English Version
আপডেট : ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৭ ১৫:৩০
ডয়চে ভেলের প্রতিবেদন

ব্যভিচার আইনে শুধু পুরুষ কেনো, মহিলারা দোষী নয় কেন?

অনলাইন ডেস্ক
ব্যভিচার আইনে শুধু পুরুষ কেনো, মহিলারা দোষী নয় কেন?

ভারতে কোনো ব্যক্তি যদি স্বেচ্ছায় পরস্ত্রীর সঙ্গে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হন, তবে চলতি ব্যভিচার আইনে শুধু তিনিই শাস্তি পাবেন। ছাড় পেয়ে যাবেন নারী।

এটাও এক ধরনের লিঙ্গ বৈষম্য। তাই আইনের এই ধারা খতিয়ে দেখতে চায় শীর্ষ আদালত। প্রায় দেড় শ বছরের পুরানো। ওই আইনের সংশ্লিষ্ট দণ্ডবিধির ৪৯৭ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি পরস্ত্রীর সঙ্গে স্বেচ্ছায় যৌন সম্পর্ক করেন তাহলে সেটা ধর্ষণ নয়, ব্যভিচার হিসেবে গণ্য হবে। সেক্ষেত্রে শাস্তি হবে শুধু পুরুষেরই। পাঁচ বছর পর্যন্ত জেল এবং জরিমানা হতে পারে তাঁর। চলতি আইনের দণ্ডবিধিতে পুরুষ ব্যভিচারী এবং নারী তাঁর শিকার- এভাবেই দেখা হয়েছে। তাই মহিলারা ছাড় পাবে। অবশ্য ওই যৌন সম্পর্কে মহিলার স্বামীর সম্মতি থাকলে সেটা ব্যভিচার বা ধর্ষণ হিসেবে গ্রাহ্য হবে না। ভিক্টোরিয়ান যুগের এই আইনের মানসিকতা নিয়ে গত সপ্তাহে প্রশ্ন তুলেছে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রের বেঞ্চ। বিবাহিতা মহিলার স্বামীর মত থাকা মানে কী? স্ত্রী কি স্বামীর সম্পত্তি না পণ্য? নাকি তাঁর অধীনস্থ আত্মপরিচয়হীন পুতুলমাত্র? সুপ্রিম কোর্ট মনে করে, এখন উপলব্ধি করার সময় এসেছে যে পুরুষ ও নারী সব দিক থেকেই সমান। সংবিধানেও সমানাধিকার দেওয়া হয়েছে। তাই সুপ্রিম কোর্ট এখন দেশের প্রচলিত ব্যভিচার আইনের দুটি দিক খতিয়ে দেখবে। এক, এই আইনের ৪৯৭ ধারায় পুরুষ ব্যভিচারী এবং নারী তাঁর শিকার- এটার যৌক্তিকতা। দুই, মহিলার স্বামীর তাতে মত থাকলে সেটা ব্যভিচারই নয়। বিষয়টির জটিলতা হলো, সেকেলে পুরুষতান্ত্রিকতার নামে মহিলাদের করুণার পাত্রী হিসেবে দেখা এবং ছাড় দেওয়া কতটা যুক্তিসম্মত? এর আগে তিন তিনবার একই ইস্যু নিয়ে শীর্ষ আদালতে আর্জি জানানো হয়। কিন্তু প্রতিবারই আদালতে তা খারিজ হয়ে যায়। যেমন ১৯৮৫ সালে সোমিত্রি বিষ্ণুর মামলায় বিষ্ণুর স্বামী তাঁর স্ত্রীর অন্য পুরুষের সঙ্গে ব্যভিচারে লিপ্ত থাকার অভিযোগে ডিভোর্স চান। বিষ্ণুর আইনজীবী নলিনী চিদাম্বরম ৪৯৭ ধারাকে লিঙ্গ বৈষম্য, আইনি স্বেচ্ছাচারিতা এবং পুরুষতান্ত্রিকতার দৃষ্টান্ত বলে সওয়াল করেন। তিনি বলেন, যে যুক্তিতে বিষ্ণুরস্বামী ডিভোর্স চাইছেন, সেই যুক্তিতে কোনো স্ত্রী তাঁর স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা করবেন, এমন অধিকার তাঁকে দেওয়া হয়নি। শুধু তাই নয়, বিবাহিত পুরুষ অন্য কোনো অবিবাহিত মহিলার সঙ্গে যৌন সম্পর্কে থাকলেও পুরপুরুষের বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে না। এর সহজ অর্থ দাঁড়ায়, বিবাহ-বহির্ভূত দৈহিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে স্বামী আইনের চোখে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। তত্কালীন ভারতের প্রধান বিচারপতি ওয়াই. ভি চন্দ্রচূড়ের এজলাসে সেই আর্জি আবেগতাড়িত বলে খারিজ হয়ে যায়। শুধু বলা হয়, অবিশ্বাসী স্বামীর বিরুদ্ধে সামাজিক ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। কারণ অপরের স্ত্রীকে প্রলোভিত করা সমাজের চোখে ঘৃণ্য। এরও আগে ১৯৫৪ সালে ইউসুপ আবদুল আজিজ ব্যভিচার মামলায় পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চ রায় দিয়েছিল যে, ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪৯৭ ধারায় সংশ্লিষ্ট মহিলার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবার সংস্থান রাখা হয়নি। এর জন্য আইন প্রণেতাদের বিশেষ সংস্থান রাখতে হবে। ১৯৮৮ সালে রেবতী মামলার বিচারকদের রায়, পুরুষেরই শাস্তি হওয়া উচিত। কারণ সে মহিলার সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক গড়ে তুলে দাম্পত্য জীবনের পবিত্রতা নষ্ট করেছে। কাজেই স্ত্রী যেমন ব্যভিচারী স্বামীকে জেলে পাঠাতে আদালতে যেতে পারেন না, তেমনি স্বামীও বৌয়ের বিরুদ্ধে ব্যভিচারের অভিযোগে তাঁকে জেলে পাঠাতে পারেন না। বিশিষ্ট নারীবাদী শাশ্বতী ঘোষ কী বলছেন? এ বিষয়ে তাঁকে প্রশ্ন করা হলে তিনি ডয়চে ভেলেকে বললেন, ''দুটো ক্ষেত্রেই লিঙ্গ সাম্য বজায় রাখা উচিত। অর্থাৎ মেয়েদেরও আদালতে যাবার অধিকার থাকা উচিত। আর মেয়েরা যদি বৈবাহিক সম্পর্কে থাকাকালীন অন্য সম্পর্কে জড়ান, তাহলে সেটারও দায়িত্ব নিতে হবে তাঁকে। অর্থাৎ তাঁরও বিচার হওয়া উচিত। আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে আমি এটাই বলতে পারি যে, দু'দিক থেকেই 'জেন্ডার জাস্টিস' আইন হওয়া উচিত। '' বলা বাহুল্য, ১৮২৯-৩০ সালে যখন বর্তমান আইন তৈরি হয়েছিল তখন মেয়েদের পরিসরটাকে ঘর বলে মনে করা হতো আর স্বামী বা পুরুষের পরিসরটা মনে করা হতো বাইরে। মেয়েদের ঘর সংসারটা সুরক্ষিত রাখতে বৈবাহিক সম্পর্কটা সুরক্ষিত রাখতেই তৈরি হয়েছিল এই আইন। নারীবাদী শাশ্বতী ঘোষ ডয়চে ভেলেকে আরও বললেন, অনেকক্ষেত্রে আমরা দেখেছি বহু মেয়ে এই বলে অভিযোগ করছেন যে, স্বামী তাঁদের বন্ধুদের হাতে তুলে দিচ্ছেন। সেক্ষেত্রে দেখতে হবে স্বামীর সম্মতি কোন অবস্থায় আছে। শুধুই কি স্বামীর সম্মতি নাকি স্ত্রীরও সম্মতি আছে। যদি দুজনের সম্মতি থাকে তাহলে সেটা আদালতের আওতায় পড়বে না। এ প্রসঙ্গে তিনি সাহিত্যিক আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের আমি সে ও সখা গল্পটি উল্লেখ করেন, যেখানে স্বামী  মনে করেছেন বিবাহিত জীবনের স্বাভাবিক সম্পর্ক ধরে রাখতে সে অক্ষম। তাই অন্য পুরুষের সঙ্গে যদি তাঁর স্ত্রী ভালো থাকে, তো থাকুক। সেক্ষত্রে কোনো পক্ষই আদালতে যাবে না। আর স্ত্রীর যদি সত্যিকারের সম্মতি না থাকে, স্বামী যদি উচ্চাকাঙ্খার বশবর্তী হয়ে, যেমন অর্থ বা বৈভবের জন্য এ কাজ করেন, তাহলে সেটাকে কোনোমতেই সমর্থন করা যায় না। আসল প্রশ্ন, চলতি আইনে ব্যভিচার অপরাধ বলে গণ্য হওয়া উচিত কিনা। সেজন্য এই আইনটি নতুন করে খতিয়ে দেখা জরুরি। এখন অনেক দেশে এটাকে অপরাধ বলে গণ্য করা হয় না। জাতিসংঘের ওয়ার্কিং গ্রুপ মনে করে, যেসব দেশে এই আইন আছে এবং যেখানে মহিলাদের ক্ষেত্রে বৈষম্য করা হয়, সেসব দেশ থেকে এ ধরনের আইন তুলে দেওয়া উচিত।