচি, নয়াদিল্লি ও ম্যানিলা। গড় হিসাবে ১৫০ শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান ১৪৪তম। ১০-এ ১ পেয়ে জার্মানির স্টুটগার্ট শহরটি কম চাপ সৃষ্টিকারী শহরের মর্যাদা পেয়েছে। অর্থাৎ শান্তিতে বসবাস করার জন্য এ শহরটি সেরা। এরপর আছে লুক্সেমবার্গ, হ্যানোভার, বার্ন ও মিউনিখ।

নানা চাপের নানান কারণ আমাদের মনের ওপর চারপাশের পরিবেশের বেশ গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব থাকে। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকো সোশ্যাল কাউন্সেলর কাজী রুমানা হক বলেন, ‘আপনি কোথায় থাকেন, কীভাবে থাকেন, তার ওপর নির্ভর করে প্রতিদিনের ভালো থাকা। যান্ত্রিক এই শহরের মানুষদের মননে আসলে ঢাকা শহরই প্রতিফলিত হচ্ছে।’ বিভিন্ন কারণে এই শহর আমাদের ওপর চাপ তৈরি করে চলেছে, সেই কারণগুলোর বেশির ভাগই কিন্তু মনুষ্যসৃষ্ট।

বাসস্থান অব্যবস্থাপনা ঢাকা কেন চাপ সৃষ্টিকারী শহর, তা নিয়ে কথা বলেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাধারণ সম্পাদক নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক আকতার মাহমুদ। এই শহরের মানুষেরা বাসস্থান অব্যবস্থাপনা, যানজটের রেষারেষি আর অনিশ্চিত সামাজিক নিরাপত্তার কারণেই অস্বস্তিতে পড়ে। ঢাকার ৩০ শতাংশ মানুষ বস্তি, ভাড়া বাসাসহ ভীষণভাবে অস্থায়ী বাসস্থানে বসবাস করে। আকতার মাহমুদ বলেন, ‘এ ধরনের বাসস্থান মনের ওপর চাপ তৈরি করে। শুধু তা-ই নয়, বাসস্থানের সঙ্গে নেই পরিপূর্ণ বিনোদনের সুযোগ। কাজ শেষে এই শহরে মানুষ কোথায় বিনোদনের সুযোগ পাচ্ছে?’

যানজট ও গণপরিবহন বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনযায়ী যানজটের কারণে রাজধানী ঢাকায় প্রতিদিন ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। তরুণ স্থপতি তাসবীর শাতিল যানজটকে এই শহরের মানুষের অসহিষ্ণু আচরণের বড় একটি কারণ হিসেবে মনে করেন। তিনি বলেন, ‘উন্নত শহরগুলোতে ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারকে নিরুৎসাহিত করা হয়। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে “হেঁটে চলা”–কে গুরুত্ব দিয়ে নানান পরিকল্পনা নেওয়া হয়। আমাদের এই শহরে ফুটপাত কতটা পথচারী-উপযোগী, তা তো আমরা নিজেরাই জানি।’ তরুণ এই স্থপতি পথচারীবান্ধব ফুটপাতের অভাবকে নাগরিকদের জন্য বড় একটি সমস্যা বলে মনে করেন। ফুটপাতগুলোতে বিশ্রামের জন্য বেঞ্চ কিংবা চেয়ারের ব্যবস্থা আধুনিক শহরগুলোর খুব সাধারণ বৈশিষ্ট্য বলে তিনি জানান। সিএনএন ট্রাভেলের তালিকায় গণপরিবহন সেবার মাত্রায় ঢাকার পর শিকাগো ও নিউইয়র্ক শহরের অবস্থান। তাসবীর শাতিল বলেন, উন্নত শহরগুলোতে গণপরিবহনে চাপ থাকলেও সেখানে গণপরিবহন ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী—তাই নাগরিকদের হেনস্তা কম হয়।

অবসর ও নাগরিক বিনোদনের অভাব অফিস শেষে কিংবা ছুটির দিনগুলোতে ঘোরাঘুরির সুযোগ নেই আমাদের। ঢাকায় খোলা জায়গা নেই, যে কারণে পরিবার নিয়ে ঘোরাঘুরি কিংবা নিজেকে নিয়ে একা সময় কাটানোর জায়গা আমাদের নেই। শব্দদূষণও মেজাজ খিটখিটে করে দেয়। আকতার মাহমুদ বলেন, ‘এই শহরের মানুষের হার অনুপাতে সবুজ জায়গা কিংবা ওপেন স্পেসের পরিমাণ ৯০ ভাগের ১ ভাগ।’

অনিরাপত্তা ও ঝুঁকি তরুণ পেশাজীবী নাবিরা রহমান পড়াশোনা ও কাজের জন্য পৃথিবীর প্রায় ছয়টি শহরে থেকেছেন। তিনি বলেন, ‘এই শহরের বড় একটি সমস্যা হচ্ছে নিরাপত্তাহীনতা। নারীদের ক্ষেত্রে তা আরও প্রকট। উন্নত শহরগুলোতে মানুষের ব্যক্তিত্ব ও ব্যক্তিস্বাধীনতাকে সম্মান দেওয়া হয়। আমাদের এখানে তেমন মনোভাব কম।’ এ ব্যাপারে কাজী রুমানা হক বলেন, নারী-পুরুষ সবাই সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকিতে পড়লে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বেই মনে ও সমাজে।

চাপমুক্তির কি উপায় নেই? শহর সুস্থ থাকলে, ভালো থাকলে তার নাগরিকেরাও মননে রঙিন হবে, মন প্রফুল্ল থাকবে, বলেন কাজী রুমানা হক। পরিবারের যত সদস্য তত গাড়ি, এমন ভাবনা না কমালে এই শহরের যানজট নিয়ে ভোগান্তি কমবে না। সামগ্রিক পরিকল্পনা নিয়ে নগরকে গোছাতে হবে—সর্বাপেক্ষা মানসিক চাপ সৃষ্টিকারী না হয়ে উন্নত শহরের দিকে এগিয়ে যেতে চাই আমরা। না হলে এ চাপ থেকে মুক্তি মিলবে না।