English Version
আপডেট : ১ অক্টোবর, ২০১৭ ১৬:১২

মহররমের তাৎপর্য ও শিক্ষা

অনলাইন ডেস্ক
মহররমের তাৎপর্য ও শিক্ষা

ইসলামী বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস মহররম। এ মাসের দশম তারিখকে বলা হয় আশুরা। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। সৃষ্টির সূচনাকাল থেকে শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর উম্মত পর্যন্ত অসংখ্য তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনার সাক্ষী ও স্মারক হয়ে রয়েছে দিনটি। শুধু মুসলমানদের কাছেই নয়, ইহুদি ও খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের কাছেও দিনটি অনন্য মর্যাদার অধিকারী। কেননা এই দিনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক নবীর স্মৃতি।

মানবজাতির আদি পিতা হজরত আদম (আ.) ও আদি মাতা হজরত হাওয়া (আ.) জান্নাত থেকে পৃথিবীতে আসার পর দীর্ঘদিন বিচ্ছিন্ন থেকে এই দিনে মিলিত হন। হজরত ইদরিসকে (আ.) এই দিন উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত করা হয়। হজরত ইউসুফ (আ.) দীর্ঘদিন পর এই দিন পিতা হজরত ইয়াকুব (আ.) ও মায়ের সঙ্গে আবার মিলিত হন। হজরত আইয়ুব (আ.) দীর্ঘকাল রোগভোগের পর এই দিন আরোগ্য লাভ করেন। হজরত মুসা (আ.) এই দিনে তুর পর্বতে গিয়ে আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে সরাসরি কথা বলার অনন্য মর্যাদা লাভ করেন। মিসরের জালিম শাসক ফেরাউনের সদলবলে সলিল সমাধি ঘটে এই দিনে। আর হজরত মুসার (আ.) সঙ্গে বনি ইসরায়েল ফেরাউনের কবল থেকে নিষ্কৃতি লাভ করে। এভাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা স্মরণ করিয়ে দেয় প্রতিবছর আশুরার দিনটি। এমনকি কিয়ামতও এই দিনেই সংঘটিত হবে বলে মহানবী (সা.) ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন।

কিন্তু ইসলামের ইতিহাসে একটি ঘটনা এই দিনের অন্য সব স্মৃতিকে ম্লান করে দিয়েছে। সাইয়েদুল মুরসালিন হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আদরের নাতি, শেরে খোদা হজরত আলী (রা.) ও জান্নাতে রমণীকুলের নেত্রী হজরত ফাতেমার (রা.) নয়নমণি হজরত হুসাইন (রা.) বর্তমান ইরাকের অন্তর্গত কুফা নগরের অদূরে কারবালা প্রান্তরে এই দিনেই নির্মমভাবে শাহাদাতবরণ করেন ইয়াজিদ নিযুক্ত আঞ্চলিক গভর্নর উবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদের বাহিনীর হাতে। ইয়াজিদের খেলাফতে অধিষ্ঠিত হওয়ার পদ্ধতি হজরত হুসাইন (রা.) সমর্থন করেননি। কুফার বাসিন্দারা হজরত হুসাইনকে (রা.) খলিফা হিসেবে মেনে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। তাই কুফাকে কেন্দ্র করে ইসলামী খেলাফতের অকৃত্রিম ব্যবস্থা পুনরুজ্জীবিত করার উদ্দেশ্যে তিনি মক্কা থেকে রওনা হয়ে কারবালা প্রান্তরে উপস্থিত হলে বাধার মুখে পড়েন উবায়দুল্লাহ বাহিনীর সামনে। সমঝোতার চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর যে মোকাবিলা হয়, তাতে এক দিকে ছিল প্রায় নিরস্ত্র মুষ্টিমেয় হুসাইন (রা.) বাহিনী। ৭০ জনের কিছু বেশি সদস্যের প্রায় সবাই ছিলেন নবী পরিবারের যুবক ও কিশোর। অন্য পক্ষে ছিল বিশাল সশস্ত্র যুদ্ধবাহিনী। নিতান্ত অসম যুদ্ধে নবী পরিবারের প্রায় সবাই শহীদ হন।

সবচেয়ে নির্মমতার শিকার হন স্বয়ং হজরত হুসাইন (রা.)। উবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদের বাহিনীর হাতে তিনি পান করেন শাহাদতের অমিয় সুধা। কিন্তু তিনি রেখে যান মুসলিম মিল্লাতের জন্য অনুপম আদর্শ। হজরত হুসাইনের (রা.) শাহাদাত ছিল প্রকৃতপক্ষে ইয়াজিদের মৃত্যু। প্রত্যেক কারবালার পর ইসলাম নতুনভাবে সজীব হয়।

এ ঘটনার স্মৃতি প্রতিটি মুসলমানের মনে আবেগের ঢেউ তোলে। এমনকি কারবালার মর্মান্তিক ইতিহাস অবলম্বন করে রচিত হয়েছে অসংখ্য কাব্য, মহাকাব্য ও উপন্যাস। কিন্তু আশুরার দিনটিকে নিছক শোকের উপলক্ষ হিসেবে পালন করা ইসলামের মৌল চেতনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

রমজান মাসের রোজা ফরজ হওয়ার আগে আশুরার রোজা মুসলমানদের জন্য ফরজ ছিল বলে বর্ণনা করেছেন উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা (রা.)সহ কয়েকজন সাহাবি। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) মদিনায় হিজরত করে এসে দেখতে পান ইহুদিরা এ দিনটিতে রোজা রাখে। তিনি জানতে পারেন, এদিনেই হজরত মুসা (আ.) বনি ইসরায়েলকে ফেরাউনের কবল থেকে উদ্ধার করে ফিলিস্তিনে ফিরিয়ে এনেছিলেন। তাই হজরত মুসা (আ.) প্রতি বছর এ দিনে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা হিসেবে রোজা রাখতেন। মহানবী (সা.) তখন ইরশাদ করেন, হজরত মুসার (আ.) প্রতি আমাদের কর্তব্য আরো বেশি। এই বলে তিনি রোজা রাখলেন এবং মুসলমানদের রোজা রাখার নির্দেশ দিলেন। তবে রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার পর এখন এ দিনের রোজা ফরজ নেই। অবশ্য অত্যন্ত ফজিলতের নফল রোজা হিসেবে বহাল আছে।

সুতরাং আশুরা শোক নয়, ইবাদত ও উপলব্ধির দিন। হজরত হুসাইনের (রা.) আত্মত্যাগ ও অবিচলতা থেকে শিক্ষা নেওয়া এবং তা নিজেদের জীবনে প্রতিফলিত করার অঙ্গীকার এ দিনের প্রধান আবেদন। এখন মুসলিম বিশ্বে কারবালার ময়দান একটা নয়, অনেক। একাধিক স্থানে প্রতিদিন সংঘটিত হচ্ছে কারবালার মতোই মর্মন্তুদ ঘটনা।

ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তান, ফিলিস্তিন, সোমালিয়ার মুসলমানদের নির্যাতিত হওয়ার সব ঘটনা তুচ্ছ হয়ে গেছে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর সেখানকার সেনাবাহিনী, উগ্র বৌদ্ধ ও ক্ষমতাসীন দলের কর্মীদের অমানবিক সহিংসতার কাছে।

অন্তঃকলহ ও বিভক্তির মাঝে পড়ে মুসলিম উম্মাহ শোচনীয় দুর্দশায় নিমজ্জিত। সে ধর্মীয় বন্ধন তাদের পৃথিবীব্যাপী ঐক্যের মাধ্যম, তার প্রতি ঐকান্তিকতা ও নিষ্ঠা এখন অনেকটাই দুর্বল। নিজেদের মুসলিম পরিচয় দিতেও কুণ্ঠিত হচ্ছেন মুসলিমপ্রধান অনেক রাষ্ট্রের শাসকরা। সুতরাং মার্সিয়া আর ক্রন্দন নয়, এখন চাই ক্ষুদ্র স্বার্থ ত্যাগ করে বৃহত্তর মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠা এবং কল্যাণ সাধনের প্রতিজ্ঞা। এটাই আশুরা দিবসের মূল আহ্বান ও দাবি। এ আহ্বানে সাড়া দিতে ও দাবি পূরণের চেতনায় উজ্জীবিত হতে পারলে গঠিত হতে পারে মুসলিম উম্মাহর জাগরণ।

লেখক : কলামিস্ট