English Version
আপডেট : ৪ জানুয়ারি, ২০১৭ ১৪:১০

কোটিপতি ব্যবসায়ী থেকে একরাতেই রাস্তার ফকির!

অনলাইন ডেস্ক
কোটিপতি ব্যবসায়ী থেকে একরাতেই রাস্তার ফকির!

 

 

রাত ৩টার দিকে মোবাইল ফোনের রিংটোন ঘুম ভাঙিয়ে দেয় ব্যবসায়ী মাহবুবুর রহমানের। অজানা আশঙ্কায় কেঁপে ওঠেন তিনি, এত রাতের ফোন মানে কি দুঃসংবাদ! আশঙ্কাই সত্যি হয়, ফোন ধরে জানতে পারেন, আগুন লেগেছে গুলশান-১ নম্বরে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) মার্কেটে। যেখানে রয়েছে তার একমাত্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। দ্রুতগতিতে মার্কেটে ছুটে আসেন, দেখেন আগুনের লেলিহান শিখায় তার আয়ের একমাত্র উৎস দোকানটি পুড়ে যাচ্ছে। ছাই হয়ে পড়ছে কয়েক কোটি টাকার মালপত্র।

 

শুধু মাহবুবুর রহমান নন, গত সোমবার গভীর রাতে অগি্নকাণ্ডের খবর পেয়ে ছুটে আসেন সেখানকার শত শত ব্যবসায়ী ও কর্মচারী। আহাজারি করতে করতে ব্যবসায়ীরা দেখেন তাদের নিঃস্ব করে ফেলছে, শত শত কর্মচারী দেখেন তাদের কর্মহীন করে দিচ্ছে দাউ দাউ অগ্নিশিখা। এত ক্ষতি কীভাবে পোষাবেন, তা ভেবে চোখেমুখে অন্ধকার দেখছেন তারা সবাই। একই আর্তনাদ তাদের সবার মুখে_ 'একদিন আগেও কোটিপতি ছিলাম। কিন্তু এক রাতের মধ্যেই ফকির হয়ে গেলাম। পথে বসে গেলাম।'

 

মাহবুবুর রহমান জানান, তার বাসা মধ্য বাড্ডার গুদারাঘাটে। তারা চার ভাই যৌথভাবে ডিএনসিসি মার্কেটের কাঁচাবাজারে ব্যবসা করেন। কাঁচাবাজারের নিচতলার  ১২, ১৩ ও ১৪ নম্বর দোকান তাদের। ১২ নম্বরের দোকানে ক্রোকারিজ, ১৩ নম্বর দোকানে কার্পেট ও ১৪ নম্বর দোকানে র‌্যাক্সিন ব্যবসা করেন তারা। এর মধ্যে দুটি দোকানের পজিশন তাদের নিজেদের কেনা, একটি ভাড়া নেওয়া।

 

তিনি আরও জানান, সোমবার রাত ৩টার দিকে মার্কেটের এক নিরাপত্তা কর্মী তাকে ফোন দিয়ে অগ্নিকাণ্ডের খবর জানান। সঙ্গে সঙ্গে তিনি ছুটে আসেন মার্কেটে। মাহবুবুর রহমান বলেন, 'তিন দোকানে প্রায় তিন কোটি টাকার মালপত্র ছিল। সবই পুড়েছে আর ভবন ধসে চাপা পড়েছে। দোকানের চিহ্নটুকুও নেই এখন। দোকানে ১০ লাখের মতো টাকাও ছিল। তাদের চার ভাইয়ের আয়ের উৎস শুধু এ ব্যবসাই। সেই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আগুনে পুড়ে যাওয়ায় নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন তারা।

 

গতকাল মঙ্গলবার ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, ডিএনসিসি মার্কেটের তিনটি অংশ। পশ্চিম দিকের অংশে (দোতলা ভবন) পাকা মার্কেট, পূর্বদিকের নিচতলায় কাঁচাবাজার ও এর দ্বিতীয়তলায় সুপার মার্কেট। দ্বিতল এ মার্কেটের তৃতীয় তলার নির্মাণ শুরু হলেও তা সম্পন্ন হয়নি। কাঁচাবাজার থেকে এ অগ্নিকাণ্ডের শুরু। কাঁচাবাজার ও সুপার মার্কেটে সব মিলিয়ে বিভিন্ন পণ্যের প্রায় চারশ' দোকান ছিল। কাঁচাবাজার ও সুপার মার্কেটের ভবন ধসে পড়ার পর পাশের পাকা মার্কেটেও আগুন ছড়িয়ে পড়ে। এ মার্কেটের দোকান সংখ্যা প্রায় আড়াইশ'। পাকা মার্কেট থেকে অনেক ব্যবসায়ী মালপত্র সরিয়ে নিতে পারলেও কাঁচাবাজার ও সুপার মার্কেটে একটি সুতাও কেউ বের করতে পারেননি।

 

কাঁচাবাজারের নিচতলায় 'ভাই ভাই স্টোর' নামে একটি মসলার দোকান ছিল সহিদুল ইসলামের। তিনি জানান, তার দোকানে বিদেশি সব মসলা বিক্রি করা হতো। প্রতিদিন বিক্রি হতো ১০/১২ লাখ টাকার মসলা। দোকানে ৫০ লাখ টাকার মালপত্র ছিল। দোকানের নিচে গোডাউনে ছিল আরও কয়েক লাখ টাকার মাল। সব পুড়েছে। গতকাল মঙ্গলবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে মার্কেটের দক্ষিণ পাশের সড়কের ফুটপাতে বসে আর্তনাদ করছিলেন তিনি। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, 'সব শেষ হয়ে গেছে। এখন আমি কী করে সংসার চালাব! কী কাজ করব! চলব কীভাবে! আগুন আমাকে পঙ্গু করে দিয়ে গেল!'

 

সুপার মার্কেটের নিচতলার দুটি দোকানের মালিক জালাল উদ্দিন। একটি সবজির দোকান, অন্যটি মুরগির। তার দুটি দোকান পুড়ে ভবনের কংক্রিটের চাপায় মিশে গেছে। তার ছেলে রাজীব আহমেদ জানান, ১৯৮২ সাল থেকে তার বাবা দোকানটিতে সবজি ও মুরগির ব্যবসা করে আসছেন। এ ব্যবসাই তাদের উপার্জনের একমাত্র পথ। আগুনে মালপত্রের পাশাপাশি তাদের ১০ লাখ টাকাও পুড়েছে। তিনি বলেন, 'সোমবার রাতে পার্টিকে (যার কাছ থেকে মালপত্র কেনে) টাকা দেওয়ার জন্য ক্যাশে টাকা রাখা হয়; কিন্তু রাতে পার্টি না আসায় টাকাগুলো ক্যাশেই রাখা ছিল।'

 

কাঁচাবাজারের ব্যবসায়ী রহিমার দুটি দোকান ছিল। ধ্বংসস্তূপের নিচে তার দোকানে আগুন জ্বলার সময় তিনি ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের বলেন, 'ওই দেখেন, আমার দোকান পুড়ে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি পানি দেন। আমার সব শেষ হয়ে যাচ্ছে।' ৪০ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে মার্কেটে ব্যবসা করছিলেন বাচ্চু আহমেদ। তিনি বলেন, 'সব কিছু পুড়ে গেছে। আমি কী করে খাব! ধারদেনা শোধ করব কীভাবে!' রিয়াদ ক্রোকারিজ স্টোরের কর্মচারী মামুন বলেন, 'আমার মালিক রিয়াদ প্রায় ১৭ বছর ধরে ব্যবসা করছেন। রাতেই খবর পেয়ে ছুটে আসি আমরা। কিন্তু মালপত্র বের করার সুযোগ পাইনি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম সব পুড়ে যাচ্ছে।'

 

ব্যবসায়ী এমএম খায়রুল আলম বলেন, 'আমার দুটি দোকানে প্রায় এক কোটি টাকার মালপত্র ছিল। ব্যাংকেও ঋণ আছে অনেক, সেগুলো কীভাবে পরিশোধ করব, ভেবে পাচ্ছি না।' মার্কেটের পশ্চিম পাশে রাস্তার ওপর বসে আহাজারি করছিলেন ব্যবসায়ী জাফর। তিনি জানান, তার ছিল কসমেটিকস ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। দামি দামি মালপত্র। একটি ঘড়ির দামই ছিল ৩৫ লাখ টাকারও বেশি। সবই পুড়েছে এবং ভবন চাপা পড়েছে। তিনি বলেন, 'মনে হচ্ছে আগুনে আমিও লাফ দিই।' ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেনের মার্কেটটিতে তিনটি খাবারের দোকান ছিল। সবই পুড়েছে। তিনি বলেন, 'গতকালও (সোমবার) আমি কোটিপতি ছিলাম। এখন রাস্তার ফকির হয়ে গেছি।'

 

সরেজমিনে জানা যায়, কাঁচাবাজারের আগুনে ডিএনসিসি পাকা মার্কেটও ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। আগুন ছড়িয়ে পড়ার আগে ধোঁয়ার মধ্য দিয়ে কোনো কোনো ব্যবসায়ী মালপত্র নামিয়ে আনতে পেরেছেন। দোতলার পেছনের দিকের দেয়াল ভেঙে মালপত্র বের করেন তারা। অনেক মালপত্র ধোঁয়ায় কালো হয়ে গেছে। সেসব রাস্তার ওপর স্তূপ করে রেখেছেন অনেকে। অনেককে ছোট ট্রাক কিংবা ভ্যানে করে মালপত্র নিয়ে যেতে দেখা যায়। এই মার্কেটের গিফট আইটেম ব্যবসায়ী জামাল হোসেন বলেন, 'অনেক মালপত্র বের করে এনেছি। কিন্তু সেগুলো আর বিক্রি করা যাবে না। ধোঁয়ায় নষ্ট হয়ে গেছে।'