ত্রাণ পাচ্ছে না মানুষ, বিপাকে বন্যা কবলিত এলাকা
গত কয়েকদিনের টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে দেশের বিভিন্ন জায়গায় দেখা দিয়েছে ভয়াবহ বন্যা। আর সাথে যুক্ত হয়েছে ত্রাণ সমস্যা। পর্যাপ্ত ত্রাণ সরবরাহ না থাকায় বিপাকে পড়েছে বন্যদুর্গত এলাকার মানুষ।
কিছু কিছু এলাকায় ত্রাণ পৌঁছলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। পানির তোড়ে পাকা সড়ক ভেঙে যাওয়ায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এখন উত্তরাঞ্চলের অনেক জেলা। বন্যায় আমন ধান ক্ষেত, বীজতলা, শাকসবজির ক্ষেত, পানবরজ, আখক্ষেতসহ বিভিন্ন ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। গবাদিপশু নিয়ে দিশেহারা কৃষকরা। পানি প্রবেশ করায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও টানা বর্ষণে ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, রাজশাহী, দিনাজপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, রাজবাড়ী, টাঙ্গাইলসহ বিভিন্ন এলাকার বন্যাকবলিত মানুষ এখন বাঁচার জন্য লড়াই করছে।
এদিকে দেশের মধ্য ও দক্ষিণাঞ্চলে বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। পদ্মাসহ বিভিন্ন নদীর পানি অব্যাহত বৃদ্ধি পাওয়ায় এ আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পানি প্রবাহের প্রধান অববাহিকা ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা এবং মেঘনায় পানির চাপ কমতে থাকায় এ মুহূর্তে দেশে ১৯৮৮ বা ১৯৯৮ সালের মতো দেশব্যাপী বড় বন্যার আশঙ্কা নেই।
বিভিন্ন স্থানে বন্যার পানিতে ডুবে শিশুসহ ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে। এ নিয়ে গত তিন দিনে বিভিন্ন স্থানে বন্যার পানিতে ডুবে ৫০ জনের মৃত্যু হয়েছে।
মঙ্গলবার রাজধানীতে বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে ব্রিফিং করেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা।
সংস্থাটির প্রধান প্রকৌশলী একে মনজুর হাসান বলেন, পদ্মায় পানি বাড়লেও বন্যার পানির প্রধান উৎস ব্রহ্মপুত্র ও যমুনায় উজান থেকে আসা পানির চাপ কমতে শুরু করেছে। উত্তরাঞ্চলে বন্যা যে পর্যায়ে গেছে তা সেখানকার জন্য ভয়াবহ। কিন্তু ১৯৯৮ সালে দেশের দুই তৃতীয়াংশে বন্যা হয়েছিল।
এবার শুধু উত্তরাঞ্চলের ৯টি জেলা এখন পর্যন্ত আক্রান্ত। যেহেতু আসামে বৃষ্টিপাত হ্রাস পাওয়ায় ব্রহ্মপুত্র যমুনায় পানি আসার প্রবণতা কমেছে। সুরমা কুশিয়ারায়ও উজান থেকে আগের পরিমাণে পানি আসছে না। এ দুই অববাহিকা থেকে দেশের ভেতরে পানি আসার পরিমাণও কমছে। অপরদিকে পদ্মায় পানি বাড়লেও তা বিপদসীমার নিচে আছে।
ফলে তিন অববাহিকা একসঙ্গে সক্রিয় হওয়ার আশঙ্কা নেই। তাই বড় বন্যারও আশঙ্কা নেই। তবে যেহেতু উজান থেকে ঢলের পানি আসা একেবারে বন্ধ হয়নি, তাই ব্রহ্মপুত্র-যমুনার পানির আরও ২৪ ঘণ্টা ধরে অল্প হারে পানি বাড়তে থাকবে।
এতে উত্তরাঞ্চলে আরও ৪৮ ঘণ্টা ধরে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি অব্যাহত থাকবে। ইতিমধ্যে চলে আসা বানের পানিতে ভাসছে উত্তর এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চল। এ পানিতে ডুবে আছে উত্তরাঞ্চলের লাখ লাখ মানুষ। সেই পানি কতদিনে নামবে তা বলতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা।
অপরদিকে উত্তরের বানের পানি ক্রমান্বয়ে চলে আসছে দেশের মধ্য এবং দক্ষিণ-মধ্যাঞ্চলে।
রাজবাড়ীর গোয়ালন্দের পর মঙ্গলবার প্রথমবারের মতো মুন্সীগঞ্জের ভাগ্যকুলে পদ্মার পানি বিপদসীমা পার করেছে। টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, মুন্সীগঞ্জের চর ও নিন্মাঞ্চলে হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বন্যা দেখা দিতে পারে।
এ পানি ধেয়ে আসছে রাজধানীর দিকেও। ঢাকার আশপাশের পাঁচ নদীর পানি বাড়ছে। তবে আগামী ৩ দিনে বিপদসীমা অতিক্রমের আশঙ্কা নেই।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র (এফএফডব্লিউসি) জানিয়েছে, মঙ্গলবারও বাংলাদেশ অংশে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা বিপদসীমার অনেক ওপরে প্রবাহিত হচ্ছে। বিশেষ করে যমুনা বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ওপরে প্রবাহিত হচ্ছে।
বিকাল ৩টায় বিপদসীমার ১৩২ সেন্টিমিটার ওপরে ছিল। তখন পর্যন্ত এটি ২০.৮২ মিটারে ছিল। এরআগে ওই পয়েন্টে ২০.৭১ মিটার পর্যন্ত পানি উঠেছিল। আবার বাহাদুরাবাদসহ উজান থেকে পানি নামতে শুরু করায় সারিয়াকান্দি, সিরাজগঞ্জ, কাজিপুর ও আরিচায় আগের দিনের তুলনায় পানি বেড়েছে।
এফএফডব্লিউসির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সাইফুল হোসেন বলেন, বৃষ্টিপাত বন্ধ থাকলে এবং পানি নামার এ হার অব্যাহত থাকলে আগামী ৭২ ঘণ্টায় উত্তরের বিভিন্ন জেলায় বন্যা পরিস্থিতি উন্নতির দিকে যাবে। পানি বাড়ছে ধলেশ্বরী ও পুরাতন ব্রহ্মপুত্রে। ঢাকায় পানি আসে এ দুই নদী দিয়ে।
মঙ্গলবার সকাল থেকে ৬ ঘণ্টায় বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যায় গড়ে ১০ সেন্টিমিটার পানি বেড়েছে। তবে এ নদীগুলোর পানি এখনও বিপদসীমার ৪০ সেন্টিমিটার থেকে ১৩০ সেন্টিমিটার নিচে বইছে। গঙ্গা-পদ্মার পানি বাড়লেও তা বিপদসীমার অনেক নিচে আছে। আরিচার পর যে দুই পয়েন্টে পদ্মার পানি বিপদসীমা পার করেছে, তা মূলত যমুনা থেকে আসা। আর সুরমা-কুশিয়ারার পানি এসে এদিন নতুন করে তিতাসের পানি বিপদসীমার ওপরে নিয়ে গেছে।
তবে সুরমা-যমুনায় ভারত থেকে নতুন পানি আসার হার কমেছে। এ কারণে মেঘনা অববাহিকায় আগামী ৪৮ ঘণ্টায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হবে। একই ভাবে তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার নদীর পানি কময় সেখানেও বন্যা পরিস্থিতি উন্নতির দিকে যাবে।
বিপদসীমার ওপরে প্রবাহিত হওয়া নদীগুলো হচ্ছে- ধরলা, যমুনেশ্বরী, ঘাঘট, করতোয়া, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, গুর, আত্রাই, ধলেশ্বরী, লক্ষ্যা, পুনর্ভবা, ইছ-যমুনা, ছোট যমুনা, পদ্মা, কপোতাক্ষ, সুরমা, কুশিয়ারা, পুরাতন সুরমা, কংস ও তিতাস। সোমবার সকাল ৯টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় ২১ নদীর পানি বিপদসীমার ওপরে বইছে।
সব মিলিয়ে মঙ্গলবার দেশের ৫৬ স্টেশনে পানি বেড়েছে। এ প্রসঙ্গে এফএফডব্লিউসির নির্বাহী প্রকৌশলী সাজ্জাদ হোসেন বলেন, কতটি নদীর পানি বিপদসীমার ওপরে গেছে তা দিয়ে বন্যার ভয়াবহতা নিরূপণ করা যাবে না।
প্রধান উৎস যমুনা, পদ্মা এবং মেঘনার কি অবস্থা তা দেখতে হবে। যেহেতু ওইগুলোতে উজান থেকে পানির হার কমতে শুরু করেছে, সেটাই ইতিবাচক। এ নদীগুলোর পানিই এখন দেশের অন্য নদীতে চলে যাচ্ছে।