English Version
আপডেট : ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০৮:১১

হাতিরঝিল যেন 'মৃত্যুকূপ'!

অনলাইন ডেস্ক
হাতিরঝিল যেন 'মৃত্যুকূপ'!

রাজধানীর দৃষ্টিনন্দন পর্যটন স্পট হাতিরঝিলে বেপরোয়া ও উল্টো পথে গাড়ি চলাচলের কারণে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। এখানে গভীর রাতে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহতের পাশাপাশি আত্মহত্যার একাধিক ঘটনাও আছে। ২০১৩ সালের ২ জানুয়ারি উদ্বোধনের পর হাতিরঝিলে সড়ক দুর্ঘটনায় এ পর্যন্ত অন্তত ৪০ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন কয়েকশ’। আত্মহত্যা করেছেন অন্তত ১০ জন।

 

কয়েকটি গাড়ি সড়ক থেকে ছিটকে পড়েছে লেকের পানিতে। এর মধ্যে পুলিশের ডিআইজি পদমর্যাদার একজনের একটি গাড়িও আছে। কথিত বন্দুকযুদ্ধের কয়েকটি ঘটনায় নিহত হয়েছেন অন্তত ৫ জন। তাছাড়া প্রতিদিনই কোনো না কোনো ধরনের দুর্ঘটনা ঘটছে হাতিরঝিলে। রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল, গুলশান, বাড্ডা, রামপুরা ও রমনা থানা নিয়ে গঠিত হাতিরঝিল যেন এখন ‘মৃত্যুকূপে’ পরিণত হয়েছে।

 

এখানে ছিনতাই হচ্ছে অহরহ। ওভারপাস ও ফুটওভার ব্রিজগুলোতে সন্ধ্যার পর বসছে মাদকের আসর। গোটা ঝিলে হকার প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হলেও তাদের তৎপরতা চোখে পড়ার মতো। এখানে গতির নেশায় মেতে উঠছে প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস ও মোটরসাইকেল চালকরা। গভীর রাতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে রেস প্রতিযোগিতা। এতে একদিকে যেমন গাড়ি পড়ছে ঝিলের পানিতে, অন্যদিকে ঘটছে প্রাণহানির ঘটনা।

 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হাতিরঝিলে অবৈধভাবে যাত্রীবাহী মাইক্রোবাস চলছে। এসব মাইক্রোবাসের বেশিরভাগের মালিক পুলিশ। প্রকল্পের অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ ও বাস্তবায়নে দায়িত্ব পালন করছে আর্মি ক্যাম্প। মহানগর আর্মি ক্যাম্প হাতিরঝিল ও বেগুনবাড়ি প্রকল্পের প্রকল্প কর্মকর্তা মেজর কাজী শাকিল হোসেন জানান, পাঁচটি থানা এলাকার মধ্যে হওয়ায় কোনো থানা পুলিশই হাতিরঝিলকে নিজের মনে করে না। ওভার স্পিড ও রাস্তা বেশি বাঁকা হওয়ায় দুর্ঘটনা বেশি ঘটছে।

 

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সব দুর্ঘটনার খবর আমার কাছে আসে না। তবে প্রতি মাসে ১৫-২০টি দুর্ঘটনার খবর আর্মি ক্যাম্পে আসে। এর মধ্যে ২-১টি ঘটনা হয় বড় ধরনের।’ তিনি বলেন, রাতে রেসের খেলায় মেতে উঠছে অভিজাত পরিবারের সন্তানরা। ইচ্ছা থাকলেও পুলিশ তাদের ধরতে পারে না। অবৈধ ও উল্টো পথে চলা গাড়ি ধরা সেনাবাহিনীর কাজ না। তারপরও সেনাসদস্যরা মাঝে মধ্যে এসব গাড়ি ধরে পুলিশে দিচ্ছে। গাড়ি আটকের পর জানা যায়, বেশিরভাগ অবৈধ গাড়ির মালিক পুলিশ। তাই সহজেই থানা থেকে ওইসব গাড়ি বেরিয়ে যায়। যাত্রীবাহী এসব গাড়িতেই ছিনতাইসহ নানা অপকর্ম বেশি হয়।

 

তিনি আরও জানান, হাতিরঝিলে অনেক যাত্রীবাহী মাইক্রোবাস অবৈধভাবে চলাচল করে। এ পর্যন্ত অন্তত ১০০ অবৈধ মাইক্রোবাস ধরে পুলিশে দেয়া হয়েছে। কিছুদিন পর দেখা যায়, একই গাড়ি আবারও একই রাস্তায় অবৈধভাবে চলাচল করছে। তিনি বলেন, সেনাবাহিনীর অধীন এখানে ৭৭ জন নিরাপত্তাকর্মী কাজ করছে। নানা অনিয়মের কারণে এ পর্যন্ত ২৩-২৪ জন নিরাপত্তাকর্মীকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। অনেকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছে।

 

৬ ফেব্রুয়ারি রাতে হাতিরঝিলের রামপুরা অংশের ওভারব্রিজের রেলিংয়ে হেলান দিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করছিলেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ইমতিয়াজ আলী। রাত সাড়ে ১০টার দিকে হঠাৎ তিন যুবক তাকে ঘিরে ধরে। ছুরি দেখিয়ে ম্যানিবাগ ও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিয়ে যায়। গত ২৫ জানুয়ারি গভীর রাতে সড়ক দুর্ঘটনায় আবদুল্লাহ আল মামুন (৫০) নামে এক অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য নিহত হন। ১১ জানুয়ারি দুপুরে নিহত হন আবদুল মুত্তালিব খোকন নামে এক মোটরসাইকেল আরোহী। ওইদিন আরও দুই মোটরসাইকেল আরোহী আহত হন। রেস করতে গিয়ে গত ১৩ ডিসেম্বর গভীর রাতে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ঢাকা মেট্রো-গ-২১-৮৭১৩ নম্বরের একটি প্রাইভেট কার ঝিলের পানিতে পড়ে যায়। গত ১১ সেপ্টেম্বর হাতিরঝিলে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা যান আল আমীন ইসলাম মানিক (২৬) নামে এক যুবক।

 

বুধবার বিকালে মধুবাগ ব্রিজে দাঁড়িয়ে শেরেবাংলা স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্র শাহীন, মারুফ, শিমুল ও কাওসার জানান, হাতিরঝিলে পাবলিক টয়লেট নেই। তাই দর্শনার্থীরা প্রায়ই খোলা জায়গায় প্রাকৃতিক কাজ সারেন। ওয়াটার ট্যাক্সি চালু হলেও সবাই এ সুবিধা পাচ্ছেন না। কারণ, টার্মিনাল মাত্র তিনটি। এর মধ্যে মগবাজার থেকে রামপুরা অংশে একটি টার্মিনালও নেই। তিনটি টার্মিনালই কারওয়ান বাজার থেকে মেরুল বাড্ডা অংশে। ব্রিজগুলোর পাশে বসার কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই দর্শনার্থীরা রেলিংয়ে বসে থাকেন। এতে রেলিংগুলো যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তেমনি দর্শনার্থীরাও ঝুঁকির মধ্যে পড়ছেন।

 

মঙ্গলবার রাত ১১টার দিকে হাতিরঝিলের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে অনেক তরুণ-তরুণীকে অপ্রীতিকর অবস্থায় দেখা যায়। রামপুরা প্রান্তের ব্রিজের পাশে বসে চা, সিগারেট ও পান বিক্রি করছিলেন ইকবাল হোসেন। তিনি জানান, হকার প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তিনি তিন বছর ধরে সন্ধ্যার পর এখানে বসে চা-সিগারেট বিক্রি করেন। বিনিময়ে নিরাপত্তাকর্মীদের দু-একটা সিগারেট ও পান খাওয়াতে হয়। একই ধরনের তথ্য জানিয়ে চা বিক্রেতা লুৎফর রহমান বলেন, নিরাপত্তাকর্মীরা চা-সিগারেট খেয়ে টাকা দেয় না। টাকা চাইলে এখান থেকে বের হয়ে যেতে বলে। ক্ষতি পোষাতে সাধারণ ক্রেতাদের কাছ থেকে ২-১ টাকা করে বেশি নিই।

 

ওভারপাসে পায়চারী করা ও গাড়ি থামানোতে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও মঙ্গলবার গভীর রাতে গিয়ে দেখা যায়, তরুণ-তরুণীরা স্বল্প আলোতে গাড়ি থামিয়ে গোল হয়ে বসে আছে ওভারপাসে। বোঝা যায়, তারা নেশা করছে। রাত সাড়ে ১২টার দিকে রানার গ্রুপের উল্টো দিকের ওভারব্রিজে দেখা যায়, ৭-৮ জন তরুণ মাদক সেবন করছে। গণপরিবহনের বাসও চলাচল করছে।

 

সোমবার হাতিরঝিল আর্মি ক্যাম্পের সামনে বসে কথা হয় ডিম বিক্রেতা সিয়াম, বাদাম বিক্রেতা পাভেল ও আচার বিক্রেতা ইমরানসহ কয়েকজন হকারের সঙ্গে। তারা জানান, ১৫-২০ জনের একটি গ্রুপ আগারগাঁও থেকে এখানে এসে বিভিন্ন জিনিসপত্র বিক্রি করেন। বিনিময়ে নিরাপত্তাকর্মীদের দিনে ২০-৩০ টাকা করে দেন। তবে আর্মি অফিসাররা পরিদর্শনে এলে তাদেরকে (হকার) নিরাপত্তাকর্মীরাই প্রকল্প এলাকা থেকে বের করে দেন। আচার বিক্রেতা ইমরান জানান, মহানগর ব্রিজের ওপর ও নিচে সব সময় বখাটেরা আড্ডা দেয়। তারা দিন-রাত গাঁজা খায়।

 

২০১৫ সালের ৩ জানুয়ারি থেকে এ বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত হাতিরঝিলে দায়িত্ব পালন করেন ট্রাফিক পুলিশের সহকারী কমিশনার আবু ইউসুফ। তিনি জানান, রামপুরা থেকে মগবাজার পর্যন্ত সড়কে দুর্ঘটনা বেশি ঘটছে। যেসব রুটে রেস হয় সেসব রুটে ব্লক বসিয়ে ব্যারিকেড দিয়ে গাড়ির গতি কমানো উচিত। তিনি বলেন, রাত ২টার পর এখানে ট্রাফিক থাকে না। এরই সুযোগে রেস হয়। বখাটেদের কঠোর হস্তে দমন করা না গেলে ভবিষ্যতে হাতিরঝিল আরও অনিরাপদ হয়ে পড়বে। গভীর রাতে মাদক ব্যবসায়ী ও মাদকসেবীরা হাতিরঝিলে ভিড় করে বলেও তিনি জানান।

 

ঢাকা মেট্রোপলিটন (ডিএমপি) পুলিশের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান বলেন, শুধু হাতিরঝিল নয়, রাজধানীর যে কোনো স্থানে অপরাধ তৎপরতা বন্ধে পুলিশ তৎপর আছে। অবৈধভাবে হাতিরঝিলে যেসব মাইক্রোবাস চলাচল করে সেসবের বিরুদ্ধে প্রায়ই অভিযান চালানো হয়। সেসবের মালিক পুলিশ সদস্য কিনা সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এখনও আসেনি। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।