English Version
আপডেট : ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০৩:০৮

হোটেল ব্যবসা মানেই নারী ব্যবসা নয়

আনোয়ার হোসেন সোহেল
নিজস্ব প্রতিবেদক
হোটেল ব্যবসা মানেই নারী ব্যবসা নয়

মো. আব্দুল মুত্তালিব জন্ম শেরপুর জেলার নকলা উপজেলার নারায়ণখোলা গ্রামে। তিনি ১৯৮২ সালে নকলা পাইলট উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। পরবর্তীতে রাজশাহী শাহ মোখদুম কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে উচ্চতর ডিগ্রী অর্জনের জন্য চলে আসেন ঢাকায়। ভর্তি হন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং বিভাগে। এই বিভাগ থেকেই সম্মানের সঙ্গে স্নাতক ও মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন। ছাত্র জীবনে খন্ডকালীন চাকরি হিসেবে প্রথমে যোগাদান করেন সনামধন্য হোটেল জাকারিয়া ইন্টারন্যাশনালে। সেখানে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এরপর হোটেল এ্যারোলিংয়ে ইন্টারন্যাশনালের একজন ফ্রন্টডেস্ক অফিসার হিসেবে যোগদান করেন। তখন থেকে আর পিছে ফিরে তাকাতে হয়নি তরুণ উদ্যোগতা মুত্তালিবকে। লন্ডন প্রবাসী বন্ধুর অনুপ্রেরণায় নিজেই শুরু করেন হোটেল বিজনেস। তার প্রতিষ্ঠিত “ডাবলট্রি হোটেল এণ্ড সুইটসে লিমিটেড” দীর্ঘ সাত বছর ধরে দেশি-বিদেশ পযটকদের উন্নতমানের সেবাদানের পযটকদের আস্থা অর্জন করেছে। বর্তমানে তিনি কোয়ান্টাম হোটেল এণ্ড রিসোর্ট এর একজন কর্নধার। সফল এ উদ্যোগতা হোটেল ব্যবসার পাশাপাশি বর্তমানে তিনি একটি বাইয়িং হাউজ পরিচালনা করছেন। সেই সঙ্গে তিনি বৃহৎত্তম ময়মনসিংহ জেলা সমিতিরসহ বেশ কয়েকটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। সম্প্রতি দি ঢাকা পোস্ট ডটকমের সঙ্গে তিনি ছাত্রজীবনের সংগ্রামী দিন ও বাংলাদেশের হোটেল ব্যবসা এবং দেশের পর্যটন শিল্প বিকাশের নানা সম্ভাবনাময় দিকগুলো তুলে ধরে কথা বলেন।     

হোটেল ব্যবসায় কেন এলেন? 

****অপুরূপ নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশ। ঋতু বৈচিত্রের কারণে প্রতিবছর বিপুল সংখ্যক বিদেশী পর্যটক আমাদের দেশ ভ্রমণে আসে। কিন্তু প্রয়োজনী সুযোগ-সুবিধা ও বিশ্বমানের আবাসন সংকটের কারণে অনেকেই দ্রুত চলে যান। এতে তারা যেমন এদেশের সৌন্দর্য উপভোগ করা থেকে বঞ্চিত হন। তেমনি আমরাও হারাই বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা। তাই পর্যটকদের বিশ্বমানের সেবাদানের মাধ্যমে দেশকে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান করার প্রয়াসে ২০০৭ সালে আমরা হোটেল ব্যবসা শুরু করি।   

বাংলাদেশে হোটেল ব্যবসায় সমস্যাগুলো কি কি? 

****হোটেল একটি প্রাচীণ ব্যবসা। প্রতিবছর উন্নত দেশগুলো এব্যবসা থেকে বিপুল পরিমান বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে। এ ব্যবসা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের বহু অভিযোগ আছে। তবে অভিযোগ গুলোকে একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ীর কারণে হোটেল ব্যবসাকে মানুষ সন্দেহের চোখে দেখেন। এটা একটি ইন্টারনেট যুক্ত মোবাইল ফোনের মত আপনি এটার অপারেটর। একে আপনি যেভাবে ব্যবহার করবেন সে আপনাকে রেজাল্টাও সেভাবে দিবে। কিন্তু হোটেল ব্যবসা মানেই নারী কিংবা অবৈধ ব্যবসা নয়। ইউরোপ, আমেরিকাতে এদেশের ছেলে মেয়েরা এব্যবসা করে দেশের জন্য সম্মান ও প্রচুর পরিমান বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে। তাছাড়া আমাদের সার্কভুক্ত অনেক দেশের প্রধান উপার্জনের মাধ্যমও এই সেক্টর।    

হোটেল ম্যানেজমেন্ট কি নির্ভরযোগ্য পেশা? 

**** বেকারত্ব একটি অভিশাপ। আর এই অভিশাপ একজন শিক্ষিত যুবক-যুবতীর মধ্যে হতাশার সৃষ্টি করতে পারে। তারা যদি তার অবসর সময় টুকু হেলায় না ফেলে হোটেল ম্যানেজমেন্ট ও ক্যাটারিং পেশায় ৬মাসেরও একটি শর্টকোর্স করেন তাহলে তারা আত্মনির্ভরশীল হতে পারেন। এটা অত্যন্ত সম্মানের পেশা। এর চাহিদা পুরো পৃথিবীতেই আছে। তাছাড়া আমাদের দেশের বিভিন্ন হোটেল মোটেলেগুলোতে বিপুল সংখ্যক স্কিল কর্মীর চাহিদা রয়েছে। দেশের বাহিরেও বাংলাদেশি মালিকানাধীন বিভিন্ন স্থানে কর্মী সংকট রয়েছে। আমাদের দেশে অনেক ফাইভ স্টার হোটেল আছে যেখানে দক্ষ জনবলের যথেষ্ট অভাব আছে। তাই আমি বলবো, সময় নষ্ট না করে এখনই উদ্যোগ গ্রহণ করুন।

পর্যটন শিল্প বাংলাদেশে ভবিষ্যৎ কেমন দেখতে পাচ্ছেন? 

****অপুরূপ নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশ। ছয় ঋতুর এ দেশে রয়েছে পর্যটনের শিল্পের অপার সম্ভাবনা। আমাদের আছে কক্সবাজারের মতো বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত, সাগরের বুকে জেগে থাকা প্রাকৃতিক প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন, সিলেটের চা বাগান, প্রাকৃতিক ঝর্ণা, বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রাভ বন সুন্দরবন, সবুজ পাহাড়ে ঘেরা রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি বান্দারবান। দেশের উত্তরাংশে গজনীর গারো পাহাড়সহ অসংখ্য দর্শনীয় স্থান। 

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ বাংলাদেশে পর্যটনশিল্প বিকাশের বিশাল সুযোগ রয়েছে। দুর্ভাগ্যবশত স্বাধীনতার ৪৫ বছরেও তা আমরা কাজে লাগাতে পারিনি। এক কথায়, পর্যটনশিল্প বিকাশের সম্ভাবনার মধ্যে আমরা হিমালয় সমান সমস্যা নিয়ে বসে আছি। এসব সমস্যা বহুমুখী। যার মধ্যে অবকাঠামোগত অসুবিধা তো আছেই, নিরাপত্তা নিয়েও পর্যটকরা উদ্বিগ্ন থাকেন। কক্সবাজারের মতো এলাকায় পর্যটকরা ছিনতাইসহ নানা রকমের নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। সমুদ্রতীরে চাঁদের আলোয় হেঁটে বেড়াতে কার না ভালো লাগবে! কিন্তু ছিনতাইকারী বা বখাটেদের উৎপাতে সেটি হবার জো নেই। বিশেষত নারী ও বিদেশি পর্যটকরা যে রাতে একটু নিরুদ্বিগ্নভাবে ঘুরে বেড়াবে, সেটি সব সময় সম্ভব হয় না। দিনের বেলায় ফেরিওয়ালাদের উৎপাত, পর্যটন স্পটে জিনিসপত্রের অগ্নিমূল্য ইত্যাদি কারণে পর্যটকেরা অনুৎসাহিত হন। একটি আধা-লিটার পানির সর্বোচ্চ খুচরা দাম যেখানে ১৫ টাকা, পর্যটন স্পটে সেটি কেন ২৫ টাকা হবে? কেন পর্যটকদের কাছ থেকে কোরাল মাছের দাম নিয়ে অন্য সামুদ্রিক মাছ খেতে দেয়া হবে? একসময় কক্সবাজারের পাহাড়গুলো বনসম্পদে ভরপুর ছিল। সৈকতের পাশাপাশি এসব পাহাড় মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করত। কিন্তু কালের পরিক্রমায় বর্তমান সময়ে এসব বৃক্ষরাজি চোখেই পড়েনা।বর্তমানে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য পর্যটন স্থানগুলো দূষণের শিকার। সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থা না থাকায় ভ্রমণকালে পর্যটকরা তাদের ব্যবহৃত দ্রব্যাদি ফেলে পরিবেশ দূষণ করছে। এতে স্থানীয় জীববৈচিত্র হুমকির মুখে পড়ছে।  প্রকৃতি আমাদের দু’হাত ভরে দিলেও আমরা তার অতি অল্পই ব্যবহার করতে পারছি। বিশ্বের বৃহত্তম সমুদ্র সৈকত আমাদের দেশে হলেও আমরা এখনো সৈকতের ১২০ কিলোমিটার ব্যবহার করতে পারিনি। ৪৫ বছর ধরে মাত্র তিন কিলোমিটার সৈকত ব্যবহৃত হচ্ছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা আমাদের দেশের পর্যটন শিল্পের সবচেয়ে বড় বাঁধা। অস্থির রাজনৈতিক পরিবেশের কারণে বিদেশি পর্যটকেরা যেমন এদেশে আসতে উৎসাহ পান না তেমনি দেশীয় ভ্রমণপিপাসুরাও নিরাপদ বোধ করেন না। অথচ, নেপালের মত ছোট দেশে পর্যটকের সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। নেপালে পর্যটকদের সুবিধার্থে অ্যারাইভাল ভিসা দেওয়া হয়। আমাদের দেশে এমন ব্যবস্থা করলে পর্যটকের সংখ্যা বাড়বে। যোগাযোগ ব্যবস্থার দুর্বলতা বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প বিকাশে অণ্যতম এক প্রতিবন্ধতকা। প্রতিটি পর্যটন স্পটের মাঝে প্রশস্ত রাস্তা ও ট্রেন ব্যবস্থা থাকলে যোগাযোগ ব্যবস্থার বিরম্বনা থেকে রেহাই পাওয়া যেত। চট্টগ্রাম থেকে টেকনাফ পর্যন্ত রাস্তা সম্প্রসারণ এবং রেললাইনের ভিত্তিপ্রস্তর করা হলেও তহবিল জটিলতায় কাজ হচ্ছে না। অনেক সময় স্থানীয় জনগণ পর্যটকদের সাথে সহযোগীতামূলক আচরণ করেন না। পর্যটক ও স্থানীয় জনগণের সামাজিক অবস্থানের পার্থক্যের কারণে এরকমটি হয়। পর্যটকরা আদিবাসী তথা স্থানীয় ঐতিহ্য দেখে অবজ্ঞা করে। একমাত্র সবার মাঝে সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে এ সমস্যা কাটানো সম্ভব। পর্যটন শিল্পে অনেক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ আশানুরুপভাবে অগ্রগতি করতে পারছে না। সকল সমস্যা চিহ্নিত করে জরুরি ভিত্তিতে সমাধান করে পর্যটন শিল্পকে বিকশিত করা প্রয়োজন। তবেই বাংলাদেশের অপরিসীম সম্ভাবনাময় পর্যটন শিল্প দেশের অর্থনীতিতে আশানুরূপ ভূমিকা রাখতে পারবে।