English Version
আপডেট : ২৩ ডিসেম্বর, ২০১৭ ১৫:৫৭

২০১৭ তে মিডিয়া অঙ্গন যাদের হারিয়েছে

দেখতে দেখতে কেটে গেল ২০১৭ সাল। পাওয়া আর না পাওয়ার মধ্যদিয়ে প্রায় শেষের দিকে ২০১৭ সাল। আর এই সালেই বাংলা সংস্কৃতি অঙ্গন হারিয়েছে অনেক কিংবদন্তি অভিনেতা, শিল্পীদের। যারা কিনা নিজেদের কাজের মাধ্যমে জয় করে নিয়েছেন কোটি মানুষের ভালোবাসা আর সমৃদ্ধ করেছেন সংস্কৃতি অঙ্গন। এবার দেখে নেয়া যাক ২০১৭ তে মিডিয়া অঙ্গন যাদের হারিয়েছে।
অনলাইন ডেস্ক
২০১৭ তে মিডিয়া অঙ্গন যাদের হারিয়েছে

নায়ক রাজ রাজ্জাকঃ বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তী নায়ক রাজ রাজ্জাক। চলতি বছরের (২১ আগস্ট) বিকেলে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। রাজ্জাক ১৯৪২ সালের ২৩ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন পশ্চিমবঙ্গের (বর্তমান ভারতের) কলকাতার টালিগঞ্জে। কলকাতার খানপুর হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় স্বরস্বতি পূজা চলাকালীন সময়ে মঞ্চ নাটকে অভিনয়ের জন্য তার গেম টিচার রবীন্দ্রনাথ চক্রবর্তী তাকে বেছে নেন নায়ক অর্থাৎ কেন্দ্রীয় চরিত্রে। শিশু-কিশোরদের নিয়ে লেখা নাটক বিদ্রোহীতে গ্রামীণ কিশোর চরিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়েই নায়করাজের অভিনয়ে সম্পৃক্ততা। তার দুই পুত্র বাপ্পারাজ ও সম্রাটও চলচ্চিত্র অভিনয়ের সঙ্গে জড়িত।

১৯৬৬ সালে ‘বেহুলা’ চলচ্চিত্রে নায়ক হিসেবে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে ঢাকাই ছবিতে দর্শকনন্দিত হন কিংবদন্তি এ অভিনেতা। এতে তাঁর বিপরীতে ছিলেন সুচন্দা। শুধু নায়ক হিসেবেই নয়, পরিচালক হিসেবেও বেশ সফল। ‘আয়না কাহিনী’ ছবিটি নির্মাণ করেন রাজ্জাক। ‘অবুঝ মন’, ‘আলোর মিছিল’ ‘ছুটির ঘণ্টা’, ‘রংবাজ’, ‘বাবা কেন চাকর’, ‘নীল আকাশের নিচে’, ‘জীবন থেকে নেওয়া’ ‘পিচঢালা পথ’, ‘অশিক্ষিত’, ‘বড় ভালো লোক ছিল’সহ অসংখ্য ছবিতে অভিনয় করা রাজ্জাক সর্বশেষ অভিনয় করেছেন ছেলে বাপ্পারাজ পরিচালিত ‘কার্তুজ’ ছবিতে। কিংবদন্তী এই নায়ক তার ক্যারিয়ারে ছয়বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার, দুইবার বাচসাস পুরস্কার সহ বিভিন্ন সম্মাননা পুরষ্কার অর্জন করেন। পাশাপাশি জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের শুভেচ্ছা দূত হিসেবে কাজ করছেন তিনি। মিজু আহমেদ: চলতি বছরের মার্চ মাসে শুটিং করতে ঢাকা থেকে দিনাজপুর যাওয়ার পথে না ফেরার দেশে পারি জমান দেশীয় চলচ্চিত্রের গুণী অভিনেতা মিজু আহমেদ। কুষ্টিয়ায় ১৯৫৩ সালের ১৭ নভেম্বর জন্মেছিলেন মিজু আহমেদ। তার প্রকৃত নাম মিজানুর রহমান। শৈশব থেকে থিয়েটারের প্রতি আগ্রহী ছিলেন তিনি। তাই কুষ্টিয়ার স্থানীয় একটি নাট্যদলে যোগ দেন। ১৯৭৮ সালে ‘তৃষ্ণা’ ছবির মাধ্যমে অভিনেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন মিজু আহমেদ। কয়েক বছরের মধ্যে ঢালিউডে খলনায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান তিনি। অসাধারণ অভিনয়ের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৯২ সালে সেরা পার্শ্ব অভিনেতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন তিনি। মিজু আহমেদ অভিনীত ছবির তালিকায় আরও উল্লেখযোগ্য- মহানগর, স্যারেন্ডার, চাকর, সোলেমান ডাঙ্গা, ত্যাগ, বশিরা, আজকের সন্ত্রাসী, হাঙ্গর নদী গ্রেনেড, কুলি, লাঠি, লাল বাদশা, গুন্ডা নাম্বার ওয়ান, ঝড়, কষ্ট, ওদের ধর, ইতিহাস, ভাইয়া, হিংসা প্রতিহিংসা, বিগ বস, আজকের সমাজ ইত্যাদি। অভিনয়ের পাশাপাশি চলচ্চিত্র প্রযোজনাও করেছেন মিজু আহমেদ। প্রয়াত অভিনেতা রাজীবকে নিয়ে তার গড়া প্রযোজনা সংস্থা ফ্রেন্ডস মুভিজ থেকে বেশ কয়েকটি ছবি তৈরি হয়েছিল। লাকি আখন্দ: প্রখ্যাত সুরকার, সঙ্গীত পরিচালক ও গায়ক লাকী আখন্দ মারা যান ২১ এপ্রিল ২০১৭ তে। লাকী আখন্দ একজন মুক্তিযোদ্ধাও ছিলেন। তার জন্ম ১৯৫৬ সালের ১৮ জুন। ৫ বছর বয়সেই তিনি তার বাবার কাছ থেকে সঙ্গীত বিষয়ে হাতেখড়ি নেন। ১৯৬৩-১৯৬৭ সাল পর্যন্ত টেলিভিশন এবং রেডিওতে শিশু শিল্পী হিসেবে সঙ্গীত বিষয়ক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন। মাত্র ১৪ বছর বয়সেই এইচএমভি পাকিস্তানের সুরকার এবং ১৬ বছর বয়সে এইচএমভি ভারতের সংগীত পরিচালক হিসেবে নিজের নাম যুক্ত করেন। সর্বশেষ তিনি বাংলাদেশ বেতারের পরিচালক (সংগীত) হিসেবে কর্মরত ছিলেন। লাকি আখন্দের প্রথম একক অ্যালবাম ‘লাকি আখন্দ’। ১৯৮৪ সালে সারগামের ব্যানারে এ অ্যালবাম প্রকাশ পায়। তিনি ব্যান্ড দল ‘হ্যাপি টাচ’ এর সদস্য। লাকী আখন্দ অন্যান্য যেসব শিল্পীর গান রচনা ও সঙ্গীতায়োজন করেছেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, যেখানে সীমান্ত তোমার (কুমার বিশ্বজিৎ), কবিতা পড়ার প্রহর এসেছে (সামিনা চৌধুরী), আবার এলো যে সন্ধ্যা (হ্যাপী আখন্দ), কে বাঁশি বাজায় রে (হ্যাপী আখন্দ)এবং বিতৃঞ্চা জীবনে আমার’, ‘কি করে বললে তুমি’ ‘লিখতে পারি না কোনও গান, ‘ভালোবেসে চলে যেও না’ প্রভৃতি। আব্দুল জব্বার: দেশীয় সংগীতের উজ্জ্বল নক্ষত্র স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কন্ঠযোদ্ধা শিল্পী আব্দুল জব্বার ৩০শে আগস্ট মারা যান। তার বয়স হয়েছিলো ৭৯ বছর। তিনি দীর্ঘদিন ধরেই কিডনীসহ বিভিন্ন শারীরিক সমস্যায় ভুগছিলেন। প্রায় দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। শিল্পী আব্দুল জব্বার ১৯৩৮ সালের ৭ই নভেম্বর তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের কুষ্টিয়া জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি গান গাওয়া শুরু করেন ১৯৫৮ সাল থেকে তৎকালীন পাকিস্তান বেতারে। ১৯৬২ সালে সর্বপ্রথম সিনেমার গানে কন্ঠ দেন তিনি। এরপর থেকে নিয়মিতই চলচ্চিত্রে গেয়েছেন। ১৯৬৪ সাল থেকে তিনি বিটিভির নিয়মিত শিল্পী হয়ে উঠেন। ১৯৬৪ সালে জহির রায়হান পরিচালিত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম রঙ্গিন চলচ্চিত্র ‘সংগম’-এর গানে কণ্ঠ দেন। ১৯৬৮ সালে ‘এতটুকু আশা’ ছবিতে সত্য সাহার সুরে তার গাওয়া ‘তুমি কি দেখেছো কভু জীবনের পরাজয়’ গানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। একই বছর ‘পীচ ঢালা পথ’ ছবিতে রবীন ঘোষের সুরে ‘পীচ ঢালা এই পথটারে ভালবেসেছি’ এবং ‘ঢেউয়ের পর ঢেউ’ ছবিতে ‘সুচরিতা যেওনাকো আর কিছুক্ষণ থাকো’ গানে কণ্ঠ দিয়ে তুমুল জনপ্রিয়তা পান। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী হিসেবে অনবদ্য ভূমিকা রাখেন আব্দুল জব্বার। ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’, ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’, ‘তুমি কি দেখেছো কভু জীবনের পরাজয়’সহ আব্দুল জব্বারের অনেক গান তখন ছিলো মুক্তিযুদ্ধে অনুপ্রেরনার উৎস। সে সময় হারমোনিয়াম নিয়ে কলকাতার বিভিন্ন ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের গান গেয়ে উদ্বুদ্ধ করেন তিনি। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে গেয়েছেন অসংখ্য গান। তার গান মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা ও মনোবল বাড়িয়েছে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়েও নিয়মিত চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দেন তিনি। ১৯৭৮ সালে ‘সারেং বৌ’ ছবিতে আলম খানের সুরে ‘ওরে নীল দরিয়া’ গানটি গেয়ে আকাশছোঁয়া সফলতা পান তিনি। আব্দুল জব্বার জীবদ্দশায় বঙ্গবন্ধু স্বর্নপদক(১৯৭৩), একুশে পদক(১৯৮০), স্বাধীনতা পদক(১৯৯৬), জহির রায়হান চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ দেশ বিদেশে অসংখ্য পদক ও সম্মাননা লাভ করেন। বারি সিদ্দিক: উপমহাদেশের প্রখ্যাত সুরকার, গীতিকার, বংশীবাদক ও সঙ্গীতশিল্পী বারী সিদ্দিকী রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ২৪ নভেম্বর। দীর্ঘদিন সঙ্গীতের সঙ্গে জড়িত থাকলেও সবার কাছে বারী সিদ্দিকী শিল্পী হিসেবে পরিচিতি পান ১৯৯৯ সালে। ওই বছর হুমায়ূন আহমেদের ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ ছবিটি মুক্তি পায়। এই ছবিতে তিনি ছয়টি গান গেয়ে রাতারাতি আলোচনায় আসেন। বারী সিদ্দিকী ১৯৫৪ সালের ১৫ নভেম্বর নেত্রকোনা জেলায় এক সঙ্গীতজ্ঞ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবে পরিবারের কাছে গান শেখায় হাতেখড়ি তার। মাত্র ১২ বছর বয়সেই নেত্রকোনার শিল্পী ওস্তাদ গোপাল দত্তের অধীনে তার আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ শুরু হয়। তিনি ওস্তাদ আমিনুর রহমান, দবির খান, পান্নালাল ঘোষসহ অসংখ্য গুণীশিল্পীর সরাসরি সান্নিধ্য লাভ করেন।