English Version
আপডেট : ১৫ জানুয়ারি, ২০১৭ ০২:২২

৭ খুনের লোমহর্ষক বর্ণনা দিলেন তারেক সাঈদ, রানা ও আরিফ

নিজস্ব প্রতিবেদক
৭ খুনের লোমহর্ষক বর্ণনা দিলেন তারেক সাঈদ, রানা ও আরিফ
৭ খুনের লোমহর্ষক বর্ণনা দিলেন তারেক সাঈদ রানা আরিফ

নারায়ণগঞ্জ: নারায়ণগঞ্জে চাঞ্চল্যকর সাত খুন মামলার রায় হবে আগামী ১৬ জানুয়ারি। মামলার আসামিরা হলেন-র‌্যাবের চাকরিচ্যুত ও অবসরে পাঠানো সেনা কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ, মেজর আরিফ হোসেন ও নৌ-বাহিনীর লেফটেন্যান্ট কমান্ডার এম এম রানা।

এই তিন জনেই ছিলেন সাত খুনের মামলার প্রধান আসামি। গ্রেফতারের পর বিভিন্ন সময় তারা আদালতে ১৬৪ ধারায় নিজেদের  কৃতকর্মের লোমহর্ষক ও নির্মম ঘটনাগুলো খুলে বলেন। যা যে কোনো মানুষের হৃদয় স্পর্শ করে। আসামিরা কিভাবে সেদিন দিনের আলোয় একজন মানুষকে তুলে নিয়ে রাতের আঁধারে হাত-পা বেঁধে নদীতে ফেলে দিয়ে গুম করে সেই বর্ণনাই দিয়েছেন তাদের জবানবন্দিতে। চলুন জেনেনি সে বিভীষিকাময় মুহূর্তগুলোর বর্ণনা আসামিদের মুখ থেকে। 

তারেক সাঈদের জবানবন্দি

২০১৪ সালের ১৮জুন তারেকের জবানবন্দি রেকর্ড করেন নারায়ণগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট। ওই বছরের মার্চে র‌্যাবের অধিনায়কদের মাসিক সম্মেলনের শেষে কর্নেল জিয়া আমাকে একটি তালিকায় চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের গ্রেফতারের নির্দেশ দেন। ওই তালিকায় বিভিন্ন মামলার আসামি নজরুলের নাম বিশেষভাবে চিহ্নিত ছিল। অধিনায়কদের সম্মেলনের পরদিন র‌্যাব-১১-এর কোম্পানি কমান্ডারদের সম্মেলনে আমি নজরুলকে গ্রেফতারের জন্য মেজর আরিফকে নির্দেশ দেই। ওই সম্মেলনে আমি লেফটেন্যান্ট কমান্ডার রানাকে, নজরুলকে গ্রেফতারের বিষয়ে মেজর আরিফকে সাহায্য করতে বলি।

২৭ এপ্রিল মেজর আরিফ আমাকে ফোন করে বলেন, স্যার নজরুল আজকে কোর্টে আসবে, তাকে আজ গ্রেফতার করা যাবে। তখন আমি নজরুলকে গ্রেফতারের জন্য আরিফকে অনুমতি দেই। ওই দিন আনুমানিক দুপুর ২টার সময় মেজর আরিফ আমাকে ফোন করে বলেন, স্যার টার্গেট এর সঙ্গে ৪জন আছে।

রাত ৮টায় আমি নজরুলের স্ত্রী ও শ্বশুরের জন্য আমার অফিসে অপেক্ষা করছিলাম। তখন মেজর আরিফ আমাকে ফোন করে বলেন, স্যার আমার লোক বদলি করতে হবে, আপনি একটা গাড়ি দেন। আমি আরিফকে নরসিংদীর ক্যাম্পে বিশ্রাম নিয়ে একবারেই নারায়ণগঞ্জ ক্যাম্পে ফিরতে বলি। আরিফ জানান যে তিনি নরসিংদীর ক্যাম্পে নাই। নরসিংদীর ক্যাম্পের কমান্ডার মেজর সুরুজ তাকে না বলায় তিনি ক্যাম্প থেকে বের হয়ে গেছেন। তখন আমি আরিফকে জিজ্ঞেস করি, তুমি, তোমার লোকজন কোথায়? খাওয়া-দাওয়া করেছো? আরিফ আমাকে জানান, স্যার, আমি আমার লোকজনদের খাওয়াইছি। আসামিরা এখন ঘুমাচ্ছে, আমি আমার লোকজনদের খাওয়ানোর জন্য সুরুজ স্যারের কাছ থেকে টাকা নিয়েছি।

রাত ৮টার পর থেকে রাত ৯টার আগ পর্যন্ত আমি নজরুলের স্ত্রী, শ্বশুর ও নজরুলের আরো ১০/১২ জন লোকের সঙ্গে মিটিং করি। ওই সময় নজরুলের শ্বশুর ও স্ত্রী বলেন, নূর হোসেন, নজরুলকে অপহরণ করেছে। নূর হোসেনকে গ্রেফতার করলেই নজরুলকে পাওয়া যাবে। 

রাত ৯টার দিকে আরিফ আমাকে ফোন করে বলেন, স্যার রাস্তায় পুলিশের কড়া চেকিং চলছে। আমি সিভিল গাড়ি নিয়ে নারায়ণগঞ্জ আসলে চেকিংয়ে পড়বো। তাই আমার ক্যাম্পে ফেরার জন্য নৌকা দরকার। তখন আমি আরিফকে বলি, লেফটেন্যান্ট কমান্ডার রানার সঙ্গে কথা বলে তুমি সব ঠিক করে নাও। এরপর আমি রানা আর আরিফের সঙ্গে কথা বলে তাদেরকে সমন্বয় করে নিতে বলি।

রাত সোয়া ১১টায় আরিফ আমাকে ফোন করে বলেন, স্যার, আমি কাঁচপুর পৌঁছে গেছি। তখন আমি বলি, ঠিক আছে। রাত আনুমানিক আড়াইটার দিকে আমি নৌকাঘাটে পৌঁছাই। আমি পৌঁছানোর ২০/২৫ মিনিট পর মেজর আরিফও নৌকাঘাটে পৌঁছান।

এরপর আমি আরিফকে তার লোকজনসহ আসামিদের নিয়ে গাড়িতে উঠাতে বলি এবং র‌্যাব হেডকোয়ার্টারে যেতে বলি। আরিফ বলেন, স্যার, আসামিদের মেরে ফেলেছি। তখন আমি আরিফকে বলি, মেরে ফেলেছো, মানে! কেন মেরেছো? আরিফ বলেন, নজরুল আমাকে চিনে ফেলেছে, তাই আমি নজরুলকে মেরেছি। অন্যরা দেখে ফেলেছে, তাই ভয়ে তাদেরকেও মেরে ফেলেছি। আরিফ জানায়, সে মোট সাত জনকে মেরেছে। তখন আমি বলি, সাত জন মানে? তুমি তো গ্রেফতার করেছো পাঁচ জনকে, আর দু’জনকে কোথায় পেলে?

আরিফ আমাকে বলেন, স্যার, আমার গাড়িতে পাঁচ জন ছিলো। ওই পাঁচ জনের বিষয়ে আমি আপনাকে রিপোর্ট দিয়েছি। পেছনে আর একটি গাড়িতে রানা স্যার দু’জনকে পাঠিয়েছেন। এই দু’জনের বিষয়ে আপনাকে জানানো হয়নি। ভেবেছিলাম ক্যাম্পে এসে জানাবো। এই কথা শুনে আমি আরিফের সৈনিকদের নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ি। তখন আমি নিচে নেমে সৈনিকদের সঙ্গে কথা বলে তাদের আশ্বস্ত করি যে কোনও সমস্যা নাই।  এম এম রানার জবানবন্দি

২০১৪ সালের ৫ জুন রানা আদালতে দেয়া তার জবানবন্দির বলেন, এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে র‌্যাব-১১ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ নিজেই মেজর আরিফকে নজরুলের একটি প্রোফাইল দেখিয়ে তাকে গ্রেফতার করতে এবং আমাকে আরিফকে সহায়তার নির্দেশ দেন। নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল আনুমানিক ১২টা ৩৫ মিনিটের দিকে আমি কোম্পানি কমান্ডারের গাড়িতে মেজর আরিফের কাছে পৌঁছাই এবং গাড়ি ছেড়ে দেই। এরপর মেজর আরিফের নীল কালারের মাইক্রোবাসে উঠে দেখি মেজর আরিফ, নূর হোসেন, নিজস্ব সোর্স, নিজস্ব গোয়েন্দা বাহিনীর সঙ্গে নজরুলের বিষয়ে কথাবার্তা বলছেন।

ওই সময় মেজর আরিফ আমাকে বলেন, স্যার, নজরুল একজন দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী। তার সঙ্গে সব সময় ৪/৫টি আর্মস থাকে। আমরা সিভিল ড্রেসে তাকে গ্রেফতার করতে গেলে সে আমাদেরকে নূর হোসেনের লোক ভেবে গুলি করে বসতে পারে।

মেজর আরিফ আরও বলেন, স্যার, আপনার ইউনিফর্মধারী পেট্রোল টিমকে দিয়ে ফাঁকা জায়গায় নজরুলকে আটকাতে হবে। যেহেতু মেজর আরিফ অপারেশন কমান্ডার সেহেতু আমি তার কথা মতো আমার ইউনিফর্মধারী পেট্রোল টিমকে নজরুলকে আটকানোর জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেই। আনুমানিক ১টার দিকে মেজর আরিফের কাছে ফোন আসে যে, নজরুল দুটি গাড়ি নিয়ে কোর্ট থেকে বের হচ্ছে। নজরুলের গাড়ি দুটি বের হওয়ার পর আমরা আমাদের মাইক্রোবাস দুটি নিয়ে ওই গাড়ি দুটিকে ফলো করি এবং পেট্রোল টিমকে গাড়ি দুটির বর্ণনা দিয়ে ফতুল্লা স্টেডিয়ামের পর সিটি করপোরেশনের গেটের কাছে ফাঁকা জায়গায় থামাতে বলি।

নজরুলের গাড়ি দুটির একটি সাদা কালারের, অন্যটি কালচে রংয়ের ছিল। আনুমানিক ১টা ২০ মিনিটের দিকে পেট্রোল টিম নজরুলের গাড়ি দুটিকে সিটি করপোরেশনের গেটের মুখে থামায়। তখন আমাদের দুটি মাইক্রোবাসে থাকা সিভিল টিম নজরুলের গাড়ি দুটিতে থাকা সবাইকে গ্রেফতার করে আমাদের মাইক্রোবাস দুটিতে তোলে। আমি মাইক্রোবাস থেকে নেমে ঘটনাস্থলে পেট্রোল টিমের সঙ্গে থেকে যাই এবং মেজর আরিফ ধৃত লোকদেরসহ মাইক্রোবাস দুটি নিয়ে চিটাগাং রোডের দিকে চলে যায়।

আমি সিদ্ধিরগঞ্জ থেকে আদমজীনগরে ব্যাটালিয়ন সদরে ফিরে অধিনায়কের সঙ্গে দেখা করি এবং তাকে জানাই যে, নজরুলসহ ৫/৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।  নজরুলের দুটি গাড়ির একটিকে সরানো হয়েছে অন্যটি ঘটনাস্থলে পড়ে আছে। তখন সিও স্যার বলেন যে, ওই গাড়িটিও সরানোর ব্যবস্থা করো। সিও-এর নির্দেশনা অনুযায়ী আমি ড্রাইভার কনস্টেবল মিজানকে নিয়ে ঘটনাস্থলে পরিত্যক্ত কালচে রংয়ের গাড়িটি নিয়ে আনুমানিক ৩টা ৪৫ মিনিটে গুলশান নিকেতনে রেখে আসি।

গাড়িটি রেখে আসার সময় ভেতরে অ্যাডভোকেটের ভিজিটিং কার্ড দেখতে পাই। তখন বুঝতে পারি যে, এই গাড়ির লোকটি একজন অ্যাডভোকেট। সিওকে জানাই যে, নজরুল সহ ধৃতদের মধ্যে একজন অ্যাডভোকেট রয়েছেন। আনুমানিক ৫টা ১০ মিনিটের দিকে মেজর আরিফ আমাকে ফোন করলে জিজ্ঞাস করি, মোট কতজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে? তখন সে বলে সাত জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

আমি বলি যে, ওই সাত জনের মধ্যে একজন অ্যাডভোকেট আছে। তুমি অপারেশন কমান্ডার তাই তার সম্পর্কে বুঝে শুনে সিও স্যারকে সাজেশন দিও। আনুমানিক ৫টা ২৫ মিনিটের সময় মেজর আরিফ আমাকে ফোন করে বলে যে, আপনার ক্যাম্পে থাকা ট্রলারটি রাত সাড়ে ১০টার মধ্যে কাঁচপুর ব্রিজের নিচে পাঠিয়ে দেবেন। তারপর আমি ট্রলারটি পাঠানোর বিষয়ে সিও স্যারের অনুমতি নিয়ে লিডিং সিম্যান সামাদকে, মেজর আরিফের মোবাইল নম্বর ০১৭৮২-৪৬০০৬৪ দিয়ে তার সঙ্গে সমন্বয় করে ট্রলার নিয়ে কাঁচপুর ব্রিজের কাছে থাকতে বলি। রাত আনুমানিক ১০টা ৪০ মিনিটের সময় আমি বাসায় চলে যাই।

অনুমান রাত ১টার দিকে মেজর আরিফের অধীনে থাকা মাইক্রোবাসসহ সিভিল টিমটি ক্যাম্পে পৌঁছানোর বিষয়ে রিপোর্ট করে। রাত ১টা ৩৫ মিনিটের দিকে এডিজি (ওপস) কর্নেল জিয়া আমাকে ফোন করে বলেন, আরিফ ...। আমি বলি স্যার, আমি আরিফ না, রানা, আরিফের নম্বর শেষে ডবল ফাইভ। এরপর স্যার ফোন রেখে দেন।

পরের দিন ২৮ এপ্রিল আনুমানিক রাত সাড়ে ১০টার সময় মেজর আরিফ বলে, স্যার কর্নেল জিয়া গতকাল রাত তিনটায় আমাকে ডেকেছিলেন এবং জিজ্ঞেস করেছেন যে, নজরুলদের কেন মারছো? কীভাবে মারছো?

ওই সময় মেজর আরিফ আরও বলেন, আমি রাত সাড়ে ১২টার সময় এক্সিকিউশন করেছি, ইনজেকশন পুশ করে কাঁচপুর ব্রিজের নিচে শ্বাসরোধ করে গাড়ির ভেতরে। আর কর্নেল জিয়া স্যার আমাকে ফোন করেছেন রাত দুটায়। উনি আমাকে সাড়ে ১১টা কিংবা ১২টায় কল দিলেতো আর এই জিনিসটা হতো না। মেজর আরিফের জবানবন্দি

আরিফ হোসেন ২০১৪ সালের ৪ জুন ১৬৪ ধারায় আদালতে জবানবন্দি দেন। তার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করেন নারায়ণগঞ্জ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কে এম মহিউদ্দিন।

২০১৪ সালের মার্চে আদমজীনগরে অবস্থিত র‌্যাব-১১ এর হেডকোয়ার্টারে আমাদের কনফারেন্স ছিল। ওই কনফারেন্সে সিও লে. কর্নেল তারেক সাঈদ কাউন্সিলর নজরুলকে গ্রেফতারের জন্য আমাকে বলেন। একাজে আমাকে সাহায্য করতে লে. কমান্ডার রানাকে নির্দেশ দেন। আমরা নজরুলকে ধরার জন্য তার প্রতিপক্ষ অপর কাউন্সিলর নূর হোসেনকে সোর্স হিসেবে ব্যবহার করি।

২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল সকাল ১০টার দিকে নূর হোসেন আমাকে ফোন করে বলেন, নজরুল আজকে (২৭ এপ্রিল ) নারায়ণগঞ্জ কোর্টে হাজিরা দিতে এসেছে। আমি ওই সংবাদটি সিও তারেক সাঈদকে জানাই। তিনি তখনই নজরুলকে ধরার জন্য আমাকে ও রানাকে অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দেন। আমি অভিযানের বিষয়ে কমান্ডার রানার সঙ্গে কথা বলি।এরপর আমার নীল রংয়ের মাইক্রোবাসে টিমসহ কোর্টের উদ্দেশ্যে বের হই। আমার টিমের সদস্যরা- হাবিলদার এমদাদ, এসআই পুর্নেন্দু বালা, নায়েক দেলোয়ার (ড্রাইভার), বেলাল, হীরা, নাজিম, সিপাহী তৈয়ব, সৈনিক আলীম, আলামিন, মহিউদ্দিন, কনস্টেবল শিহাব একত্রে আনুমানিক বেলা ১১টায় কোর্টের বাইরের গেটে উপস্থিত হই।

নজরুলের গতিবিধি নজরদারি করতে আমি হাবিলদার এমদাদ, নায়েক বেলাল, সিপাহী তৈয়বকে কোর্টের ভেতরে পাঠাই। আমরা কোর্টের বাইরে রাস্তার পশ্চিম পাশে অপেক্ষা করছিলাম। বেলা সোয়া ১১টার দিকে একটি সিলভার কালারের মাইক্রোবাসে করে রানার টিমের ৭/৮ জন সদস্য আমাদের সঙ্গে যোগ দেন। ওই সময় তিনি মাইক্রোবাসে ছিলেন না। আনুমানিক বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রানা নিজের গাড়িতে করে এসে গাড়ি ছেড়ে দেন এবং আমার মাইক্রোতে এসে বসেন।

আমি তাকে (রানা) জানাই, নজরুলের সঙ্গে তার ১৫/১৬ জন সহযোগী আছে। রানা সিনিয়র হওয়ার কারণে তখন তিনি অপারেশন কমান্ডার হয়ে যান এবং তিনি যেভাবে প্ল্যান করেন সেভাবেই কাজ হয়। ওই সময় কমান্ডার রানা প্ল্যান করেন, রুটিন পেট্রোল টিমের সদস্যদের দিয়ে ফতুল্লা স্টেডিয়াম এলাকায় সিটি করপোরেশনের গেটের কাছে ফাঁকা এলাকায় নজরুলের গাড়িটি থামানো হবে।

জবানবন্দিতে আরিফ জানান, আনুমানিক দুপুর ১টার দিকে নজরুল একটি সাদা প্রাইভেটকারে করে কোর্ট থেকে বের হয়ে সাইনবোর্ডের দিকে যায়। তখন আমি ও রানা আমাদের মাইক্রোবাস দুটি নিয়ে নজরুলের গাড়ির পিছু পিছু যাই। রানা ওই সময় নজরুলের গাড়ির বর্ণনা দিয়ে পেট্রোল টিমকে ওই গাড়িটি থামাতে বলে। আনুমানিক দেড়টার দিকে পেট্রোল টিম চেকপোস্ট বসিয়ে সিটি করপোরেশনের গেটের কাছে নজরুলের গাড়িটি থামায়। তখন আমরা নজরুলের গাড়ি থেকে নজরুলসহ পাঁচজনকে বের করে আমার মাইক্রোবাসে তুলি।

এ সময় আমাদের পেছনে একটি অ্যাশ কালারের প্রাইভেটকার থেকে একজন নেমে চিৎকার করতে থাকেন। তখন রানা ওই লোক ও তার ড্রাইভারকে তার মাইক্রোবাসে তোলেন। আমি ওই পাঁচজনকে মাইক্রোবাসে তুলে কাঁচপুরের দিকে রওনা দেই এবং রানাকে বলি আমার গাড়িটিকে ফলো করার জন্য। আনুমানিক ১টা ৫০ মিনিটের দিকে আমি তারাবো নামক এলাকায় পৌঁছাই। ২/৩ মিনিটের মধ্যেই রানার গাড়িটিও সেখানে পৌঁছায়। পরে আমি সিওকে রিপোর্ট করি, নজরুলসহ সাত জনকে আটক করা হয়েছে।

জবাবে সিও বলেন, কোনও প্রত্যক্ষদর্শী রাখা যাবে না। সাতজনকেই গুম করে ফেলো। তার আদেশে আমি আমার ক্যাম্পের বেলালকে সাত সেট ইটের বস্তা তৈরি করার জন্য বলে মাইক্রোবাস দুটি নিয়ে নরসিংদীর দিকে চলে যাই। আনুমানিক আড়াইটার দিকে আমি নরসিংদী র‌্যাব ক্যাম্পের কাছাকাছি পৌঁছাই। ওই সময় নরসিংদী ক্যাম্প কমান্ডার সুরুজকে ফোন করে তার সঙ্গে ক্যাম্পের বাইরে দেখা করি। 

পরে আনুমানিক বিকাল চারটার দিকে আমি শিবপুর উপজেলার দিকে একটি নির্জন জায়গায় অপেক্ষা করতে থাকি। আনুমানিক রাত ৮টার দিকে নারায়ণগঞ্জে যাওয়ার জন্য সিওকে জানাই। রাস্তায় পুলিশের কড়া নজরদারি থাকার কারণে সিও আমাদের জন্য ট্রাক পাঠাবেন বলে জানান। সিও বলেন, তোমরা ওই ট্রাকে করে আসামিদের নিয়ে এসো।

আমি সিওকে বলি, ট্রাক আসতে অনেক দেরি হবে, আমরা মাইক্রোবাস নিয়ে নারায়ণগঞ্জে চলে আসছি। রাত আনুমানিক ৯টার দিকে আমরা নরসিংদীর বেলানগর পৌঁছাই। সেখানে সৈনিক মহিউদ্দিনকে সাতটি সাকসা (চেতনানাশক ইনজেকশন) এবং একটি সিরিঞ্জ কিনে আনতে বলি। রাত সাড়ে ১০টার দিকে কাঁচপুরে পৌঁছে একটি পরিত্যক্ত পেট্রোল পাম্পে অপেক্ষা করতে থাকি। এরপর সিওকে ফোন করে জানাই, রাস্তায় পুলিশের কড়া নজরদারি চলছে। এ অবস্থায় নারায়ণগঞ্জ শহরে ঢোকা ডিফিকাল্ট। তাই রানা যেন ট্রলারটি কাঁচপুর ব্রিজের নিচে পাঠিয়ে দেন। কিছুক্ষণ পর রানা ফোন করে আমাকে জানান, কাঁচপুর ব্রিজের নিচেই ট্রলার থাকবে।

আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে আরিফ বলেন, আমি তখন নূর হোসেনকে ফোন করে জানাই, কাঁচপুর ব্রিজের নিচে যেন কোনও মানুষের জটলা না থাকে। রাত ১১টার দিকে আমি মাইক্রোবাস দুটিসহ কাঁচপুর ব্রিজের নিচে বিআইডব্লিউটিএ’র ঘাটে পৌঁছাই। রাত সাড়ে ১১টার দিকে বেলালকে ফোন করে ইটের প্যাকেটগুলো কাঁচপুর ব্রিজের নিচে নিয়ে আসতে বলি।

রাত আনুমানিক ১২টার দিকে একটি সাদা মিতসুবিশি মাইক্রোবাসে করে হাবিলদার এমদাদ, নায়েক বেলাল, সৈনিক আরিফ, সৈনিক তাজুল ইটের প্যাকেটগুলো নিয়ে বিআইডব্লিউটিএ’র ঘাটে আসেন। রাত সাড়ে ১২টার দিকে রানার ট্রলারটি কাঁচপুর ব্রিজের নিচে আসে। 

আমি সিওকে চূড়ান্ত রিপোর্ট দিয়ে বলি, সাত জনকে গুম করার বিষয়ে আমি প্রস্তুত। ওই সময় সিও আমাকে বলেন, ওকে গো অ্যাহেড।

আরিফ বলেন, তার (সিও) আদেশ পেয়ে আমি নায়েক হিরা, সিপাহী তৈয়ব মাইক্রোবাসে থাকা সাতজনকে সাকসা ইনজেকশন পুশ করতে বলি। ইনজেকশন পুশ করার পর নায়েক বেলাল, হীরা, সিপাহী তৈয়ব, এসআই পুর্নেন্দু বালা, সৈনিক আলামিন, তাজুল, কনস্টেবল শিহাব ও সৈনিক আলীম এই আট জন মিলে আটককৃত সাত জনের মুখে পলিথিন প্যাঁচিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে। এরপর আমি সবার মৃতদেহ ট্রলারে লোড করতে বলি। আমার টিমসহ ট্রলারে উঠি এবং রানার টিম ও গাড়িগুলো ফেরত পাঠাই।

আমরা রাত আড়াইটার দিকে ট্রলার নিয়ে মেঘনা নদীর মোহনায় পৌঁছাই। সেখানে পৌঁছানোর পর আমার টিমের সদস্যরা প্রতিটি মৃতদেহের সঙ্গে এক সেট ইটের বস্তা বেঁধে নদীতে ফেলে দেয়। পরে সেখান থেকে ফেরত আসার সময় তৎকালীন র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (এডিজি অপস) কর্নেল জিয়াউল আহসান আমাকে ফোন করেন। তার ফোন না ধরে সিওকে ফোন করে বলি, এডিজি জিয়াউল কেন আমাকে ফোন করছেন? তখন সিও আমাকে বলেন, আমি তার সঙ্গে কথা বলে তোমাকে জানাচ্ছি।

কিছুক্ষণ পর সিও আমাকে ফোন করে জানান, এডিসি আমাকে ও আমার টিমের সদস্যদেরকে তার অফিসে যেতে বলেছেন। রাত অনুমান সাড়ে তিনটার দিকে আমি ট্রলারে করে নারায়ণগঞ্জ ঘাটে এসে পৌঁছাই। সেখানে গিয়ে সিও সাঈদের সঙ্গে কথা বলে আমি র‌্যাব হেডকোয়ার্টারের উদ্দেশ্যে রওনা দেই।

রাত চারটার দিকে আমি এডিজির অফিসে পৌঁছাই। এডিজি জিয়াউল আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, নজরুল কোথায়? তার প্রশ্ন শুনে আমি একটু অবাক হই। তারপর বলি, নজরুল কোথায় আমাকে জিজ্ঞাসা করছেন কেন? তিনি আবারও আমাকে একই প্রশ্ন করেন। আমি তাকে বলি, আমি যা করি সিও’র আদেশে করি। এ বিষয়ে যা জিজ্ঞাসা করার আপনি তাকে করেন। তারপর এডিজি সিওকে ফোন দিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলান।

তখন সিও আমাকে বলেন, এডিজি কেন এমন করছে তা বুঝতে পারছি না। তুমি তাকে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে আসো। পরে আমি সমস্ত ঘটনা এডিজিকে জানাই। ২৯ এপ্রিল আমি ও সিও দুপুর দেড়টার দিকে র‌্যাবের হেডকোর্য়াটারে পৌঁছানোর পর এডিজি জিয়াউল আমার কাছে জানতে চান, লাশগুলো কী করেছি। উত্তরে আমি বলি, লাশগুলো মেঘনাতে ফেলে দিয়েছি।